ঢাকায় সোমবারের ১৮ দলের সমাবেশে প্রধান শরিক জামায়াতের অনুপস্থিতি এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে৷ বিএনপি নেতারা এ ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন৷ আর জামায়াত নেতারা আছেন চুপচাপ৷
বিজ্ঞাপন
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির ওপর চাপ বাড়ছে৷ বিশেষ করে, জামায়াতের কারণে সহিংসতার দায় নিতে হচ্ছে বিএনপিকে৷ এ নিয়ে সরকারের দিক থেকে যেমন বিএনপির ওপর চাপ আছে৷ আন্তর্জাতিক মহল থেকেও চাপ অব্যাহত আছে৷ তারা কোনোভাবেই সহিংসতাকে গ্রহণ করছেন না৷
তাই সোমবার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের সমাবেশে জামায়াত না থাকার কারণ খুঁজছেন অনেকেই৷ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘জামায়াত কর্মসূচিতে থাকলে অনেক প্রশ্ন এবং ভীতি চলে আসে৷ সোমবার সমাবেশে জামায়াতের অনুপস্থিতির কারণে বিএনপি স্বস্তিতে আছে৷ আর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটগত সম্পর্ক সাময়িক এবং কৌশলগত৷''
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
তবে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুখ বলেন ভিন্ন কথা৷ তিনি বলেন, ‘‘সোমবারের সমাবেশে জামায়াত প্রকাশ্যে অংশ নেয়নি৷ সমাবেশের মধ্যে যে তারা উপস্থিত ছিল না সেটা নিশ্চিত নয়৷'' জামায়াত নেতাদের ব্যক্তিগত নিরপত্তার কারণে এমনটি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপির অনেক নেতাও কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেননি৷''
আর বিশ্লেষকরা একে দেখছেন বিএনপির চাপ কমানোর কৌশল হিসেবে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিএনপি অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ কমিয়ে আনতে হয়ত কৌশল নিয়েছে৷ জামায়াতের কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলা শুরু করেছে৷'' কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে বাদ দেয়া বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয় বলেই মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এই দূরত্ব রেখে বিএনপি হয়ত কয়েকমাস দেখবে তার ফল কি হয়৷ আর তাতে যদি কোনো ফল না আসে, বিএনপিকে যদি আবার হরতাল-অবরোধে যেতে হয়, তাহলে জামায়াতকে তার লাগবেই৷ নিকট অতীতে তার প্রমাণ আছে৷'' শান্তনু মজুমদার বলেন, ভোটের হিসাব করলেও জামায়াতকে বিএনপির প্রয়োজন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিউল আলমও মনে করেন যে, বিএনপি আপাতত জামায়াতকে কৌশলগত কারণেই একটু দূরে রাখাতে চায়৷ তবে শেষ পর্যন্ত এটা বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে নতুন কোনো মোড় নেবে কিনা – তা বুঝতে হলে আরো অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷