চাকরিহারাদের বিক্ষোভ ঘিরে বুধবার উত্তেজনা ছড়িয়েছিল কলকাতার কসবায়। ওই দিন জেলায় জেলায় ডিআই অফিসে বিক্ষোভ দেখানোর কর্মসূচি নিয়েছিলেন চাকরিহারারা। সেই মতো তারা কসবার ডিআই অফিসেও গেছিলেন। কিন্তু সে সময় সেখানে অফিসার উপস্থিত ছিলেন না। তার ঘর তালাবন্ধ ছিল। পুলিশের অভিযোগ, বিক্ষোভকারীরা তালা ভেঙে ডিআই অফিসে ঢোকার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে কসবা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
কসবায় ওই দিনের ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে রীতিমতো ধস্তাধস্তি হয় চাকরিহারাদের। সেখানেই এসআই রিটন দাস এক বিক্ষোভকারীর বুকে লাথি মারেন বলে অভিযোগ। যা নিয়ে গোটা রাজ্যজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
অভিযোগ, ওই রিটন দাসকেই কসবা-কাণ্ডের তদন্তে মূল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিল প্রশাসন। তবে চাপের মুখে শুক্রবার দুপুরে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় লালবাজার।
কসবার ডিআই অফিস বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তাদের বেধড়ক লাঠিপেটা পুলিশের। মারা হলো লাথিও।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
লজ্জাজনক
বুধবার চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ বেঝড়ক লাঠি চালালো। শিক্ষকদের লাথি মারা হলো। রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন শিক্ষকরা। কসবার ডিআই অফিসে প্রতীকী তালাবন্ধ করে প্রতিবাদ দেখাতে গিয়ে এই হেনস্থার মুখে পড়তে হলো তাদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের কীর্তি
বিক্ষোভরত নিরস্ত্র শিক্ষকদের কাউকে গলাধাক্কা দেয়া হলো, কাউকে লাঠি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়া হলো, কাউকে দুই পাশ থেকে ধরে লাঠি মারা হলো, কারো হাত মুচড়ে দেয়া হলো। যোগ্য শিক্ষক মঞ্চ ২০১৬-র তরফে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ ছিল। কলকাতার কসবার বিক্ষোভে এই ঘটনা ঘটলো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হালকা বলপ্রয়োগ!
কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, কসবায় একদল বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশকে আক্রমণ করে। সহিংসতা করে। দুই নারী পুলিশ কর্মী-সহ ছয়জন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ হালকা বলপ্রয়োগ করে। পরে পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা দাবি করেছেন, বাধ্য হয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে লাথি মারা কাম্য ছিল না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মারের চোটে লাঠি ভাঙলো
বিক্ষোভরত শিক্ষকদের বক্তব্য, তারা ডেপুটেশন দিতে গিয়েছিলেন। পুলিশ প্রথম থেকে মারমুখি ছিল। এমনভাবে মেরেছে যে তাদের লাঠি পর্যন্ত ভেঙে যায়। চাকরিহারা নারী শিক্ষকরাও পুলিশের মারের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুখ্যসচিবের বক্তব্য
মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ বলেন, এই ঘটনা কাম্য ছিল না। চাকরিহারাদের প্রতি সমবেদনা আছে। তারা যেন শান্ত থাকেন। তবে বিরোধীদের অভিযোগ, কোনোরকম সমবেদনা থাকলে পুলিশ তাদের প্রতি এই ধরনের ব্যবহার করে না। পুলিশের এই আচরণ থেকে সরকার ও প্রশাসনের আসল মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
জেলায় জেলায় বিক্ষোভ
শুধু কলকাতার কসবায় নয় জেলায় জেলায় শিক্ষকরা বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নামেন। তারা দাবি করতে থাকেন, কসবায় আটক চাকরিহারা শিক্ষকদের মুক্তি দিতে হবে। মেদিনীপুর, বহরমপুর, আসানসোল-সহ বিভিন্ন জায়গায় ডিআই অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ
কসবার ডিআই অফিসের সামনে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কিন্তু চাকরিহারা শিক্ষকরা এসে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করতেই তারা মারমুখি হয়ে ওঠে বলে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কেন এই বিক্ষোভ?
ক্যানিং ইটখোলা রাজনারায়ণ হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক অনিমেষ সামন্ত বলেন, ''আমাদের দাবি, যোগ্যদের তালিকা অবিলম্বে এসএসসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। যে মিরর ইমেজ যা সিবিআই উদ্ধার করেছে, তা প্রকাশ করতে হবে, যাতে গোটা দেশ ও রাজ্য জানতে পারে আমরা যোগ্য। আমরা যে ওএমআর শিটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেটা প্রকাশ করুক। আমরা নতুন করে পরীক্ষায় বসব না। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণামতো ভলেন্টিয়ারি সার্ভিসও দিতে রাজি নই।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'গুলি করে মারুক'
বাটানগড় জবতলা সূর্যকুমার বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষিকা সাথী লাহা বলেন, 'আমরা যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা। কোনোভাবেই কোথাও কখনো আমাদের দুর্নীতির নাম নেই। আমরা গোটা দেশকে জানাতে চাই আমরা যোগ্য। আমরা কেন ভলেন্টিয়ারি সার্ভিস দেব। আমাদের পূর্ণ সম্মান দিয়ে পদে ফেরানো হোক। আমাদের পরিবার, বাচ্চাদের স্কুলের ফিস বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। হয় আমাদের আত্মহত্যা করতে বলুক, নয়তো গুলি করে মেরে দিক।'
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'অসম্মানজনক প্রস্তাব'
রতনপুর গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা স্বর্ণালি বসু বলেন, 'মিরর ইমেজ না পাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যোগ্য অযোগ্যদের একসঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল যাতে আমাদের চাকরি চলে যায়। এসএসসি অযোগ্যদের লিস্ট দিয়েছে যোগ্যদের তালিকা দেয়নি। যোগ্যদের লিস্ট প্রকাশ করা হোক। ভলেন্টিয়ারি সার্ভিস আমাদের জন্য অসম্মানজনক। আমরা যতদিন না যোগ্য সম্মান পাবো ততদিন এই সার্ভিস দিতে রাজি নই।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'আমরা পথে বসে গেছি'
রায়দিঘি নরেন্দ্রপুর মিলন বিদ্যাপীঠের শিক্ষক কর্ণকুমার নস্কর বলেন, 'সরকার দুর্নীতি করেছে অযোগ্যদের লিস্টেই তা প্রমাণিত। আমরা সকলেই জানি কারা অযোগ্য। যোগ্যদের লিষ্ট সামনে আসা দরকার। সরকার আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২৫ সাল বর্তমান সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তাতে একটাই মাত্র এই নিয়োগ হয়েছে। অথচ সরকারের মনে হচ্ছে না যে এদেরকে বাঁচানো দরকার। আমরা তো পথে বসে পড়েছি।'
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, চাকরিহারা শিক্ষকরা আমাদের সঙ্গে বসতে চাইছেন, আবার ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করছেন, দুটো একসঙ্গে হতে পারে না। শনিবার তিনি চাকরিহারা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বলে জানিয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, লাথি, লাঠি মারা স রকার, আর নেই দরকার। বিজেপি এর বিরুদ্ধে রাস্তাতেও নামে। সিপিএমও বৃহস্পতিবার প্রতিবাদ মিছিল করছে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, রাস্তায় নামা দরকার। শিক্ষাকে বাঁচানোর জন্য। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার জানিয়েছেন, কংগ্রেস কর্মীরা কলেজ স্ট্রিটে মিছিল করবেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
13 ছবি1 | 13
লাথি-কাণ্ড নিয়ে বিতর্ক
গত কয়েকদিন ধরে কলকাতা-সহ জেলায় জেলায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন চাকরিহারারা। বুধবার কসবাতেও তেমনই একটি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছিল। চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের সেই বিক্ষোভেই লিটন এক শিক্ষককে লাথি মারেন বলে অভিযোগ। লাথির ওই ভিডিও নিমেষের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। যা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় নাগরিক সমাজে। শিক্ষকদের গায়ে পা তোলা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় পুলিশকে। এরপর ওই অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারকেই কসবা-কাণ্ডের দায়িত্ব দেওয়ায় বিতর্ক আরো ঘনিভূত হয়। প্রশ্ন উঠে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকেই কীভাবে ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়?
দিনভর এই বিতর্ক চলার পর শুক্রবার দুপুরে লালবাজার জানায় রিটনকে ওই তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, কার নির্দেশে প্রথমে ওই অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?
উল্লেখ্য, বুধবারের ঘটনার পর শাসকদলেরও কোনো কোনো নেতা বলেছিলেন, ওই ঘটনা অনভিপ্রেত।