বাংলাদেশে চামড়া শিল্পে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশই ৫০ বছর হওয়ার আগে মারা যান৷ ট্যানারির বিশাক্ত পরিবেশে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া কাজ করার কারণেই তাঁদের এ পরিণতি৷ আর এই শ্রমিকদের একটা বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নীচে৷
বিজ্ঞাপন
প্রধানত ঢাকার হাজরিবাগ এলকাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেশের ট্যানারিগুলো৷ সংখ্যার বিচারে কম করে হলেও ২০০টি ট্যানারি তো হবেই৷ আর এ সমস্ত ট্যানারিতে কাজ করেন অন্তপক্ষে ২৫ হাজার শ্রমিক৷ ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যবহার করা হয় ক্রোমিয়াম, খার এবং অ্যাসিড৷ শ্রমিকরা কোনো ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া খালি পায়ে এবং খালি হাতে এই প্রক্রিয়াজাতের কাজ করেন৷ ফলে ক্যানসার ও চর্মরোগ সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন তাঁরা, যা তাঁদের অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়৷
শুধু তাই নয়, এখানকার বর্জ্য আশেপাশের পরিবেশও দূষিত করে৷ ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার কিউবিক লিটার বিষাক্ত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা দূষিত করছে বুড়িগঙ্গার পানি, হাজারিবাগের মাটি ও বায়ুকে৷ শ্রমিক ছাড়াও ঐ এলাকার বাসিন্দাদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷ বলা বাহুল্য, হাজারিবাগ খুবই ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকা৷ সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করেন৷ আর এই ট্যানারিগুলো তাঁদের সকলের জীবন দুর্বিসহ করে তুলছে৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডাব্লিউ-র এক গবেষণায় থেকে জানা যায় যে, ‘এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন৷ বিশেষ করে শিশুরা, যারা এই শিল্পে কাজ করছে, তাদের অবস্থা নাকি খুবই খারাপ৷ কারখানায় ব্যবহৃত সালফিউরিক অ্যাসিড, ক্রোমিয়াম এবং সীসা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর৷ তার ওপর এ সব কারখানায় কোনো বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো ‘ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট'-ও৷'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, ‘‘চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর৷ তাই ট্যানারিতে শ্রমিকরা যেভাবে খালি গায়ে ও খালি হাতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন, তাতে এই রাসায়নিক প্রবেশ করে তাঁদের ফুসফুসে ও চামড়ায় ক্যানসার হতে পারে৷ এছাড়া নানা ধরনের চর্মরোগও দেখা দিতে পারে৷''
ইকবাল হাবিব
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বা বাপা-র মুখপাত্র ইকবাল হাবিব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু ট্যানারি নয়, তাদের কেন্দ্র করে করে ছোট ছোট আরো অনেক অপরিকল্পিত কারখানা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে৷ সেসব কারখানায় ট্যানারির কঠিন বর্জ্য, যেমন টুকরো চামড়া, গরুর হাড়, চর্বি, দাঁত – এগুলো পুড়িয়ে পোল্ট্রি ফিডসহ আরো নানা জিনিস তৈরি করা হয়৷ এ সব কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া পুরো এলাকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ট্যানারি এবং ঐ সব ছোট ছোট কারখানার কারণে পুরো হাজারিবাগ এলাকার মানুষ, মাটি, পানি এবং বাতাস এখন বিষে আক্রান্ত৷ আর এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও বুড়িগঙ্গাও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে৷ অথচ জীবন ও পরিবেশের ক্ষতি করে, এমন ট্যানারির ব্যবসা কিন্তু ঠিকই ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ ট্যানারির মালিকরা শ্রমিকদের ঝুঁকির মধ্যে কাজ করালেও, মজুরি দেয় কম৷ এমনকি তাঁদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাও করে না৷''
প্রসঙ্গত, পরিবেশ আইনজীবী সমিতির আবেদনে আদালত ২০০৫ সালে হাজারিবাগের চামড়া কারখানা ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেয়ার আদেশ দেয়৷ কিন্তু বার বার সময় চেয়েও এখনও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি৷
বাংলাদেশ এ বছর ১.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে উন্নত বিশ্বে৷ গত বছর এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷
পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত দশটি স্থানের মধ্যে হাজারিবাগ
দূষিত মাটি, রাসায়নিক বর্জ্য আর ইলেকট্রনিক আবর্জনার মধ্যে বাস করছেন পৃথিবীর প্রায় বিশ কোটি মানুষ৷ গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশনের পরিবেশ দূষণ প্রতিবেদন বলছে একথা৷ চলুন দেখা যাক, পৃথিবীর কোন স্থানগুলো সবচেয়ে দূষিত?
ছবি: Blacksmith Institute
জীবনযাপন কোথায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ?
পৃথিবীর বিশ কোটি মানুষ প্রতিদিন সরাসরি পরিবেশ দূষণের ক্ষতি মোকাবিলা করছেন৷ ভারী ধাতুর কারণে দূষিত হচ্ছে মাটি, রাসায়নিক বর্জ্য উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে আর ইলেকট্রনিক আবর্জনা জমছে নদীতে৷ গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশনের পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদনে এরকম অনেক বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/JOKER
ঘানার আবোব্লশি ভাগাড়
ঘানার রাজধানী আক্রায় পশ্চিম আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহৎ ইলেকট্রনিক আবর্জনার ভাগাড়ে রয়েছে অসংখ্য পুরনো স্যাটেলাইট ডিশ এবং ভাঙা টেলিভিশন৷ গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশনের ‘দ্য এনভায়রনমেন্টাল টক্সিন রিপোর্ট’ অনুযায়ী এটি পৃথিবীর অন্যতম দূষিত স্থান৷ আবোব্লশি-র আশেপাশের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, মাটিতে বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি৷
ছবি: Blacksmith Institute
চিতারুম নদী, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার চিতারুম নদীর পানি সাধারণ পানীয় জলের তুলনায় এক হাজার গুণ বেশি দূষিত৷ এই পানিতে বিপুল পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম এবং আয়রনের মিশ্রণ রয়েছে৷ প্রায় দু’হাজার ফ্যাক্টরি এই নদীর পানি ব্যবহার করে এবং একইসঙ্গে শিল্প বর্জ্য এই নদীতেই ফেলে৷ অথচ চিতারুম নদী কয়েক কোটি মানুষের পানির মূল উৎস৷
ছবি: Adek Berry/AFP/Getty Images
জ্যারজিনস্ক শিল্প কেন্দ্র, রাশিয়া
রাশিয়ার রাসায়নিক শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র জ্যারজিনস্ক৷ ১৯৩০ থেকে ১৯৯৮ সাল সময়ের মধ্যে এই এলাকার প্রায় তিন লাখ টক রাসায়নিক বর্জ্য ঠিকভাবে বিনাশ করা হয়নি৷ ফলে সেগুলো ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করেছে এবং বাতাসে মিশে গেছে৷
ছবি: Blacksmith Institute
চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্র, ইউক্রেন
এখন অবধি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল চেরনোবিলে৷ ১৯৮৬ সালের ২৫শে এপ্রিল সেই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলের ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সব জীব মারা গেছে৷
ছবি: Blacksmith Institute
হাজারিবাগের চামড়া কারখানা, বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মধ্যে হাজারিবাগে সবচেয়ে বেশি চামড়া কারখানা রয়েছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন ২৭০টি কারখানা থেকে ২২ হাজার ঘন লিটার দূষিত আবর্জনা বের হয় হাজারিবাগে৷ এই আবর্জনায় হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম রয়েছে, যার কারণে ক্যানসার হতে পারে৷ অথচ এই সব বর্জ্যই ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মেশে৷
ছবি: Blacksmith Institute
কাবওয়ের সীসা খনি, জাম্বিয়া
জাম্বিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কাবওয়ের শিশুরা শরীরের রক্তে অতিরিক্ত সীসা সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছে৷ গত এক শতক ধরে এখানকার সীসা খনিগুলো থেকে ‘ধূলি কণা’ মাটি এবং শহরের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে৷
ছবি: Blacksmith Institute
কালিমান্তানের সোনার খনি, ইন্দোনেশিয়া
বোর্নিও দ্বীপের ইন্দোনেশিয়ার অংশে অবস্থিত কালিমান্তান৷ সোনার খনির জন্য এই এলাকা বিশেষভাবে পরিচিত৷ সোনা খুঁজে পেতে অনেক খনি মার্কারি ব্যবহার করে যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর৷
প্রায় পাঁচ হাজার ফ্যাক্টরির আবর্জনা গিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার মাতানসা-রিয়াচুয়েলো নদীতে৷ এই নদীর দূষণের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখছে রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারীরা৷
ছবি: Yanina Budkin/World Bank
নাইজার ডেল্টা, নাইজেরিয়া
নাইজার নদীর বদ্বীপ নাইজেরিয়ার অন্যতম জনঅধ্যুষিত এলাকা হিসেবে বিবেচিত৷ সে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর আট শতাংশের বাস এখানে৷ দুর্ঘটনা এবং তেল চুরির ঘটনার কারণে প্রতি বছর গড়ে ২৪০,০০০ ব্যারেল পেট্রল নাইজার বদ্বীপে গিয়ে পৌঁছায়, যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে৷
ছবি: Terry Whalebone
শিল্প শহর নোরিলস্ক, রাশিয়া
রাশিয়ার শিল্প শহর নোরিলস্কে প্রায় ৫০০ টন কপার এবং নিকেল অক্সাইড ও দুই মিলিয়ন টন সালফার অক্সাইড বাতাসে মিশে গেছে৷ এখানকার বাতাসে দূষণের তীব্রতা এত বেশি যে ফ্যাক্টরির কর্মীদের আয়ু রাশিয়ার গড় আয়ুর চেয়ে দশ বছর কমে গেছে৷
ছবি: Blacksmith Institute
11 ছবি1 | 11
বন্ধুরা, আপনারা কি কখনও হাজারিবাগে গেছেন? দেখেছেন চামড়া কারখানার শ্রমিকদের দুর্বিসহ জীবন? জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷