এরশাদের পিছটান, বিরোধী জোটের টানা অবরোধের কারণে দেশজুড়ে সহিংস পরিস্থিতি আর বিরোধী নেতা-কর্মীদের আটক – সব মিলিয়ে বেশ চাপের মুখে রয়েছে সরকার৷ বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাও সরকারের সমালোচনা করছে৷
বিজ্ঞাপন
এরশাদকে ফেরাতে এখন সরকারের মূল ভরসা নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেয়া জাতীয় পার্টির মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপদেষ্টারা৷ তাঁদের বাগে রাখার চেষ্টা করছে সরকার৷ সরকারের লোকজন বাইরে নিরুদ্বিগ্ন ভাব দেখালেও ভিতরে ভিতরে কিছুটা হলেও তাঁরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন৷ তবে তাঁদের আশা, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে এখনো যেহেতু সপ্তাহ খানেক সময় আছে তাই শেষ পর্যন্ত হয়তো এরশাদকে নির্বাচনে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে৷
এরশাদের মন্ত্রীরাও এরশাদের নতুন এই সিদ্ধান্তের কথা জানতেন না৷ তাঁরা পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন৷
উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যখ্যা দিয়ে সাবেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু সমস্যা হয়েছে৷ এই সমস্যা কেটে যাবে বলে তিনি আশা করেন৷ তবে এরশাদ শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে সরকারের ওপর কিছুটা চাপ পড়লেও নির্বাচন যথাসময়েই হবে বলে জানান তিনি৷
কিন্তু অবরোধ এবং সহিংসতায় দেশ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে৷ এই পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে কিনা, আর সেক্ষেত্রে সরকারের হাতে বিকল্প কি – এমন প্রশ্নের জবাবে সুরঞ্জিত বলেন, ‘‘পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা হচ্ছে৷ সেটা না হলে জরুরি অবস্থা জারির বিকল্প আছে সরকারের হাতে৷ কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখনো হয়নি৷'' তিনি মনে করেন সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে৷
প্রতিহিংসা আর ধ্বংসের নির্মম রাজনীতি আর কতকাল
বাংলাদেশে হরতাল, অবরোধ নতুন কিছু নয়৷ বড় দুটো দলতো বটেই, অনেক ছোট দলও অতীতে এমন কর্মসূচি দিয়েছে৷ জনদুর্ভোগ বেড়েছে, সম্পদ বিনষ্ট এবং প্রাণহানিও হয়েছে৷ তবে সাম্প্রতিক হরতাল, অবরোধগুলো দুঃস্বপ্নকেও হার মানিয়েছে৷
ছবি: JEWEL SAMAD/AFP/Getty Images
হামলার শিকার সাংবাদিক
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে৷ এখনো সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি৷ তবে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সাংবাদিকের আহত হওয়ার ঘটনা চলমান আন্দোলনেই প্রথম ঘটছে৷ এ বছর হেফাজত-এ-ইসলামের সমাবেশে প্রহৃত হন সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন৷ গত দুই সপ্তাহে হরতাল এবং অবরোধের সময় ককটেল হামলায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক৷ ছবিতে নাদিয়া শারমিনের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাতেচ্ছেন নারী সংগঠন কর্মীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যানবাহনে আগুন, রেললাইন উপড়ানো
হরতাল-অবরোধ মানেই রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ৷ কর্মসূচির এ লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হলে গাড়ি ভাঙচুর এবং আগুন লাগানো বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই স্বাভাবিক ঘটনা৷ তবে গত এক বছরে জ্বালাও-পোড়াওয়ের এই ধ্বংসলীলা অন্য মাত্রা পেয়েছে৷ হরতালের আগের রাতেই শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ৷ তাই বিরোধী দল ঘোষণা অনুযায়ী কর্মসূচি পালন শুরুর আগেই জনমনে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক৷ ছবিতে মোটর সাইকেলে পেট্রোল ঢালছেন জামায়াত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/Andrew Biraj
শিশুরাও অসহায়, নিরাপত্তাহীন
যানবাহনে ঘুমন্ত চালক, হেল্পার বা চালকের সন্তানের আগুনে ঝলসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে৷ ঢাকা শহর দেখতে এসে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে কাভার্ডভ্যান চালকের সন্তান মুনির৷ এমন হতভাগ্যদের তালিকায় আরো নাম যোগ হয়েছে৷ স্কুলে, রাস্তায়, এমনকি বাড়িতেও শিশুদের জীবন সংকটাপন্ন দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ৷ছবিতে সর্বশেষ অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিনে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে স্লোগানরত জামায়াত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/Andrew Biraj
নিরাপত্তা কর্মীদেরও নিরাপত্তার অভাব
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কারণে রায় ঘোষণার পর নেতাদের শাস্তির আদেশ প্রত্যাহার এবং মুক্তির দাবিতে জামায়াত-ই-ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে৷ হামলায় নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মী৷ রাজশাহীতে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সদস্যের মাথা ইটের আঘাতে থেতলে দেয়া হয়৷ বিরোধী দলের সর্বশেষ অবরোধ কর্মসূচিতেও কর্মরত পুলিশ ও বিজিবি সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন দায়িত্বরত অবস্থায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir uz ZAMAN
সংখ্যালঘুদের বাড়ি-মন্দিরে আগুন
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে অনেক সময়৷ তবে শীর্ষ নেতাদের শাস্তি ঘোষণার পর জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা চালায়৷ ছবিতে নিজের শিশুসন্তান কোলে সাতক্ষিরার অমিয় দাশ৷ ঘরবাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সময় শিশুটিকে আগুনে ছুড়ে মারতে চেয়েছিল শিবির কর্মীরা৷
ছবি: Shayantani Twisha
কবে হবে অবসান!
প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও মহাজোটের শরিক কয়েকটি দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছে৷ ফলে রাজনীতির মাঠে উত্তেজনা বেড়েছে৷ ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে তফশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন৷ তারপর থেকে বিরোধী দলের হরতাল, অবরোধ চলছে প্রায় বিরামহীনভাবে৷
ছবি: JEWEL SAMAD/AFP/Getty Images
6 ছবি1 | 6
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অজ্ঞাত স্থান থেকে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, চূড়ান্ত বিজয় না আসা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে৷ তাই হরতাল, অবরোধ যে সহসাই থামছে না তা প্রায় নিশ্চিত৷
রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন এরশাদ শেষ পর্যন্ত কি করেন তা এখনই বলা যাচ্ছে না৷ এজন্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ তবে এরশাদ মঙ্গলবার নির্বাচন বর্জনের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা সরকারকে চাপে ফেলেছে৷ তিনি মনে করেন এবার হয়তো আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন এরশাদের জন্য কঠিন হতে পারে৷ তাই যদি হয় তবে সেটা হবে বিরোধী দলের জন্য সরকারকে বেকাদায় ফেলার বড় অস্ত্র৷ সেক্ষেত্রে বিরোধী দল আন্দোলনের পাশাপাশি নৈতিক অবস্থানের দিক দিয়েও এগিয়ে যাবে৷
এরপরও যদি সরকার অনঢ় থাকে তাহলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের প্রশ্ন আসতে পারে৷ ঢাকায় এধরণের একটি কথা আলোচিত হচ্ছে বলে জানান অধ্যাপক ইমতিয়াজ৷ তবে তিনি মনে করেন হয়তো তার আগেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে৷ কারণ সেপর্যন্ত সরকারও হয়তো যেতে চাইবে না৷
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন বুধবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং দু'দিনের সফরে ঢাকা আসছেন৷ এই সময়ে তাঁর ঢাকা সফর বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তিনি মনে করেন ভারত তার ব্যবসা এবং বিনিয়োগের ক্ষতি করে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুকূল্য দেখাবে না৷ সামনের সপ্তাহে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারনকো'র সফর অনেক হিসেব বদলে দিতে পারে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক৷