শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬-র প্যানেল বাতিল করার পর চরম হতাশায় যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।
সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন এক শিক্ষিকা। ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজ্ঞাপন
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট কৃষ্ণমৃত্তিকা নাথ। রাজ্যপালের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন তিনি। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬-র প্যানেল বাতিল করার পর কৃষ্ণমৃত্তিকাও ২৫ হাজার ৭৫২ জনের একজন যিনি চাকরি হারালেন। কৃষ্ণমৃত্তিকার বাড়িতে বয়স্ক বাবা মা তার উপর নির্ভরশীল। "আমি ইউনিভার্সিটি টপার। প্রথম কাউন্সিলিং-এ আমার চাকরি হয়। আর কী ভাবে আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করব?" এই প্রশ্ন ছুঁড়ে সংবাদ মাধ্যমের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
একা কৃষ্ণমৃত্তিকা নন। কারও সন্তান সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। কেউ বাড়ির একমাত্র চাকুরে। কারও ঘাড়ে ঋণের বোঝা। স্কুল সার্ভিস কমিশন 'চাল আর কাঁকড়' আলাদা করতে পারেনি। তার ফলে দুর্নীতির পাঁকে অযোগ্য পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গেই ডুবে গেলেন হাজার হাজার যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকারা, যারা সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় দিন রাত এক করে পরিশ্রম করেছেন। পরীক্ষায় বসেছেন এবং নিজেদের মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
'প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতির শিকার'
গোবরডাঙার দেবাশিস দাস অংকের শিক্ষক ছিলেন। ২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৃহস্পতিবারে আদালতের রায়ে চাকরি হারান দেবাশিস। বাড়িতে বয়স্ক বাবা, মা, স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলে। ডিডাব্লিউয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "চাকরি হারানোর ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অসম্মানও মেনে নিতে পারছি না।” তার কথায়, "কাল এই খবর আসার পর আমার স্ত্রী যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, তখন আমার ছেলে বার বার আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, মায়ের কী হয়েছে। আমি উত্তর দিতে পারিনি। এই প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতির দায় আমি বা আমার পরিবার কেন নেবে বলতে পারেন?"
দেবাশিস আরো বলেন, "যখন চাকরি শুরু করেছিলাম তখন ভালো শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ ছিল। যখন প্রায় প্রমাণ করতে পারলাম তখন চাকরি চলে গেল। এখন আমরা দিশাহারা। ছেলে বড় হচ্ছে। তার জন্য যেটুকু পরিকল্পনা করা ছিল আজ সব অনিশ্চিত। এসএসসি তথা সরকার যদি দুর্নীতি করে, তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হোক। আমরা কেন শাস্তি পাচ্ছি?"
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬ হাজার চাকরি বাতিল হওয়ার পর রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন চাকরিহারা শিক্ষক, রাজনীতির ময়দানের বিরোধী থেকে শুরু করে অনেকেই। দেখুন ছবিঘরে ....
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বলেছে সুপ্রিম কোর্ট?
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ভয়ংকর দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে। জালিয়াতি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টায় পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া কলুষিত হয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে দুর্নীতি হয়েছে। যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করা যাচ্ছে না। তাই পুরো প্যানেল বাতিল হবে। অযোগ্য বলে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিতদের বেতন ফেরত দিতে হবে। তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এই চাকরি নিয়ে
শিক্ষকদের এই চাকরি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। চাকরির পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া করেছে সরকারি সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি। সরকারি স্কুলের জন্য এই নিয়োগ হয়। সেখানে দুর্নীতি হলে সেই দায় স্বভাবতই রাজ্য সরকারের উপরই এসে পড়ে বলে দাবি করছেন চাকরিহারা শিক্ষক থেকে বিরোধী সকলেই। বিরোধীরা দাবি তুলেছেন, এর দায় মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কান্নায় ভেঙে পড়লেন তারা
সুপ্রিম কোর্টের রায় আসার আগে শহিদ মিনারের পাশে জড়ো হন শিক্ষকরা। উদ্বিগ্ন শিক্ষকরা সুপ্রিম কোর্টের রায় জানার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের যাবতীয় ক্ষোভ গিয়ে পড়ে রাজ্য সরকারের উপর। তাদের প্রশ্ন, কিছু মানুষ দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে বলে তাদের সকলের চাকরি গেল। এটা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'দুর্নীতি না করে শাস্তি পেলাম'
শাহনি নাজনিন ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''কোনো অন্য়ায় না করে, দুর্নীতি না করে শাস্তি পেলাম। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। দোষ প্রমাণ করুক। মাথা পেতে নেবো। এ কেমন বিচার না অন্য কিছু জানি না। কী করবো জানি না। মনে হচ্ছে, শেষ হয়ে গেছি। মানতে পারছি না। ছোট থেকে সততার সঙ্গে বড় হয়েছি। তার এই পরিণাম। চাকরি অর্জন করেছি, কাউকে ঘুষ দিইনি। তারপর এরকম হলো?''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'চাকরির পরীক্ষা দুর্নীতিমুক্ত করার দায় কার?'
ডিডাব্লিউকে রজত হালদার বলেছেন, ''আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যোগ্যদের জন্য চরমতম বিপর্যয়। আগামীতে যারা মেধার জোরে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেবেন, তারা ভাবুন। পরীক্ষা পদ্ধতির গলদ থাকলে ছয় বছর পর চাকরি যাবে। প্রশ্ন হলো, পরীক্ষা পদ্ধতি দুর্নীতিমুক্ত করার দায়িত্ব কার, পরীক্ষার্থীদের, সরকারের নাকি বিচারব্যবস্থার?''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'নিয়োগকারী সংস্থার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল'
ডিডাব্লিউর কাছে রিজিয়া খাতুনের প্রতিক্রিয়া, ''আমি ভাবতে পারছি না, এরকম হওয়া সম্ভব! কী করে বিনা দোষে কেউ এরকম শাস্তি পেতে পারে। কী করবো, তা এখনই বলতে পারছি না। আমাদের আশা ছিল, আমাদের জয় হবে। কোনো দুর্নীতি হলে নিয়োগকারী সংস্থার শাস্তি হওয়া উচিত, আমাদের সেই শাস্তি পেতে হবে?''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
স্কুল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে?
কোনো স্কুলে চারজন, কোনো স্কুলে আটজন, কোনো স্কুলে ছয়জন শিক্ষকের চাকরি গেলো। বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকারা জানিয়েছেন, তাদের স্কুল চালানো মুশকিল হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশ্ন উঠছে, যোগ্য শিক্ষকরা যে অসম্ভব মানসিক চাপের মধ্যে পড়বেন, সকলে তাদের দিকে সন্দেহের চোখে দেখবেন, সেই ক্ষতি কে পূরণ করবে?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ''বিচারব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ সম্মান আছে। তা সত্ত্বেও রায় মানতে পারছি না। একজনের অপরাধে কতজনের শাস্তি হবে? স্কুল সার্ভিস কমিশন স্বশাসিত সংস্থা। আমরা কখনো হস্তক্ষেপ করি না। আর কতদিন বাংলাকে টার্গেট করবেন? কোর্টের রায় মেনে এসএসসি ততিন মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করবে। আরো এক লাখ শিক্ষকের নিয়োগ দেবো। এটা বিজেপি, সিপিএম করিয়েছে।''
ছবি: Prabhakar Tewari/DW
মমতার প্রস্তাব
মমতা বন্দ্যোাপাধ্যায় বলেছেন, ''যারা চাকরি হারিয়েছেন, তারা একটা সংগঠন তৈরি করেছেন। তারা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম বুক করেছেন। আমরা সাত তারিখ তাদের সম্মেলনে সেখানে যাবো। মুখ্যসচিব ও অন্য জ্ঞানী-গুণীরা যাবেন। আপনারা সকলে আবেদন করুন। আমরা চেষ্টা করবো। ধৈর্য ধরুন। এবার গরম বেশি বলে ৩০ এপ্রিল থেকে স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে যাবে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি কংগ্রেসের
প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান শুভঙ্কর সরকার দাবি করেছেন, এই দুর্নীতির দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হবে। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, শিক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে তাই নয়, সেটা ধামাচাপা দিতে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে জনগণের টাকা করচ করা হয়েছে। কেন এইভাবে জনগণের টাকা নয়ছয় করবে সরকার?
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
বিজেপি বলছে, তৃণমূল দায়ী
রাজ্য বিজেপি সবাপতি সুকান্ত মজদুমদার বলেছেন, ''মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্কুল সার্ভিস কমিশন, রাজ্য সরকার কেন যোগ্য ও অযোগ্যদের পৃথকীকরণ করে দিল না? রাজ্য সরকার পৃথকীকরণ করে দিলে এতজনের চাকরি চলে যেত না। শুধুমাত্র অযোগ্যদের চাকরি চলে যেত।”
বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ''এই ঘটনার জন্য দায়ী তৃণমূল। যোগ্যরা এদের পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য চাকরি হারালো। গোটা স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়লো।''
ছবি: Srijit Roy
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী যা বললেন
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ''সরকার এতদিন পরেও বলতে পারলো না, কতজন অযোগ্য। সরকার দাঁড়ালো অযোগ্যদের পাশে। সরকারের অপদার্থতার জন্য এটা হয়েছে। সরকার অযোগ্যদের বাদ দিলো না বলে, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের মুখ পুড়লো।'' সিপিএম নেতা ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ''দুর্নীতি করেছে সরকার। তাদের এই দায় নিতে হবে।'' মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, মামলা করার আগে ভাবলেন না, কে যোগ্য কে অযোগ্য।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শুক্রবার আবার শুনানি হতে পারে
শুক্রবার নিয়োগ দুর্নীাতি নিয়ে আবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানি আছে। রাজ্য সরকার বাড়তি পদ তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট তা নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এর উপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। সেই বিষয়ে শুক্রবার শুনানি হতে পারে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Qadri
13 ছবি1 | 13
সমাধানসূত্র কই?
দেবাশিস বলেন, রাজনৈতিক দলগুলিকে সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতে হবে। "কেবলমাত্র দোষারোপ করলে সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একটা সাংঘাতিক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বহুদিন ধরে স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। ক্লাস হচ্ছে না। আজ হঠাৎ করে ২৬ হাজার শিক্ষক শিক্ষিকারা থাকবেন না। এই শূন্যস্থান কীভাবে পূরণ হবে। আমি খাতা দেখছিলাম। সেই কাজ কে করবে?"
ওয়েটিং লিস্টে নাম ছিল নদিয়ার ইলিয়াস বিশ্বাসের। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ২০২২-এর রায়ের পর ২০২৩-এ চাকরি পান তিনি। আলিপুরদুয়ারে ইতিহাস পড়াতেন। চাকরি হারিয়েছেন তিনিও। বাড়িতে মা বাবা। সংসারে ইলিয়াসই একমাত্র উপার্জনকারী । ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, "মা-বাবার সুগার আছে প্রেশার আছে। মায়ের কিছুদিন আগে সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছিল। কাল থেকে কেঁদে চলেছেন। এখন ওষুধ কিনব কোথা থেকে তাও জানি না।"
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন ইলিয়াস। তিনি বলেন, "অযোগ্যদের নামের তালিকা দিতে গাফিলতি করেছে এসএসসি। এই পুরো ঘটনায় অস্বচ্ছতা তৈরি করা হয়েছে। তার ফল ভোগ করছি আমরা।"
অন্যদিকে, যোগ্য হয়েও চাকরি না পাওয়ায় যারা আন্দোলন চালাচ্ছিলেন তারাও মর্মাহত। চাকরিপ্রার্থী মৌসুমি ঘোষ দাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা চেয়েছিলাম অযোগ্যদের চাকরি যাক। যারা যোগ্য হয়েও চাকরি খোয়ালেন তারা আজ আমাদেরই মতো অসহায়। এটা মেনে নেয়া যায়না।"