বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ডাকা অবরোধে জনজীবন অচল হয়ে পড়েছে৷ আতঙ্কে কাটছে সাধারণ জনগণের দিন৷ এই অস্থিরতা মানুষের মনে যে প্রভাব ফেলেছে তাই উঠে এসেছে ব্লগ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তিন দিনের অনশনে বসেছেন মুক্তিযোদ্ধারা৷ ১৯৭১ সালে যে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তাঁরা, সে দেশকে এমন ধ্বংস হতে দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি, নেমেছেন প্রতিবাদে৷
সামহয়্যার ইন ব্লগে আলম সিদ্দিকী সাধারণ মানুষের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘‘একটা কিছু করো৷'' তাঁর কথা, ‘‘পাঁচ বছর আগে একটি দলের দুর্নীতি ও অপশাসন রুখে দিতে আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে ডিজিটাল হয়েছিলাম৷ পাঁচ বছর পরে এসে যে-কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকা এবং যে-কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অপকৌশলকে রুখে দিতে আমরা কী করতে পারি? বন্ধুরা, ঘরে বসে থেকো না৷ একটা কিছু করো৷''
একই ব্লগে সাদমান সাদিক সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি কিন্তু ১৯৭১ সালের চেয়ে কম নয়৷ প্রতিদিনই মানুষ খুন হচ্ছে, চোখের সামনে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷ এরা তো মাত্র দুজন, আর আমরা ১৬ কোটি মানুষ৷ কেন এদের অত্যাচারের কাছে আমরা মাথানত করব?...এভাবে চলতে দেয়া যায় না, আমাদের দেশকে আমাদেরই রক্ষা করতে হবে৷ চলুন সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলি৷''
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
আমারব্লগে অরীত্র আহমেদ লিখেছেন, বেগম খালেদা জিয়া, আমরা বাঁচতে চাই৷
‘‘ম্যাডাম, আপনি একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী, আপনার হাজারটা কাজ, হাজারটা অ্যাজেন্ডা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়৷ নির্বাচন, দলের ম্যানেজমেন্ট, নিয়ন্ত্রণ, মিটিং মিছিল সহ বহু কিছু৷ আপনি পত্রিকা পড়েন নিশ্চয়ই? দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজের মধ্যে টেলিভিশনও দেখেন নিশ্চয়... তাহলে নিশ্চয় চোখে পড়েছে আপনার, মানুষ পুড়ছে, মানুষ জ্বলছে....''
একই ব্লগে মাহবুবুল আলম লিখেছেন, ‘‘গর্জে ওঠো দ্যাশের মানুষ আরো একবার৷'' তিনি বলছেন, বিরোধী দল অব্যাহত অবরোধের নামে যেভাবে নাশকতা আর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের সহ্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে৷ তাদের ডাকা এ অনৈতিক রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে নাশকতা ও পৈশাচিকতার শিকার হচ্ছে দেশের একেবারে প্রান্তিক খেটে খাওয়া ও সাধারণ মানুষ৷
তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘এই অশুভ চক্রের অবরোধ-হরতালকারীদের হাতে আর মার খেতে পারে না বাংলার মানুষ৷ জনগণই মূল শক্তি, যেখানেই আগুন, ভ্যান্ডালিজম ও নাশকতা, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সবাইকে...তাই এই বীর বাঙালি অবরোধকারীদের হীন কৌশলে পরাজিত হতে পারে না৷ এখনি ‘একাত্তরের চেতনায় গর্জে ওঠো বাংলাদেশ' এই স্লোগানে বলিয়ান হয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এই অশুভ শক্তির হাত থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করতে৷''