1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চাই সুরক্ষা আইন, মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা নয়

হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা১২ অক্টোবর ২০১৪

টাঙ্গাইলে মা ও তিন মেয়েকে পুড়িয়ে হত্যার নৃশংস ঘটনা আবারো মনে করিয়ে দিল এই সমাজে নারী কতটা বিপদ আর বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে৷ কঠোর আইন, সভা-সমাবেশ বা নানা দিবস পালনেও তাদের নিরাপত্তা এবং বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না৷

Frauen Textilarbeiterinnen Näherinnen Bangaldesch Gewandnäherinnen
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও খবর অনুযায়ী এই চার নারী-শিশুকে হত্যা করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে৷ প্রবাসী জাহাঙ্গীর আলম নবম শ্রেণির ছাত্রী মনিরাকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়ে মনিরাসহ তার তিন বোন এবং মাকে পুড়িয়ে হত্যা করে৷ ঈদুল আজহার দিন রাতে তাদের সোহাগপাড়া গ্রামের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়৷ সেই আগুনে পুড়ে নিহত হন হাসনা বেগম এবং তাঁর তিন মেয়ে সোহাগপুর উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনিরা আক্তার, বাকপ্রতিবন্ধী মীম আক্তার ও স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলের নার্সারির শিক্ষার্থী মলি আক্তার৷ তাদের বাবা মালয়েশিয়া প্রবাসী মজিবর রহমান৷

নেপথ্যে আরো অনেক ঘটনা

এবার আমরা যদি এই ঘটনার একটু নেপথ্যে যাই তাহলে ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে আসবে৷ মনিরার বয়স যখন সাত বছর, তখন জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে তার বিয়ের কথা হয়৷ দুজনের মধ্যে আংটিও বদল হয়৷ দেড় বছর আগে জাহাঙ্গীর বিদেশে থাকাকালে মনিরা গ্রামের একটি গানের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়৷ সে খবর পেয়ে জাহাঙ্গীর সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে বকাঝকা করেন৷ এ ঘটনায় বিয়ে দেয়া ভেস্তে যায়৷ ১০ মাস আগে জাহাঙ্গীর দেশে ফিরলে গ্রাম্য সালিশ বসে৷ এতে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে মনিরার বিয়ে না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়৷ এরপর জাহাঙ্গীর সিঙ্গাপুর গিয়ে দুই মাস পর আবার দেশে ফেরেন৷ আবারও মনিরাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন৷ কিন্তু মনিরার মা রাজি না হলে জাহাঙ্গীর পরিবারটির ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার শুরু করেন৷ হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহ খানেক আগে জাহাঙ্গীর মনিরার মায়ের গলাও চেপে ধরেন৷ জাহাঙ্গীর মনিরাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন৷ তাই মনিরাকে একই গ্রামে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ ঈদ উপলক্ষ্যে মনিরা বাড়িতে এসেছিল৷ আর সেই সুযোগ নেয় নরপশু জাহাঙ্গীর৷

ঘটনা বিশ্লেষণ

ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে পাঁচ ধরনের অপরাধের দেখা পাওয়া যায়৷ ১. বাল্যবিবাহ ২. চাপ দিয়ে বিয়েতে রাজি করানোর চেষ্টা ৩. রাজি না হওয়ায় হুমকি এবং নির্যাতন ৪. চাপের মুখে নিরাপত্তার জন্য কিশোরীর আবাসস্থল পরিবর্তন এবং ৫. হত্যাকাণ্ড৷

হত্যাকাণ্ড হলো নারীর প্রতি চূড়ান্ত সহিংসতা৷ কিন্তু তার আগে আরো চার ধরণের সহিংসতা ঘটেছে৷ মাত্র সাত বছর বয়সে একটি মেয়ে শিশুকে বিয়ে দেয়ার জন্য কেন প্রথমে কথা দিল তার পরিবার সেসব তথ্য স্পষ্ট নয়৷ তবে ধারণা করা যায় সিঙ্গাপুর প্রবাসী জাহাঙ্গীর তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণেই আংটি বদল করাতে পেরেছেন৷ এখানে মনিরার বাবার প্রবাসে থাকাও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ আর ঘটনাক্রমে সেই আংটিবদল যখন টেকেনি তখনই জাহাঙ্গীর ভয়ংকর হয়ে ওঠেন৷ গ্রাম্য শালিসেই বিয়ের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে৷ তারপরও জাহাঙ্গীর যখন জোরজবরদস্তি করছিলেন তখন শালিসদাররা কেন মনিরা এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি, কেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেননি৷ এরপর মনিরাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে, তাঁর মা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ তখনো কী আইনের কোনো সুরক্ষা তারা পাননি? নিশ্চয়ই পাননি৷ পেলেতো আর জাহাঙ্গীর মুক্ত বাতাসে থেকে পুরো পরিবারটিকে পুড়িয়ে হত্যা করতে পারত না৷

হারুন উর রশীদ স্বপনছবি: Harun Ur Rashid Swapan

টাঙ্গাইলের পুলিশ প্রশাসন এখনো জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করতে পারেনি৷ তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে৷ পুলিশের এই তৎপরতা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে৷ সেই পুরনো কাহিনি – ডাক্তার আসিবার আগেই রোগী মারা গেল৷ আর এই উদাহরণ এখন শত শত নয়, হাজার হাজার৷ হত্যাকাণ্ডের আগে আরো অন্তত চার ধরণের জঘণ্য অপরাধ জাহাঙ্গীর করলেও তাকে আইনের আওতায় তখন নেয়া হয়নি৷ মানে, নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করেনি আইন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা৷

আইন ও বাস্তবতা

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন কঠোর হয়েছে৷ হয়েছে ইভটিজিং বিরোধী আইন৷ ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ ২০১০ সালে ইভটিজিং বিরোধী আইনে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়৷ আর ভ্রাম্যমাণ আদালতকে শাস্তি কার্যকর করার ক্ষমতা দেয়া হয়৷

২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা-প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইনে অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাস এবং জরিমানা ১০ হাজার টাকা৷ তবে এই আইনের অপরাধ জামিনযোগ্য এবং আপোষযোগ্য৷ আর অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকার জরিমানার বিধান আছে৷ তার মানে হলো আইনেই মনে করা হয়েছে লঘু দণ্ডের কারণে একই অপরাধী আবার অপরাধ করতে পারে৷ তাহলে কেন এই লঘুদণ্ড? হত্যাকাণ্ডের আগেই কি অপরাধীকে নিবৃত্ত করার কোনো আইন করা যায় না?

আর নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন থাকলেও আলাদাভাবে সুরক্ষা আইন নেই৷ আইনে প্রতিরোধ শব্দটি থাকলেও এই প্রতিরোধ আগাম নয়৷ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর বিচারের মাধ্যমে নতুন করে অপরাধ প্রতিরোধের বিষয়টিই হয়তো বলা হয়েছে৷

কিন্তু আমরা যদি ভালো করে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব টাঙ্গাইলের পরিবারটি যদি হত্যাকাণ্ডের আগে কোনো এক পর্যায়ে আইনি সুরক্ষা পেত, তাহলে মা এবং তিন মেয়েকে জীবন দিতে হত না৷

গত ৯ মাসে সারাদেশে ৪,১৮৬টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ হাজার ১৬৬ জন নারী ও শিশু৷ ধর্ষণের পর হত্যা এবং আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৮৫০ টি৷

জাতীয় মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছ'মাসে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ এ সময়কালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে৷ এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন আরও ৫১ জন৷

আর এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে কঠোর আইনও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না৷ এর মধ্যে একটি কারণ হলো আইনের ফাঁক ফোকরের কারণে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না৷ আর সেজন্যই ‘ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্ট' নামে নতুন একটি আইনের দাবি আছে দীর্ঘদিন ধরে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনটির উদ্যোগ নিলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি৷ এছাড়া প্রয়োজন সুরক্ষা আইন৷ এই আইনের মাধ্যমে নারী ও শিশুর সহিংসতা বা অন্যকোন অপরাধের শিকার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেই তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কারণে ঘটবে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে শাস্তি দিতে হবে৷ নারীর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রচলিত আইন নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ