চলমান সহিংসতা বন্ধ ও সংলাপের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে৷ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাতিসংঘ গত ক’দিনে এ নিয়ে একাধিকবার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে৷ এই চাপ বাংলাদেশকে নতুন নির্বাচনের দিকে নেবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন৷
বিজ্ঞাপন
ওয়াশিংটনে বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা এবং প্রাণহানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ সহিংসতা বন্ধ এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের তাগিদ দিয়েছেন তিনি৷
একই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গেও সাক্ষাত্ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী৷ বেঠকে জন কেরি বাংলাদেশে চলমান সহিংসতা বন্ধে সরকারকে শান্তিপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান৷
তিনি বলেন, ‘‘সব দলকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে৷'' এছাড়া মানবাধিকার পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য স্বাধীন ও স্বচ্ছ গণমাধ্যমের প্রতিও জোর দেন তিনি৷
অবরোধ-হরতালে বিপর্যস্ত জনজীবন
বাংলাদেশে টানা অবরোধ ও হরতালের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা৷ ক্রেতার অভাবে বেচাকেনা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে৷ শুধু অর্থনীতি নয়, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় মুষড়ে পড়েছে পরিবহন ও শিক্ষা ব্যবস্থাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন
পুরনো ঢাকার বাবু বাজারে কাগজ বোঝাই একটি ট্রাকে জ্বলছে দুষ্কৃতিকারীদের দেয়া পেট্রোল বোমার আগুন৷ গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ৷ ডাকা হচ্ছে হরতালও৷ অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে আলোচিত পেট্রোল বোমা৷ শুধু পেট্রোল বোমার আগুনেই পুড়ে মরেছে কমপক্ষে ৬৫ জন সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুলিশ প্রহরায় চলছে পরীক্ষা
ঢাকার মতিঝিল আইডিয়িাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পুলিশ প্রহরা৷ চলমান এ অবরোধ-হরতালে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তার মধ্যে শিক্ষার্থীরা অন্যতম৷ বর্তমানে সারা দেশে চলা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন তাই অনেকটাই অনিশ্চয়তার মুখে৷ টানা অবরোধের মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে চলছে পরীক্ষা৷ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূরপাল্লার বাস নেই বললেই চলে
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলির ডাকা অবরোধে বাংলাদেশের প্রধান সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্ত৷ দুপুর বেলায় তোলা এ ছবিতে মহাসড়কটি প্রায় যানবাহন শূন্য৷ কিন্তু সাধারণ সময়ে এ সড়কটি থাকে যানবাহনে ভরা৷ বাংলাদেশে চলমান অবরোধে দূর পাল্লার গাড়ি চলাচল কমে গেছে বহুলাংশে৷ একের পর এক পেট্রোল বোমার ঘটনায় ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাচ্ছেন না অনেক মালিকই৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিজিবি-র টহল পর্যাপ্ত নয়
অবরোধের মধ্যে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয়, মানে ঢাকার বাইরে বিজিবি-র টহল থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য৷ এছাড়া সম্প্রতি রাত ন’টার পরে বাস চলাচলে সকলকে নিরুৎসাহ করার কারণে বাস মালিকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকায় অস্বাভাবিক নয় যানজট
বাংলাদেশে চলমান এই অবরোধে ঢাকার ভেতরের সড়কের দৃশ্য অবশ্য আলাদা৷ যান চলাচল অন্যান্য সময়ের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও, অনেক জায়গাতেই যানজট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অফিসযাত্রীরা
ঢাকার ফার্মগেটে অফিস শেষে গাড়ির অপেক্ষায় বাড়িমুখী মানুষের ভিড়৷ টানা অবরোধে গণ পরিবহন ব্যবস্থা বেহাল হলেও, অর্থাৎ গাড়িঘোড়ার চলাচল কম থাকাতে দুর্ভোগ বেড়েছে অফিসমুখী ও অফিস ফেরত মানুষের৷ অফিসে যেতে বা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে সাধারণ মানুষ তাই পড়ছেন দুর্ভোগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অবরোধে নদীপথের ভিন্ন চিত্র
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাটের চিত্র এটি৷ গত একমাসেরও বেশি সময়ের এই অবরোধে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য বড় কোনো সহিংসতা ঘটেনি নদীপথে৷ তাই নদীপথে যান চলাচল প্রায় স্বাভাবিকই আছে৷ ঢাকা থেকে প্রধানত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
যাচ্ছে না দূরপাল্লার বাসগুলো
বিএনপি ও সমমনা দলের জোটসমূহের ডাকা হরতাল-অবরোধে ঢাকার অন্যতম প্রধান বাস স্টেশন গাবতলীর দৃশ্য এটি৷ বেশিরভাগ দূর পাল্লার রুটের বাসই এ স্টেশনে পার্ক করে রাখা৷ হরতাল-অবরোধে দূর পাল্লার বাস চলাচল অনেকাংশেই বন্ধ আছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. Mamun
খদ্দেরহীন এক রেস্তোরাঁ
ঢাকার গাবতলী বাস স্টেশনের খদ্দেরশূন্য মোহাম্মাদীয়া রেস্তোরাঁ৷ অবরোধের কারণে এ রেস্তোরাঁর লোকবল ১৬ জন থেকে ৮ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে৷ বাকি যে আটজন আছেন তাঁদেরও নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না মালিক৷ গাবতলী স্টেশন থেকে দূর পাল্লার বাস চলাচল কম থাকায় এ রেস্তোরাঁটি দিনের বেশিরভাগ সময় খালি থাকছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ি ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ
অবরোধ আর হরতালকারীদের প্রধান লক্ষ্য সড়কে চলাচলকারী বাস আর ট্রাক৷ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগেই যাত্রীবাহী বাস কিংবা ট্রাকে৷ এতে কমপক্ষে ৬০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে পোড়ায় ক্ষত শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন আরো শতাধিক সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
কমলাপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষায় যাত্রীরা
অবরোধে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল করলেও, সময়সূচি ঠিক রাখতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ৷ বিভিন্ন সময়ে অবরোধকারীদের রেল লাইনের ‘ফিশপ্লেট’ খুলে ফেলার কারণে কয়েকটি ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনায় ট্রেনের গতি কমিয়ে চালাতে হচ্ছে৷ তাই বেশিরভাগ ট্রেনই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে যাচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন৷
ছবি: DW/M. Mamun
খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা
টানা অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা৷ স্বল্প পুঁজির এ সব ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমে যাওয়ায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেকেরই৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুঁজি ভেঙে চলছে যাঁর সংসার
ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকার ফুটপাথে কম্বলের ব্যবসা করেন গাজীরুল ইসলাম৷ দুপুরবেলা পর্যন্ত এ দিন তাঁর বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৭’শ টাকার একটি কম্বল৷ তাও তার কেনা দামের থেকে ৩০০ টাকা কম৷ লাভ তো দূরের কথা সংসার চালাতে এখন পুঁজি টুকুনিই ভরসা৷
ছবি: DW/M. Mamun
অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রই যখন ভরসা
ঢাকার নবাবপুর থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ফিরছেন এক গাড়ি চালক ও তাঁর সহকারী৷ টানা অবরোধ-হরতালে পেট্রোল বোমার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে নিজেদের গাড়িতে এখন থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখবেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
14 ছবি1 | 14
ঢাকা সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজনৈতিক সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে৷ তবে সরকার জানিয়েছে যে, সহিংসতা বন্ধের আগে কোনো সংলাপ নয়৷
গত বছরের ৫ই জানুযারি একতরফা নির্বাচনের আগে ও পরে বাংলাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়৷ বিএনপি এই নির্বাচন তখন বর্জন করে৷ তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছিল৷ গত একবছর এই দাবি নিয়েই তারা সেচ্চার ছিল৷ তবে একরফা নির্বাচনের বছরপূর্তিতে তারা নতুন করে আন্দোল শুরু করেছে৷ ৬ই জানুযারি থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে তারা৷ এই কর্মসূচি অব্যাহত রেখেই এখন লাগাতার হরতাল কর্মসূচি পালন করছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট৷
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস উইং-এর কর্মকর্তা শাইরুল কবির খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘খালেদা জিয়া দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না৷ তাতে যতদিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ততদিন আন্দোলন চালাবেন তিনি৷''
হরতাল-অবরোধে বাংলাদেশে গত দেড়মাসে ৮২ জন নিহত হয়েছেন৷ এরমধ্যে পেট্রোল বোমায় নিহত হয়েছেন ৫২ জন৷ এছাড়া এক হাজারেরও বেশি যানবাহন আগুন অথবা পেট্রোল বোমা ছুড়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷
অস্থির বাংলাদেশ
বাংলাদেশে দশম সংসদীয় নির্বাচনের বছরপূর্তিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে৷ এতে একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে৷ ৫ই জানুয়ারি রাজনৈতিক অস্থিরতার কয়েকটি ছবি পাবেন এখানে৷
ছবি: picture alliance/ZUMAPRESS.com
অবরুদ্ধ খালেদা
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে আটকে রেখেছে পুলিশ৷ যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে, তবে সোমবার তিনি বাইরে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁর গেটে তালা লাগিয়ে দেয়৷ ফলে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন গেটের মধ্যেই৷
ছবি: AFP/Getty Images
অবরোধ ঘোষণা
অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন৷ গুলশানের কার্যালয়ে সোমবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘‘আজ আমাদের কালো পতাকা কর্মসূচি ছিল৷ সমাবেশ করতে দেওয়া হয় নাই৷ পরবর্তী কর্মসূচি না দেওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে৷’’
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
খালেদার কার্যালয় ঘিরে পুলিশ
প্রসঙ্গত, গত দু’দিন ধরে খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘিরে রেখেছে পুলিশ৷ ছবিতে পুলিশে একটি গাড়ি রাস্তায় আড়াআড়িভাবে রেখে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এভাবে আরো কয়েকটি বালু এবং ইটভর্তি ট্রাকও রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/Landov
গাড়িতে আগুন
রবিবার থেকেই ঢাকায় সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছিল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে বিএনপিসহ বিশ দল৷ ঢাকায় একটি সিএনজি এবং মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ছবি এটি৷ বিএনপি সমর্থকরা এটা করেছে বলে জানিয়েছে সংবাদসংস্থা৷
ছবি: picture alliance/ZUMAPRESS.com
পার্ক করা গাড়িতে আগুন
পার্ক করে রাখা একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দিচ্ছে বিএনপির সমর্থকরা৷ ছবিটি ঢাকা থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
রাজপথে সরব আওয়ামী লীগ
পুলিশ সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ করলেও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়ো হন৷ বিষয়টি সমালোচনা করে ফেসবুকে সাংবাদিক প্রভাষ আমিন লিখেছেন, ‘‘...নিষেধাজ্ঞা কি শুধু বিএনপির জন্য? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তো দেখি শহরজুড়ে মিছিল করছে, উল্লাস করছে, গান শুনছে, গান গাইছে৷’’ ছবিতে ঢাকায় বিএনপির এক সমর্থককে পেটাচ্ছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
‘শান্তির পথে আসুন’
এদিকে সোমবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বিএনপি নেত্রীকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের যে দাবিতে বিএনপিসহ বিশদল আন্দোলন করেছে, সেই দাবির প্রতি কোন নমনীয়তা দেখাননি তিনি৷ হাসিনা মনে করেন, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়াটা বিএনপির রাজনৈতিক ভুল ছিল৷
ছবি: Oli Scarff/Getty Images
‘একতরফা’ নির্বাচন
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল অংশ নেয়নি৷ সেই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে কোন ভোটাভুটি হয়নি৷ বাকি আসনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল বেশ কম৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেটিকে ‘একতরফা’ নির্বাচন আখ্যা দিয়েছে৷
ছবি: DW
8 ছবি1 | 8
সরকার এখন পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনকে আমলেই নিচ্ছে না৷ আর সংলাপের ব্যাপারেও তাদের দিক থেকে নেই কোনো ইতিবাচক সাড়া৷ তারা সহিংসতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে দমনের কথা বলছে৷ বিএনপি অবশ্য সহিংসতার জন্য সরকারকেই দায়ী করছে৷ তারা বলছে, সরকার নিজেই সহিংসতা করে বিএনপির ওপর দায় চাপিয়ে আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে৷
এই যখন পরিস্থিতি তখন আন্তর্জাতিক চাপ কী কোনো সমাধান দেবে? আর সেই সমাধান কোন পর্যায়ের –শুধু কী পরিস্থিতি শান্ত করা, না সঙ্গে নতুন একটি নির্বাচনের কথা বলবে তারা?
এই প্রশ্নের জবাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দি খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আন্তরিকভাবে কথা বলছে বলেই আমার মনে হয়৷ এ জন্য তারা সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার কথা বলছে৷ কিন্তু নতুন বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় তারা নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করছে৷ তারা হয়ত চাইছে, রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি ঠিক করুক৷''
হাফিজ উদ্দিন খান মনে করেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত হয়ত সরকার সংলাপে রাজি হবে৷ তবে নতুন মধ্যবর্তী নির্বাচনে রাজি হবে না বলেই আমার মনে হয়৷ ফলে সংকট হয়ত কাটবে না, তবে সামাল দেয়া যাবে৷''
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ অর্থনীতিসহ নানা কারণে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকার কাছে গুরত্বপূর্ণ৷ তাই তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশলিতা দেখতে চায়৷ তারা এখানে অস্থিতিশীল পরিবশে বা সহিংসতা চায় না, এটা নিশ্চিত৷ তবে সহিংতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে বাংলাদেশ কিভাবে বেরিয়ে আসবে – সেই ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারা সরকার এবং বিএনপি উভয়ের সঙ্গে কথা বলছে৷ তাদের বক্তব্য শুনছে৷ তারপর দুই দলকেই খুশি রাখতে একটি মাধ্যবর্তী অবস্থান থেকে কথা বলছে তারা৷ বলছে সংলাপের কথা৷''
ড. শফিউল আলম বলেন, ‘‘নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁরা কথা বলবেন না এটাই স্বাভাবিক৷ কারণ তারা চান এটা রাজনৈতিক দলগুলোই ঠিক করবেন কিভাবে সংকট কাটানো যায়৷ তারা কোনো দলের পক্ষেই অবস্থান নেবে না৷ তারা তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করছে৷ তাই তারা এমন পরিস্থিতি চায়, যাতে তাদের স্বার্থের কোনো ক্ষতি না হয়৷''