দেশে-বিদেশে কড়া সমালোচনা সত্ত্বেও ব্রেক্সিট চুক্তির শর্ত ভেঙে আইন প্রণয়ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ তবে নিজের দলের মধ্যে অসন্তোষ দূর করতে তিনি সেই আইনের খসড়ায় একটি পরিবর্তন মেনে নিতে রাজি হয়েছেন৷ টোরি দলের দুই সংসদ সদস্যের উদ্যোগে সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করে আগামী সপ্তাহে সংসদে ভোটাভুটি হবে৷ সে ক্ষেত্রে বিতর্কিত আইন প্রণয়নের পথে বাধা দূর হবে বলে জনসন আশা করছেন৷ সংশোধনীর উদ্যোক্তা বব নেইল ও ডেমিয়ান গ্রিন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে সরকার শেষ উপায় হিসেবে বাড়তি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বাকি অংশের তুলনায় উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশে শুল্কের ক্ষেত্রে ভিন্ন নিয়ম চালু করা হতে পারে৷ স্বেচ্ছায় সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে সেই ধারা বাতিল করে দেশের অখণ্ডতার স্বার্থে এক ‘সেফটি নেট’ নিশ্চিত করতে চান৷ এমনটা করলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হবে জেনেও তিনি নিজের অবস্থানে অটল রয়েছেন৷ এবার সংশোধনীর মাধ্যমে উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশের সঙ্গে ইইউ-র স্থলসীমায় চেকপয়েন্ট বা নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কা দূর করা হবে৷ ফলে মানুষ ও ব্যবসাবাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মনে কোনো অনিশ্চয়তা থাকবে না বলে আশা করা হচ্ছে৷
বিরোধী পক্ষ অবশ্য এমন সংশোধনী সত্ত্বেও সন্তুষ্ট নয়৷ লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড বলেন, এমন রদবদল সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে ব্রিটেনের ভাবমূর্তির ক্ষতি এড়ানো যাবে না৷ এক টুইট বার্তায় তিনি মনে করিয়ে দেন, যে ব্রেক্সিট পুরোপুরি কার্যকর হবার পর সরকার ইইউ-র সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটি পালন করা প্রয়োজন৷
প্রধানমন্ত্রী জনসন বুধবার বলেন, বছরের শেষে ব্রিটেন ও ইইউ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে পারবে বলে তাঁর মনে সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে৷ তবে দুই পক্ষ অক্টোবর মাসের মধ্যেই সেই চুক্তি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করলেও জনসনের প্রস্তাবিত আইনের কারণে ইইউ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে৷ চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের পাশাপাশি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের ইঙ্গিতও দিয়েছে ব্রাসেলস৷
সংসদের এক কমিটির দুই ঘণ্টারও বেশি জেরার মুখে জনসন আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেন, শেষ পর্যন্ত ইইউ-র সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সম্ভব না হলে সেই রাষ্ট্রজোট বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে ব্রিটেনের ভূখণ্ড থেকে উত্তর আয়ারল্যান্ডে খাদ্য ও কৃষিপণ্য ‘অবরোধ’ করতে পারে৷ তাঁর দাবি, ইইউ কর্মকর্তারা এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ তবে এ ক্ষেত্রে তাঁর ভুল হতে পারে বলে জনসন স্বীকার করেন৷ হয়তো ইইউ শেষ পর্যন্ত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না৷ তবে কোনো চরম পরিস্থিতি এড়াতে বিমা হিসেবে তিনি নতুন আইন প্রণয়ন করতে চান, বলেন জনসন৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রস্তাবিত সংশোধনী সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় নি৷ ইইউ শুরু থেকেই প্রস্তাবিত আইনের খসড়া পুরোপুরি বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছে৷ ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেছেন, একতরফাভাবে বিচ্ছেদ চুক্তি রদবদল, অমান্য বা ভুল প্রয়োগ করা যায় না৷ তিনি প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘ব্রিটেন চুক্তি ভাঙে না৷’’
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স, এএফপি)
গতবছরের জুলাইয়ের ছবিঘরটি দেখুন...
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall