বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বহুল আলোচিত বিষয় মার্কিন নির্বাচন৷ ভাবটা এমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী, আর হিলারি ক্লিনটন বিএনপির৷ কিন্তু এমন ভাবনার কোনো ভিত্তি কি আছে?
বিজ্ঞাপন
এ কথা সত্য যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াই কিংবা উন্নয়নখাতে সহায়তা অবধি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম বড় পরাশক্তির একটা ভূমিকা থাকে৷ বৈশ্বিক ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অন্যতম৷
এ রকম একটি রাষ্ট্রের ‘প্রধান' কে হচ্ছেন সেদিকে তাই নজর থাকে সবারই৷ সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচন নিয়ে তাই বাঙালির আগ্রহও ছিল অনেক৷ দুই প্রার্থীর একজন ছিলেন হিলারি ক্লিনটন, যিনি একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি, অন্যজন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি বাংলাদেশ সফর তো দূরের কথা রাজনীতিতেই নবীন৷
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে আসছে৷ এরপর বিভিন্ন সময়ে এই সম্পর্কে যোগ হয়েছে নানা মাত্রা৷ বর্তমানে দেশটি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি-গন্তব্য এবং রেমিটেন্সের অন্যতম উৎস৷
ছবি: Minara Begum
বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ যুদ্ধে তাণ্ডবলীলা চালাতে পাকিস্তান যে সব ব্যবহার করে, তার মধ্যে বহু অস্ত্রই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি৷ এমনকি তারা বাংলাদেশ অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে নতুন এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঠেকাতে চেয়েছিল৷ পাকিস্তানের পরাজয় ঠেকাতে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আনারও উদ্যোগ নিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র৷ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূকিকায় এসব নস্যাৎ হয়ে যায়৷
ছবি: picture alliance/dpa/Everett Collection
শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি
যুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও দেশটির বহু মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রাখে৷ পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিরুদ্ধেও তাঁরা সরব হন৷ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দৃশ্যত অবস্থান বদলায় মার্কিন সরকার৷ স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি রোধে দেশটির তৎপরতা দেখা গেছে৷
ছবি: Getty Images
বিনিয়োগ ও উন্নয়নে
স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ নতুন দেশটির উন্নয়নে অংশীদারিত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়েও যায় তারা৷ ইউএসএইড-এর মতে, বর্তমানে তাদের অন্যতম বৃহৎ ‘ফরেন এইড মিশন’ রয়েছে বাংলাদেশে৷ অবশ্য শেভরন, কনকো ফিলিপের মতো জ্বালানি খাতে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের নিয়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনাও রয়েছে৷
ছবি: AP
বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার
একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যে আবার আমদানি-রপ্তানির হিসাব বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে৷ গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানির মধ্যে ৬ বিলিয়নই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Masterson
রেমিটেন্স
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ের ১ হাজার ৫৩২ কোটি মার্কিন ডলারের যে রেকর্ড হয়, তার মধ্যে ২৩৮ কোটি ডলারই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷ দীর্ঘদিন যাবত দেশটি বাংলাদেশর প্রবাসী আয়ের শীর্ষ ৫ দেশের মধ্যে থাকছে৷
ছবি: Muntasir Mamun Imran
তৈরি পোশাক
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক৷ এই পণ্যও সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রপ্তানি কিছুটা পড়তির দিকে৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press
জিএসপি
জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করা যায়৷ যদিও তৈরি পোশাকখাত কোনোদিনই এই সুবিধা পায়নি, তথাপি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা বাতিল করে দেয়৷ বাংলাদেশ সরকার এখন বলছে, জিএসপি সুবিধা পাওয়া পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ কম হওয়ায় এটা কেবল মর্যাদার প্রশ্ন হয়ে আছে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/Suvra Kanti Das
ট্রাম্পযুগ
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণের ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে বাংলাদেশের তিক্ততার পর আসে মার্কিন নির্বাচন৷ সেখানে মুসলিমবিরোধী নানা মন্তব্য করলেও ট্রাম্প জিতে যাওয়ার পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে উষ্ণ অভিনন্দন জানায় বাংলাদেশ সরকার৷
ছবি: Reuters/J. Ernst
টিপিপি বাতিল
ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তিতে বাংলাদেশ সরাসরি ছিল না৷ তবে এটা ঘিরে বাংলাদেশের উদ্বেগ ছিল৷ কারণ, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে যেতো৷ তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান এই রপ্তানি পণ্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তো৷ নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে ট্রাম্প এই চুক্তি বাতিল করলে বাংলাদেশ সরকার থেকে অভিনন্দনও জানানো হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/
ভূ-রাজনীতি
অদূরে চীন, পাশেই ভারত৷ সীমান্ত রয়েছে চীনের দীর্ঘদিনের মিত্র মিয়ানমারের সঙ্গেও৷ ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পায় বড় শক্তিগুলোর কাছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ স্বল্প উন্নত দেশগুলোর পক্ষে ভূমিকা রেখেও আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভূক্তভোগী দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের কথা রয়েছে৷ ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় টান পড়বে এই অর্থ জোগানে৷ এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কার্বন নিঃসরণ না কমালে এর ফল ভোগ করতে হবে বাংলাদেশকেও৷
শান্তিরক্ষী বাহিনী
জাতিসংঘ পরিচালিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বড় একটা অংশ বাংলাদেশের৷ এটা বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়েরও একটা উৎসে পরিণত হয়েছে৷ অন্যদিকে জাতিসংঘের বাজেটের বড় একটা অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যা কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন ট্রাম্প৷ সেক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা মিশনসহ অনেক কাজ পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে বলে জানায় সংস্থাটির এক মুখপাত্র৷ এটা উদ্বেগে ফেলেছে বাংলাদেশকেও৷
ছবি: UNMIS/John Charles
অভিবাসন নীতি
যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ অভিবাসী কমাতে ট্রাম্পের নানা পদক্ষেপ সমস্যায় ফেলবে সেখানে থাকা অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে৷
ছবি: Imago/Zuma Press
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে বড় একটা জায়গা জুড়ে থাকে দেশটির গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি৷ বাংলাদেশে নিয়োগ পাওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রায়ই এটা নিয়ে কথা বলতে বা সক্রিয় হতে দেখা যায়৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
14 ছবি1 | 14
বিশ্বের অনেক দেশ, অনেক মানুষকে অবাক করে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই মার্কিনিরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছেন৷ যদিও মুসলিমবিরোধী, অভিবাসীবিরোধী, নারীর প্রতি অবমাননাকর বিভিন্ন বক্তব্যের জন্য তিনি অত্যন্ত সমালোচিত হন৷ এখনো নিয়মিতই সংবাদ শিরোনামে থাকেন তিনি, তবে সেটা যতটা না ইতিবাচক অর্থে, তার চেয়ে আরো বেশি নেতিবাচক অর্থে৷
এ রকম একজন মানুষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় কোন দেশের কেমন লাভ কিংবা ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়েও নানা রকম বিচার-বিশ্লেষন চলছে৷ এ কথা পরিষ্কার যে, ‘রক্ষণশীল' এই প্রেসিডেন্ট তাঁর নীতির ক্ষেত্রে মার্কিন স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ তবে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক জটিল করে ফেলছেন৷ সম্প্রতি ইউরোপ সফরের সময় তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘জার্মানরা খারাপ, খুব খারাপ৷' অথচ জার্মানির সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক সে দেশের৷ পরিস্থিতি এমন যে, খোদ ম্যার্কেলকেও বলতে হচ্ছে, ‘‘জোট সঙ্গীদের উপর আর আস্থা রাখা যাচ্ছে না৷'' এখানে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের দিকে ইঙ্গিত করেছেন৷
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রতি ভূয়সী সমর্থন জানানের আগে বাংলাদেশের উচিত লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করা৷ ট্রাম্প যেসব সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁর প্রভাব বাংলাদেশের উপর কী হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবা জরুরি৷ ইতোমধ্যে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করা প্যারিস চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন৷ এখানে খেয়াল রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের উপর তার প্রভাব কী হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে করণীয় কী, তা নির্ধারণের কোনো উদ্যোগ কি নেয়া হয়েছে?
পাশাপাশি ট্রাম্পের অভিবাসীবিরোধী মনোভাব, জাতিসংঘের শান্তি মিশনের বাজেট কমানো, পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ির মতো বিষয়গুলোতেও বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা দেখতে হবে৷
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ৷ একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য একটি দেশের ক্ষতি করবেন, এমন ভাবনা পুরোপুরি অমূলক৷ তাদের কাজের ধরণের মধ্যে এটা পড়ে না এবং একজন প্রেসিডেন্ট স্বেচ্ছাচারী হয়ে এ রকম কিছু করতে গেলে নিজের দেশেই সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়বেন৷ তাই শুধুমাত্র হিলারি ক্লিনটনকে অপছন্দ করি বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানানোটা সঠিক হবে না বলে আমি মনে করি৷ বরং ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে দেশের লাভ-ক্ষতি হিসেব করে সমর্থন বা বিরোধিতা করলেই মঙ্গল৷