৭৬ বছর বয়সে কেমব্রিজে নিজের বাড়িতে জীবনাবসান হলো বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের৷ বিশ্ব হারালো সমকালীন বিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রকে৷
বিজ্ঞাপন
একুশ শতকের বিশ্বে তিনি সত্যিই ছিলেন এক বিস্ময়৷ কাজে, যাপনে, ভাবনায় এবং বেঁচে থাকায়৷ ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যু হলো বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের৷ কেমব্রিজে নিজের বাড়িতেই জীবনাবসান হয় তাঁর৷ তাঁর সন্তানেরা একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে স্টিফেনের৷ তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বহু বিশিষ্ট মানুষ শ্রদ্ধজ্ঞাপন করেন৷ টুইটকরেন স্বনামধন্য মহাকাশ গবেষকেরা৷
১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ডে জন্ম হয় এই ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর৷ ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের প্রতি তাঁর অমোঘ টান৷ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শুরু করেন হকিং৷ বিষয় ছিল পদার্থ বিজ্ঞান৷ কিন্তু তাঁর সে সময়ের শিক্ষক বার্মেন জানিয়েছেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হকিং পড়াশোনার ইচ্ছে হারান৷ কারণ, হকিংয়ের মনে হচ্ছিল, যা তিনি পড়ছেন তা খুবই সহজ৷ বিশেষ মনোগ্রাহীও নয়৷ তবে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বর্ষে গিয়ে বিষয়ের প্রতি খানিকটা উৎসাহ ফিরে পান তিনি৷ তবে ক্লাসে সবচেয়ে মিশুক ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হকিং৷ গান বাজনা, খেলাধুলো সবেই তাঁর উৎসাহ ছিল৷
কালের বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং
কৃষ্ণগহ্বর ও আপেক্ষিকতা নিয়ে তাঁর গবেষণার জন্য বিজ্ঞানে অমর হয়ে থাকবেন স্টিফেন হকিং৷ তাঁর জীবন ও কাজের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো এই ছবিঘরে৷
কে ছিলেন তিনি?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে হকিংয়ের জন্ম৷ বাবা ফ্র্যাংক ও মা ইসোবেল হকিং দু’জনেই ছিলেন গবেষক৷ উত্তর লন্ডনে ছিল তাঁদের নিবাস৷ কিন্তু তখন লন্ডনে বোমাবর্ষণ হবার কারণে স্টিফেনকে নিরাপদে জন্ম দেবার জন্য অক্সফোর্ডে চলে যান ফ্র্যাংক ও ইসোবেল৷ সেখানেই ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্ম নেন কালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হকিং৷
মন বসে না স্কুলের পড়ায়
শিক্ষাজীবনের শুরুতে ছাত্র হিসেবে খুব একটা নাম ছিল না তাঁর৷ ক্লাসে শেষের দিক থেকে তৃতীয় ছিলেন৷ বোর্ড গেম পছন্দ ছিল৷ পড়া বাদ দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে বরং কয়েকটি বোর্ড গেম তৈরি করেন৷ গণিতে অবশ্য ছিল ব্যাপক আগ্রহ৷ টিনএজ বয়সে ফেলে দেয়া জিনিসপত্র দিয়ে একটি কম্পিউটার তৈরি করেন, যা দিয়ে গণিতের প্রাথমিক সমস্যাগুলো সমাধান করা যেতো৷
ছবি: AP
কেমব্রিজের জীবন
১৯৬৮ সালে হকিং কেমব্রিজের মহাকাশবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের সদস্য হন৷ এরপরের কয়েকবছর তাঁর ও তাঁর গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ ১৯৭৩ সালে তিনি তাঁর প্রথম গবেষণা গ্রন্থ ‘দ্য লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অফ স্পেস-টাইম’ প্রকাশ করেন৷ ১৯৭৯ সালে ফিরে আসেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তাঁকে গনিতের সবচেয়ে সম্মানিত পদ ‘লুকাসিয়ান প্রফেসর অফ ম্যাথমেটিক্স’ উপাধি দেয়া হয়৷
ছবি: REUTERS
গণিত পড়ার সুযোগ পাননি
১৭ বছর বয়সে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়ার সুযোগ পেলেও পছন্দের বিষয় গণিতে তাঁকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ৷ তাই পদার্থবিদ্যাতেই ঝুঁকে পড়েন হকিং৷ আরো নির্দিষ্ট করে বললে, মহাকাশবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ ১৯৬২ সালে শুরু হয় তাঁর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন৷ পিএইচডি শুরু করেন মহাকাশতত্ত্বে৷
আ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইম
হকিংয়ের প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটি হলো ‘আ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইম’৷ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে৷ বইটিতে তিনি মহাকাশ, কাল, ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও কালের ভবিষ্যৎ নিয়ে সার্বিক এক চিত্র তুলে ধরেন৷ প্রকাশিত হবার পর বইটি ব্যাপক সাড়া ফেলে৷ চার বছরেরও বেশি সময় লন্ডন টাইমসের সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় শীর্ষস্থানটি ধরে রাখে বইটি৷ এ পর্যন্ত অন্তত ৪০টি ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Zaklin
অন্যান্য বই
হকিংয়ের অন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো হলো ‘দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’ (২০০১), ‘আ ব্রিফার হিস্টোরি অফ টাইম’ (২০০৫) এবং ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ (২০১০)৷ প্রথম তিনটি বইয়ে একত্রে মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হলো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance
ঈশ্বরের অস্তিত্ব
হকিংয়ের তত্ত্বের একটি বিশেষ দিক হলো, তিনি মনে করতেন যে সৃষ্টিকর্তা এই বিশ্ব তৈরি করেছেন৷ মহাকাশ বিজ্ঞানের সঙ্গে একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্ভব বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ গ্রন্থে তিনি নিজের তত্ত্বেরই বিরোধিতা করেন৷
ছবি: youtube.com/Monty Python
হকিংয়ের রোগ
২১ বছর বয়সেই হকিংয়ের জটিল এক রোগ ধরা পড়ে৷ রোগের নাম অ্যামিয়োট্রফিক ল্যাটারাল ক্লেরোসিস৷ সহজ ভাষায়, যেসব স্নায়ু মানুষের মাংসপেশি নিয়ন্ত্রণ করে তা আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া৷ সারাজীবন তিনি এই রোগে ভোগেন৷
ছবি: picture-alliance/D.Parry
পরিবার
হকিং চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় ছিলেন৷ দু’টি বিয়ে করেন তিনি৷ প্রথম স্ত্রী জেন হকিংয়ের সঙ্গে ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে তিন সন্তান জন্ম দেন৷ ১৯৯৫ সালে এ বিয়ে ভেঙে যায়৷ পরে নার্স এলাইন মেসনকে বিয়ে করেন হকিং৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F.Arrizabalaga
হলিউডে হকিং
হলিউডে তাঁকে নিয়ে আরো কাজ হলেও ২০১৪ সালের নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য থিওরি অফ এভরিথিং’ ছবিটি এখন পর্যন্ত তাঁর জীবন নিয়ে নির্মিত সেরা ছবি৷ ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়৷
ছবি: Focus Features/Liam Daniel
মৃত্যু
অবশেষে রোগের সঙ্গে হকিংয়ের যুদ্ধ সাঙ্গ হয় ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ৷ কালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী মারা যান ৭৬ বছর বয়সে৷
ছবি: picture-alliance/abaca/A. Abd Rabbo
11 ছবি1 | 11
জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন হকিং৷ এবং ঠিক সেই সময়েই মাত্র ২১ বছর বয়সে ধরা পড়ে ভয়াবহ অসুখ মোটর নিউরোন৷স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়েন হকিং৷ দীর্ঘদিন অবসাদের শিকারও ছিলেন৷ পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই এই রোগ হয়৷ যাঁদের হয়, তাঁদের মাত্র ১০ শতাংশ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন৷ হকিং সেই বিরল ব্যক্তিত্ব ভয়ানক রোগটিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কেবল বেঁচেই ছিলেন না, গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন৷ এই সময়ের মহাকাশ বিজ্ঞানের সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ ব্ল্যাকহোল নিয়ে নিজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং নিজেই সেই তত্ত্ব খণ্ডন করেছেন৷
‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম'৷ স্টিফেন হকিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব৷ সেখানে সাধারণভাবে দু'রকমের সময় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন৷ ব্যবহারিক সময় এবং মহাজাগতিক সময়৷ রিলেটিভিটি নিয়ে সম সময়ে এত বড় গবেষণা আর কেউ করেননি৷ শুধু তাই নয়, স্টিফেন বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান কেবল মুষ্টিমেয় গবেষকের আলোচনার বিষয় নয়৷ সকলের কাছে বিজ্ঞানের আলোচনা পৌঁছে দেওয়া দরকার৷ এবং সে কারণেই সহজ ভাষায় মহাকাশ, সময় এবং ব্ল্যাকহোল নিয়ে তিনি বই লিখেছেন৷ যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন আলোচনাসভায়৷ সহজ করে বুঝিয়েছেন বিজ্ঞান৷
বছরকয়েক আগে হকিং আচমকাই ঘোষণা করেন, সময় এবং ব্ল্যাকহোল নিয়ে তাঁর আগের গবেষণায় অনেক ভুল আছে৷ ভুল সংশোধনের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি৷ নিজেকেই নিজে ভুল প্রমাণ করে সকলকে বিস্মিত করেছিলেন হকিং৷ কারণ, অ্যাকাডেমিক বিশ্বে খুব কম মানুষই এমন কাজ করতে পেরেছেন৷
বহু বিস্ময়ের অবসান ঘটিয়েছেন হকিং৷ বহু বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ এমনকি, বিস্মিত করেছেন ঈশ্বর নিয়ে তাঁর ভাবনায়৷ হয়তো মৃত্যু হলো বিজ্ঞানীর৷ কিন্তু তাঁর প্রশ্ন, তাঁর বিস্ময় নিয়ে আগামী বহু বছর কাজ করতে হবে বিশ্বকে৷ চিরস্মরণীয় হয়ে সকলের মধ্যে বেঁচে থাকবেন স্টিফেন হকিং৷
এসজি/এসিবি
মহাকাশে প্রথম মানুষ থেকে প্রথম ফুল
মহাকাশে মানুষের যাওয়া একটা সময় অকল্পনীয়ই ছিল৷ কুকুর পাঠিয়ে স্বপ্নযাত্রার সোপান তৈরি হলো৷ প্রথম মানুষ হিসেবে ইউরি গ্যাগারিন গেলেন৷ তারপর প্রথম নারী, প্রথম ফুল হয়ে এবার শুরু হলো মহাকাশে প্রথম টমেটো দেখার অপেক্ষা৷
ছবি: Colourbox/M. Bell
সবার আগে ফলের মাছি
মহাকাশে প্রথম প্রাণী ফলের মাছি৷ হ্যাঁ, ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিকিরণের প্রভাব পরীক্ষা করার জন্য ভি-টু রকেটে মানুষ না পাঠিয়ে এক ধরণের মাছিই পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ দু’বছর পর শুরু হয় বানর পাঠানো৷ ঊনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ইঁদুর এবং কুকুরও পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷
তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন, অর্থাৎ আজকের রাশিয়াও মহাকাশে পরীক্ষামূলকভাবে প্রাণী পাঠিয়েছে বেশ কয়েকবার৷ তবে ১৯৫১ সালে প্রথম তাদের পাঠানো দু’টি কুকুর মহাকাশ থেকে জীবিত ফেরে৷ তবে কোনো প্রাণীই মহাকাশে গিয়ে অরবিট প্রদক্ষিণ করেনি৷ ১৯৫৭ সালে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নেরই আরেক কুকুর লাইকা৷ লাইকা অরবিট থেকে ফেরায় মানুষেরও মহাকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন জাগে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রথম মানুষ ইউরি গ্যাগারিন
মহাকাশ ঘুরে আসা প্রথম মানুষ ইউরি গ্যাগারিন৷ ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভস্টক নভোযানে চড়ে পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে আসেন তিনি৷ ছবিতে স্ত্রী এবং সন্তানের সঙ্গে আনন্দঘন মুহূর্তে ইউরি গ্যাগারিন৷
ছবি: AFP/Getty Images
মহাকাশে প্রথম নারী
মহাকাশে প্রথম নারী পাঠাতেও দেরি করেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ ১৯৬১ সালেই ৪০০ আবেদন থেকে বেছে নেয়া হয় ভ্যালেন্টিনা টেরেশকোভাকে৷ ভস্টক চালিয়ে মহাকাশে গিয়ে ভেলেন্টিনা টেরেশকোভা সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থাতেই ফিরেছিলেন নিজের দেশে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রথম ফুল
কয়েকদিন আগেই পাওয়া গেছে মজার এক খবর৷ মহাকাশে এবার ফুল ফুটেছে৷ জিনিয়া ফুল৷ মহাকাশে মাটিই নেই৷ তারপরও সেখানে ফুল ফোটানো কিন্তু মহাবিস্ময়েরই ব্যাপার৷ নাসার নভোচারীরা এবার তা-ও সম্ভব করেছেন৷ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র (আইএসএস)-এর নভোচারী স্কট কেলি টুইটারে একটি জিনিয়া ফুলের ছবি পোস্ট করে জানিয়েছেন, এটা মহাকাশে প্রথম ফোটা ফুল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
তারপর টমেটো?
নভোচারীরা ধীরে ধীরে মহাকাশে খাদ্যশস্য ফলানোর দিকে এগিয়ে যেতে চান৷ সেই লক্ষ্যের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই আসলে জিনিয়া ফোটানো৷ ইতিমধ্যে খুব ছোট আঙ্গিকে লেটুস চাষের চেষ্টা শুরু হয়েছে৷ খুব শিগগির নাকি তাজা টমেটোও দেখা যাবে মহাকাশে!