ট্র্যাফিক সিগনালে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল গাড়িটা৷ তার মধ্যেই আপনার দিকে ছুটে এলো কয়েকটা শিশু৷ কারুর হাতে ফুল, কারুর বা মরসুমি ফল অথবা সিনেমার পত্রিকা৷ তবে কারু কারু হাতে কিছু নেই৷ মুখে শুধু প্রশ্ন – একটা পয়সা দেবে?
বিজ্ঞাপন
ওরা শিশু ভিখারি৷ ঢাকা-কলকাতাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু শহর এবং শহরতলির রাস্তাঘাটে, লোকাল ট্রেনে, প্ল্যাটফর্মে, হাসপাতালের সামনে, ফুটপাথে দেখে মেলে এদের৷ পরনে ছেঁড়া জামা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খালি পা, ধুলো-মাখা শরীর – কখনও সুস্থ, কখনও আবার বিকলাঙ্গ৷
মনে পড়ে নতুন দিল্লিতে পড়াশোনা করার সময়, প্রতিদিনই একটা ফ্লাইওভারের নীচে কয়েকটা বাচ্চাকে দেখতাম৷ দিনের পর দিন একই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার জন্য ওদের সঙ্গে আমার একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল৷ তাই এক টাকায় একটা গোলাপের জায়গায় কখনও কখনও দুটো গোলাপও আমার হাতে গুঁজে দিত ওরা৷ আর আমিও কোনোদিন পাউরুটি, কোনোদিন চকলেট ধরিয়ে দিতাম তাদের৷ এভাবে বন্ধুতাও বাড়ছিল৷
মাত্র কয়েক টাকার জন্য
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরকে খনি, কারখানা ও কৃষিখাতের বিভিন্ন চরম প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ
১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে৷ সেখানে ১৮ বছরের কমবয়সি শিশু-কিশোরদের শ্রমিক কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়৷
ছবি: imago/Michael Westermann
তোয়ালে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে তোয়ালে তৈরির কারখানায় কাজ করে এই শিশুটি৷ আইএলও-র হিসাবে এশিয়ায় প্রায় সাত কোটি ৮০ লাখ শিশু কাজ করছে৷ অর্থাৎ ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশু-কিশোরের প্রায় ১০ শতাংশ কাজেকর্মে নিয়োজিত৷
ছবি: imago/imagebroker
দিনে ৬৫ টাকা
লেখাপড়ার পরিবর্তে এই শিশুটি ইট তৈরি করছে৷ চরিম দরিদ্রতার কারণে ভারতের অনেক পরিবার তাদের শিশুদের কাজে পাঠিয়ে থাকে৷ দিন প্রতি মাত্র ৮০ সেন্ট, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ বাংলাদেশি টাকা পায় তারা৷ এ জন্য তাদের কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়৷
ছবি: imago/Eastnews
সস্তা শ্রম
ভারতের সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ শিশু-কিশোর শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে৷ তারা পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে রান্না করা, রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করা – সব কাজই করে৷ এমনকি ইট কাটা, মাঠে তুলা তোলা ইত্যাদি কাজও করে থাকে শিশুরা৷
ছবি: imago/imagebroker
অমানবিক অবস্থা
২০১৩ সালে প্রকাশিত আইএলও-র একটি প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শিশু শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে৷ তাদের অধিকাংশকেই কোনোরকম চুক্তিপত্র ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কাজ করতে হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘মেড ইন বাংলাদেশ’
জাতিসংঘের শিশু কল্যাণ সংস্থা ইউনিসেফ-এর হিসাবে, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু-কিশোর তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে৷
ছবি: imago/Michael Westermann
কম্বোডিয়ার পরিস্থিতি
কম্বোডিয়ায় স্কুল পড়ুয়া শিশু-কিশোরের সংখ্যা অনেক কম৷ বেশিরভাগই তাদের মা-বাবার সঙ্গে কাজ করে৷ এছাড়া হাজার হাজার শিশু রাস্তায় বাস করে কম্বোডিয়ায়৷ এই যেমন এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি
২০০০ সালের পর বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও এশিয়ার অনেক দেশ যেমন বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপাল, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে পরিস্থিতির এখনও ততটা উন্নতি হয়নি৷
ছবি: AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
একবার কী হয়েছে, দিল্লিতে ভীষণ শীত পড়লো৷ কনকনে ঠান্ডা, দুপুর পর্যন্ত কুয়াশা পড়ে৷ তাই ভাবলাম ওদের জন্য গরম জামা, সোয়েটার আর প্রত্যেককে একটা করে জুতো কিনে দেবো৷ তখন আমি পড়াশোনার পাশাপাশি একটা খবরের কাগজে পার্টটাইম কাজ করি৷ তাতে যা রোজগার ছিল, সেটা জমিয়েই দিলাম সবাইকে সাধ্যমতো৷ ওরা তো ভীষণ খুশি – এটা আমার, এটা আমার করে নিমেষের মধ্যে সবকিছু ভাগাভাগি করে নিল ওরা৷ ভাবলাম, বাহ্ কাল থেকে ওদের আর খালি পায়ে ভিক্ষে করতে হবে না৷
কিন্তু কোথায় কী! সকালে বের হয়ে দেখি, ওরা ঠিক আগের মতোই খালি পায়ে ফ্লাইওভারের তলায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ঠান্ডা লেগে সবচেয়ে ছোট, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতো যে মেয়েটা – তার কাশি হয়ে গেছে৷ তারপরেও গায়ে একটা ময়লা সুতির জামা ছাড়া কিচ্ছু নেই! আমি দূর থেকেই চেঁচিয়ে বললাম – এই, তোদের জামা-জুতোগুলো গেল কই? কেউ কি কেড়ে নিয়েছে, বকা দিয়েছে তোদের? ওরা কোনো উত্তর দিল না, উলটে দৌড়ে পালিয়ে গেল৷ হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে...৷
এর কয়েক সপ্তাহ পর আমি জার্মানি চলে আসি৷ কিন্তু আজও দিল্লিতে গেলে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে ঐ ফ্লাইওভারটা দেখলে আমার ওদের কথা মনে পড়ে৷ মনে হয় আমার জন্যই হয়ত ওরা হারিয়ে গিয়েছিল সে'দিন৷ জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে ওরা....কত বড় হয়েছে? কী করছে?
ভারতের নিখোঁজ শিশুরা
বছরের পর বছর ভারতে হাজারো শিশু নিখোঁজ হওয়ার খবর শোনা যায়, যাদের অনেকেরই আর কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না৷ এদের কেউ নিজেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, আবার কাউকে অপহরণ করে নানা রকম কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: DW/B. Das
ভাগ্যের লিখন
ভারতে ‘শিশু বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে যে, ভারতে প্রতি ঘণ্টায় ১১ জন শিশু নিখোঁজ হয়ে থাকে৷ এদের মধ্যে কমপক্ষে চারজনকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না৷
ছবি: DW/B. Das
বন্দিদশা
দিল্লির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ১৬ বছর বয়সি মেয়ে পিংকিকে খুঁজে পাওয়া গেছে অপরিচিত একটি বাড়িতে৷ সেখানে ওকে জোর করে ঘরের কাজ করানো হচ্ছে এবং বলা বাহুল্য, কোনো বেতন ছাড়াই৷
ছবি: DW/B. Das
দেশব্যাপী অনুসন্ধান
ছবিটিতে এক বাবার হাতে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছেলের ছবি আর তাঁর অন্য হাতে একটি বাক্স৷ সে বাক্সে রয়েছে মানুষের সাহায্য করা অর্থ, যে অর্থ দিয়ে এই বাবা তাঁর ছেলেকে খুঁজে বের করতে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাবেন বলে ঠিক করেছেন৷
ছবি: DW/B. Das
পালিয়ে যায়
যেসব শিশুরা বাড়ি থেকে নিজের ইচ্ছায় চলে যায় বা পালিয়ে যায়, ওরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে কাজের ছেলে-মেয়ে হিসেবে বা এ ধরণেরই কোনো কাজ করে থাকে৷ যেমন চায়ের দোকান, পেট্রোল পাম্প বা কার্পেট তৈরি কারখানায়৷ ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির একটি পেট্রোল পাম্প থেকে এমনই কিছু শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ৷
ছবি: DW/B. Das
ধৈর্য ধরে থাকা
ছেলেটির হাতে ছয় বছর আগে ওর হারিয়ে যাওয়া বোনদের ছবি৷ ওদের খুঁজে পাবে এই আশায় এখনো বুক বেধে আছে ছেলেটির পুরো পরিবার৷ নিখোঁজ বোনদের ফিরে পাওয়ার জন্য পরিবার থেকে মাঝে মাঝেই বোনদের ছবি এবং নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিসহ প্রচারপত্র বিলি করা হয়৷
ছবি: DW/B. Das
দীর্ঘ প্রতিক্ষা
নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এই শিশুটিকে খুঁজে পাওয়া গেছে অবশেষে৷ শিশুটি ওর বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ঠিক এ জায়গাতেই অপেক্ষা করছে গত প্রায় এক বছর যাবত৷ কবে শেষ হবে এই অপেক্ষার পালা?
ছবি: DW/B. Das
খুশির দিন ফিরে এসেছে
নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অর্জুন আবারো মায়ের কোলে ফিরে এসে অত্যন্ত আনন্দিত, ভীষণ খুশি৷ অর্জুন ওর মাকে তার কষ্টের কথা জানিয়েছে৷ বলেছে, গত দু’বছর ওকে বেধে রাখা হয়েছিল এবং কাজ করতে বাধ্যও করা হয়েছিল৷ তবে ওর মা কিন্তু অর্জুনকে ফিরে পাবার আশা কখনো ছেড়ে দেয়নি৷
ছবি: DW/B. Das
অতিরিক্ত সাবধানতা
এই মা তাঁর কয়েকজন শিশুর মধ্যে একজনকে হারিয়েছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আর কখনো আমি আমার শিশুদের চোখের আড়াল হতে দেব না৷ উল্লেখ্য, ‘শিশু বাঁচাও আন্দোলন’ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে www.bba.org.in ঠিকানায়৷
ছবি: DW/B. Das
8 ছবি1 | 8
জার্মানির রাস্তায় বাচ্চা ভিক্ষুকদের নিষিদ্ধ করেছে সরকার৷ অথচ আমাদের দেশে শিশুশ্রম-বিরোধী আইন থাকলেও, এই সহায়সম্বলহীন শিশুদের জন্য কারো মাথাব্যথা নেই৷ তাই হাত-পা কেটে বিকলাঙ্গ করে ওদের দিয়ে ভিক্ষা করাতে কারুর এতটুকুও আটকায় না৷ শিশুকন্যাদের ধর্ষণ করে তাদের পতিতাবৃত্তিতে নামায় যে চক্র, তেমনই সব নারকীয় চক্র রয়েছে বাচ্চাদের ভিখারি বানানোর জন্য৷
এই যেমন, ঢাকার মান্ডায় পানির পাম্প এলাকায় এমনই একটা ভিক্ষুক বানানোর কারখানা ছিল৷ সেখানে বস্তি, বাস বা রেল স্টেশন – এমন নানা জায়গা থেকে পথহারাদের ধরে আনার কাজ করতো একটা চক্র৷ অঙ্গহীন শিশুদের দেখে মানুষের মনে যে দয়ার উদ্রেক হয়, সেটাই যে এই ব্যবসার মূল চাবিকাঠি! সে কারণে নির্দয়ভাবে সুস্থ একটি শিশুকে বিকলাঙ্গ করতে তাদের দ্বিধাবোধ থাকবে কেন? তাই যে শিশুরা কলকারখানা, রেস্তোরাঁ, মোটর গ্যারেজ, চা বাগান, ট্যানারি, প্লাস্টিক কারখানা, কৃষি অথবা বাড়ি বাড়ি কাজ করে, তাদের থেকে শিশু ভিখারিদের অবস্থা আরো শোচনীয়৷
আমার তো মনে হয়, অসাধু এ সমস্ত চক্রের সঙ্গে প্রশাসনেরও হাত ছিল, আছে৷ তা না হলে মহিলাদের ধরে ‘মা' বানিয়ে তাদের হাতে এক-একটা বিকলাঙ্গ শিশু ধরিয়ে দেয়ার কাজটা কি এতই সহজ?
বাংলাদেশের আইনে ভিক্ষাবৃত্তিকে সহায়তাকারী বা এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত অপরাধে অন্ততপক্ষে তিন বছরের কারাবাসের বিধান রয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ধরনের অপরাধ চক্র দমনে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন৷ কিন্তু তারপরেও কাজের কাজ কিছু হয়নি৷ আজও এ দেশে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ ভিক্ষাজীবী আছে, গড়ে যাদের দৈনিক রোজগার ১০০ থেকে ২০০ টাকা৷ অর্থাৎ এখনও বাংলাদেশে চলছে ভিক্ষা-বাণিজ্য৷
মানবাধিকার, শিশু আইন – এ সব তো আমাদের জন্য বড় বড় কথা৷ যেখানে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষেরই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়', সেখানে টাকার বিনিময়ে এতিম শিশু আর বৃদ্ধদের কিনে শারীরিকভাবে অক্ষম করে ভিক্ষার কাজে লাগানো হলে – অবাক হওয়ার কী আছে? তার ওপর বাচ্চাটি ছোট্ট এবং মিষ্টি হলে তো কথাই নেই – কারণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা কোনো কথা না বললেও, একটা টাকা নিশ্চয়ই গুঁজে দেবো৷ আর শিশুটিও নাচতে নাচতে তার ‘মালিক' বা ‘সর্দার'-এর কাছে চলে যাবে৷
কথায় বলে না – ‘বেগার্স কান্ট বি চুজার্স? – মানে ভিখারির কোনো বাছ-বিচার থাকতে নেই? আমাদের দেশে এ সব অসহায় মানুষগুলোরই হয়েছে সেই দশা৷ তবে কোনো জিনিস নয়, নিজের পছন্দসই জীবন বেছে নেয়ার, এমনকি সুস্থভাবে বাঁচারও কোনো অধিকার নেই এদের৷ এরা ভিক্ষুক, এরা ব্রাত্য, এরাই আমাদের অতি পরিচিত ‘টোকাইয়ের' দল!