মহাকাশের গভীরে পাড়ি দিতে গেলে চাঁদ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হয়ে উঠতে পারে৷ কিন্তু সেখানে মানুষের বসবাস সম্ভব করতে হলে চাই অক্সিজেন ও পানি৷ চাঁদেরই উপাদান থেকে সে সব সংগ্রহের লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
চাঁদের মাটির উপর পরীক্ষা চালাতে রোবট কাজে লাগানো হবে৷ যেমন ‘স্পেস ক্লাইম্বার'৷ জার্মানির ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স' গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এই ‘মহাকাশ মাকড়সা' তৈরি করেছেন৷ উদ্দেশ্য, রোবট যাতে মোটামুটি স্বাধীনভাবে অসমান মাটির উপরও চলাফেরা করতে পারে৷ এমনকি চাঁদের গর্তে নেমে নমুনা সংগ্রহ করে শক্ত হাতের সাহায্যে আবার উঠে আসতে পারবে এই রোবট৷
এই গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক ফ্রাংক কিয়ার্শনর বলেন, ‘‘এতে ২৫টি মোটর রয়েছে৷ চাকাওলা যান হলে ৬টা থাকতো৷ অর্থাৎ কোনো কিছু খারাপ হওয়ার আশঙ্কাও প্রায় ৪ গুণ বেশি৷ অতএব কোথাও একটা আপোশ করতে হবে৷ একদিকে যানটি স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করতে পারবে, অন্যদিকে কোনো কিছু বিকল হবার আশঙ্কাও বেড়ে যায়৷ এমন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, এটা কতটা নিরাপদ করে তোলা সম্ভব৷''
মহাশূন্যে হাত বাড়াচ্ছে ইউরোপ
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
তারা থেকে তারায়
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷ ক্যাপসুলটি প্রথমে চন্দ্র প্রদক্ষিণ করবে৷ তারপর মহাশূন্যে অবস্থান নেবে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু হিসেবে৷ হয়তো মঙ্গলগ্রহ যাত্রার পথে তা কাজে লাগবে৷
ছবি: ESA-D. Ducros, 2012
মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় অভ্যস্ত হওয়া
প্রথমে ইউরোপের নভচারীদের পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস’এ যাত্রা করার পালা৷ এসা’র অ্যাস্ট্রোনট ইটালির লুকা পার্মিতানো একটি জলের চৌবাচ্চায় স্পেস ওয়াক অভ্যেস করছেন৷ স্থান: কোলোনের কাছে ইউরোপীয় নভচারী কেন্দ্র (ইএসি)৷
ছবি: ESA/H. Rueb, 2010
আইএসএস’র জন্য তিন ইউরোপীয় নভশ্চর
লুকা পার্মিতানো আইএসএস’এ থাকবেন এ’বছরের মে মাস থেকে নভেম্বর মাস অবধি৷ ২০১৪ সালে এ’ভাবেই যাবেন জার্মানির আলেক্সান্ডার গের্স্ট৷ তারপরে যাবেন একজন মহিলা, ইটালির সামান্থা ক্রিস্টোফোরেত্তি৷
ছবি: dapd/NASA
মানুষের বদলে মাল পরিবহণ
তিন ইউরোপীয় নভশ্চর আইএসএস’এ যাবেন রুশ সোয়ুজ রকেটে চড়ে৷ এসা ইতিমধ্যে তথাকথিত অটোম্যাটিক ট্রান্সফার ভেহিকেল বা এটিভি’র মাধ্যমে আইএসএস’এ মালপত্র পাঠায়৷ পরের যাত্রা আগামী ১৮ই এপ্রিল৷ এটিভি’তে সাত টন খাদ্য ও সরঞ্জাম পাঠানো যায়৷
ছবি: ESA/S.Corvaja/dapd
চন্দ্রবাসের স্বপ্ন
চন্দ্রপীষ্ঠে এ’ধরনের একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন থেকে এসা এখনও অনেক দূর৷ সেখানে জন পাওয়া গেলে, তা’তে চাঁদের ধুলো মিশিয়ে বাড়িঘর তৈরি করা যেতে পারে৷ এবং চাঁদে জল আছে কিনা, চীনের চাঙ-ই ৩ রোভার চন্দ্রযান তা এ’বছরেই জানতে পারবে৷ চন্দ্রে অবতরণের পর এসা ঐ রোভারে তথ্য পাঠানোর ভার নেবে এবং তার গতিবিধি পরিচালনা করবে৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
ডার্মস্টাট থেকে স্যাটেলাইট পরিচালনা
এসা’র ইউরোপীয় মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা এসক থেকে চাঙ-ই ৩’এর আগের চীনা মহাকাশযানগুলিতে তথ্য পাঠানোয় সাহায্য করা হয়েছিল৷ চীনের আগের মহাকাশযানগুলি চন্দ্র প্রদক্ষিণ করেছে কিন্তু চন্দ্রপীষ্ঠে অবতরণ করেনি৷ এসক থেকে অপরাপর বহু গবেষণা ও যোগাযোগ সংক্রান্ত স্যাটেলাইটের যাত্রার উপর নজর রাখা হয়৷
ছবি: ESA - J. Mai
থ্রি-ডি’তে আমাদের ছায়াপথ
এ’বছরের অক্টোবর মাসে স্পেস প্রোব বা মহাশূন্য অভিযাত্রী যান ‘গাইয়া’ তার যাত্রা শুরু করবে৷ ইন্টারোফেরোমিটারের সাহায্যে আলোকতরঙ্গ থেকে আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জের একটি থ্রি-ডি ছবি তৈরি করবে এবং ‘মিল্কি ওয়ে’ ছায়াপথের অনেক রহস্য উদঘাটন করবে৷ এসা’র গবেষকরা অন্তত এক বিলিয়ন নতুন তারা আবিষ্কার করার আশা করছেন৷ এমনকি তিন বিলিয়নও হতে পারে৷
ছবি: ESA/Medialab
গ্রহাণুর সন্ধানে
রোজেট্টা স্পেস প্রোব’টি ২০০৪ সাল যাবৎ ৬৭/পি চুরজুমভ-গেরাসিমেঙ্কো ধূমকেতু অভিমুখে যাত্রা করছে৷ ২০১৪ সালের সূচনায় মহাকাশযানটি ধূমকেতুটির কক্ষপথে যোগদান করবে৷ তবে ধূমকেতু অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে রোজেট্টা অনেক কিছু দেখবে: নাসা’র ডিপ ইমপ্যাক্ট প্রোজেক্টাইলটি কিভাবে টেম্পল ওয়ান ধূমকেতুতে আঘাত করবে৷ এচাড়া রোজেট্টা দেখবে মঙ্গলগ্রহ এবং স্টাইনস ও লুটেশিয়া নামের দ’টি অ্যাস্টেরয়েড বা গ্রহাণু৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধূমকেতুর উপর অবতরণ
২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে রোজেট্টা ফিলি নামের এই রোবোটটিকে ধূমকেতুর উপরে নামাবে৷ কোলোনে অবস্থিত জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্র ডিএলআর থেকে সেই অবতরণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে৷ কাজটা শক্ত হবে, কেনান ধূমকেতুটির মাধ্যাকর্ষণ খুব বেশি নয়৷ রোজ্ট্টা ধূমকেতুটির রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করবে৷
ছবি: ESA/AOES Medialab
স্যাটেলাইটের রিসাইক্লিং সম্ভব নয়
অর্ধশতাব্দী ধরে মহাকাশে রকেট ও স্যাটেলাইট পাঠানো হচ্ছে৷ এক সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় প্রায় ছ’লাখ নানা ধরনের ও আকারের স্ক্র্যাপ এ’ভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে৷ এসা চাপ দিচ্ছে মহাশূন্যে আবর্জনা কমানোর জন্য: অকেজো স্যাটেলাইটগুলোকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রিতভাবে ভূপাতিত করতে হবে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
চাঁদের ভার্চুয়াল সারফেসের উপর গবেষকরা রোবটকে আরও প্রস্তুত করে তুলছেন৷ যেমন স্পেস ক্লাইম্বার-এর পা কতটা লম্বা হবে, শরীরের কোথায় তা লাগানো হবে – তা পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ উদ্দেশ্য, সে যাতে পড়ে না গিয়ে বাধা অতিক্রম করতে পারে৷ এর জন্য এমন সফটওয়্যার তৈরি করা হচ্ছে, যা পরিস্থিতি বিচার করে তা থেকে নিজেই শিখে নিতে পারে৷ যা সত্যি কাজ করবে, শেষ পর্যন্ত সেটাই গড়ে তোলা হবে৷
তবে রোবট তো আর মানুষ নয়৷ তাই জল পান করার প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু চাঁদে মানুষের ঘাঁটি তৈরি করতে হলে পানি ছাড়া চলবে না৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের অধ্যাপক রাল্ফ ইয়াউমান বলেন, ‘‘চাঁদে পানির ব্যবস্থা করা সম্ভব৷ সৌর বাতাস থেকে হাইড্রোজেন পাওয়া যায়, যা ধুলিকণায় লেগে থাকে৷ পাথরের মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন৷ হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দিয়েই পানি তৈরি হয়৷''
অ্যারিজোনার এক আগ্নেয়গিরির গহ্বর থেকে এসেছে এই ধূসর পাউডার৷ মিউনিখের গবেষকরা তা দিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷ তার রাসায়নিক গঠন ও কণার মাপ চাঁদের ধূলিকণার মতো৷ ‘অ্যাপোলো ১৪'-র নভোচারীরা সেই নমুনা পৃথিবীতে এনেছিলেন৷ বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন হলো – হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন – ধুলিকণার এ সব উপাদানগুলিকে আলাদা করা৷ তার মধ্যে ধাতুও রয়েছে৷ হাতেনাতে সেই প্রক্রিয়া দেখানোও হচ্ছে৷
মহাশূ্ন্যে বানর পাঠিয়ে ধাপ্পাবাজি?
ইরানের নিজস্ব বিবৃতি অনুযায়ী, সেদেশ ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি একটি বানরকে যাত্রী করে মহাশূন্যে রকেট পাঠিয়েছে এবং সেটিকে আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফেরত নিয়ে এসেছে৷ কিন্তু ব্যাপারটায় একটা গোলমাল আছে৷
ছবি: Isna
যাত্রা শুরুর অপেক্ষায়
‘কাওয়শগর’ ক্যাপসুলটি একটি অপরিচিত স্থানে ভ্রাম্যমাণ লঞ্চ-প্যাডে দাঁড়িয়ে, যাত্রা শুরুর অপেক্ষায়৷ যাত্রী হিসেবে একটি বানরের ভিতরে থাকার কথা৷
ছবি: Irna
চুপচাপ বসো...
যাত্রা শুরুর আগে বানরযাত্রীর ছবি৷ তার নাম রাখা হয়েছে আফতাব বা সূর্য৷
ছবি: Irna
এবার সামলে
নভোচারীর পোশাকে আফতাব৷ বেঁধেছেদে রাখায় তাকে খুব খুশি দেখানোর কথা নয়৷ ডান চোখের উপর আঁচিল কিংবা জরুলটা খেয়াল করবেন৷
বানরযাত্রীর কি অবস্থা?
২৮শে জানুয়ারি ইরানের সংবাদ সংস্থাগুলি মহাকাশযানের সফল যাত্রা শুরুর খবর দেয়৷
ছবি: Irna
বানর নভোচারীর ধরায় প্রত্যাবর্তন
মহাশূন্যে ১৬ মিনিটের যাত্রার পর আফতাব বহাল তবিয়তে ধরাধামে প্রত্যাবর্তন করেছে, বলে ইরানি সংবাদ সংস্থাগুলি জানায়৷ ইরানের মহাকাশ অভিযান কর্তৃপক্ষ একটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন, যেখানে আফতাব নাকি সাংবাদিকদের হাসির খোরাক জুটিয়েছে, বলে সরকারি ইসনা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে৷
ছবি: Isna
ধকলের কোনো লক্ষণ নেই আফতাবের
অতো বড় মহাকাশযাত্রার পরেও আফতাব টপ ফর্মে, সেটা কি করে সম্ভব? বানর নভোচারীকে একটু ভালো করে দেখা দরকার...
ছবি: Isna
বদলে গেছে আফতাব!
সত্যিই, মহাকাশযাত্রার ফলে যেন আফতাবের বয়স কমে গেছে৷ ডানচোখের ওপর জরুলটা উধাও হয়েছে৷ গোঁফদাড়ি আগে সাদাটে ছিল, এখন ঘন বাদামি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
এমন একটি ‘আশ্চর্য’ সাফল্য
ইরানের মহাকাশযাত্রা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান মোহাম্মেদ ইব্রাহিমি (ডানদিকে; বাঁয়ে রয়েছেন হামিদ ফাজেলি, মহাকাশযাত্রা কর্তৃপক্ষের প্রধান) যেন নিজেই সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না...
ছবি: Isna
8 ছবি1 | 8
পাথর গরম করলে তা থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন বেরিয়ে আসে৷ অর্থাৎ তা দিয়ে পানি তৈরি করা যেতে পারে৷ তবে এমন যন্ত্র এখনো তৈরি হয় নি৷ মিউনিখের টেকনিকাল ইউনিভার্সিটির মাটিয়াস ফাইফার বলেন, ‘‘এক লিটার পানি বের করা সহজ নয়৷ যেমন বিষুবরেখার আশেপাশের অঞ্চলে প্রায় এক টন সূক্ষ্ম ছেঁকে নেয়া ধুলিকণা গরম করলে, তা থেকে মাত্র এক কিলো পানি পাওয়া যেতে পারে৷''
ব্যাপারটা এমন হবে৷ ঘাস কাটার যন্ত্রের মতো দেখতে বিশেষ ধরনের যান চাঁদের ধুলা জমা করবে৷ তারপর সেই ধুলা ছেঁকে নিয়ে চুল্লিতে ঢালা হবে৷ সেখানে ততক্ষণ ধরে ধুলা গরম করা হবে, যতক্ষণ না হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সহ অন্যান্য উপাদান বেরিয়ে না আসে৷ সেই গ্যাস সঙ্গে সঙ্গে চুল্লির মধ্যে পানি ও জ্বালানিতে রূপান্তরিত করে ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ অধ্যাপক ইয়াউমান বলেন, ‘‘চাঁদকে আসলে আলাদা এক মহাদেশ, পৃথিবীর এক সম্পূর্ণ অচেনা মহাদেশ হিসেবে দেখা চলে৷ দশ বা বিশ বছরে না হলেও ৫০ বছরের মধ্যে চাঁদে গবেষণাগার তৈরি হবে – আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত৷''
একশো বছর আগে কুমেরু অঞ্চল যেমন মানুষের কাছে রহস্যময় ছিল, আজ চাঁদের ক্ষেত্রে তা বলা চলে৷ এক সময় চাঁদও আর অচেনা থাকবে না৷