লোকসভা নির্বাচনের পরেই আরো এক দফা ভোট চার জেলার চার কেন্দ্রে। বুধবার উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, উত্তর চব্বিশ পরগনার বাগদা, নদিয়ার রানাঘাট দক্ষিণ ও কলকাতার মানিকতলায় ভোট হয়েছে। চারটি কেন্দ্রের জন্য ৭০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলেও অশান্তি এড়ানো যায়নি।

গুলিচালনার অভিযোগ

চারটি কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্রে। ভোটগ্রহণের আগের রাত থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। অভিযোগ, রাতে বিজেপির পোলিং এজেন্টের বাড়ি ভাঙচুর করে দুষ্কৃতীরা।

১৫৭ নম্বর বুথের পোলিং এজেন্ট রঞ্জিত মণ্ডলের বাড়িতে দুই রাউন্ড গুলি চলে বলে অভিযোগ। মণ্ডল সদস্যরা দুটি কার্তুজের খোল দেখিয়েছেন। বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে দেয়া হয়েছে।

এই বিধানসভা মধ্যে পায়রাডাঙ্গা পঞ্চায়েতের প্রীতি নগর এলাকায় বিজেপির দুই পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে। পঞ্চায়েত সদস্য গোলক মন্ডল ও অমল বিশ্বাসের দাবি, ৩০ জনের দুষ্কৃতী দল হামলা চালায়।

রানাঘাটের নোকারি এলাকায় তৃণমূল সমর্থকদের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। স্থানীয় নারীদের দাবি, তাদের ভোট দিতে বাধা দিয়েছে জওয়ানরা।

প্রার্থীর গাড়িতে হামলা

বাগদার বিজেপি প্রার্থী বিনয় বিশ্বাস সকাল থেকেই বিভিন্ন বুথে ঘুরছিলেন। একটি বুথে গিয়ে তিনি তৃণমূল সমর্থকদের রোষের মুখে পড়েন।

ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ পেয়ে বিজেপি প্রার্থী ১৮৮ নম্বর বুথে পরিদর্শনে যান। অভিযোগ, সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে বুথ দখল করেছিল তৃণমূল। বিনয় এক ভোটারকে ভুয়া বলে চ্যালেঞ্জ করতে উত্তেজনা চরম আকার নেয়।

প্রার্থীকে ধাওয়া করে তৃণমূল কর্মী, সমর্থকরা। কোনোরকমে গাড়িতে উঠে এলাকা ছাড়েন বিজেপি প্রার্থী। সেই সময়ে তার গাড়ি ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা, ইটবৃষ্টি হয়। প্রার্থীর সঙ্গে থাকা সংবাদমাধ্যমের গাড়ি লক্ষ করেও ইট ছোড়া হয়।

কলকাতায় ছাপ্পা?

মানিকতলা কেন্দ্রের বিধায়ক সাধন পান্ডে প্রয়াত হওয়ার পর বহুদিন এই এলাকার কোনো প্রতিনিধি বিধানসভায় ছিলেন না। মামলার জেরে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর এখানে উপনির্বাচন।

বিজেপির অভিযোগ সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকায় বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিচ্ছে তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবে বলেন, "অনেক জায়গায় আমাদের এজেন্ট বসতে দেয়া হয়নি। সকালে এক দফা রিগিং করা হয়েছে। আবার বিকেলে আর এক দফার পরিকল্পনা করেছে।"

এর প্রতিবাদে বিজেপির প্রতিনিধি দল জাতীয় নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে দরবার করে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী তাপস রায়, অর্জুন সিং সহ অন্যান্য নেতারা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানান। অর্জুন বলেন, "কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। দশটা মানুষের মৃত্যু হলে কি বলা হবে নির্বাচনের গণ্ডগোল হল! বিভিন্ন এলাকায় যে সন্ত্রাস চলছে, তাতে কি বলা যাবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হল?"

তৃণমূলের মুখপাত্র বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, "হার নিশ্চিত বুঝে বিজেপি চিৎকার করছে। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ দেখে ওরা ভয় পাচ্ছে। লোকসভা ভোটের মতোই হাল হবে বিজেপির।"

লোকসভা নির্বাচনের ট্রেন্ড অনুযায়ী এবারও একাধিক জায়গায় বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে 'গো ব্যাক' স্লোগান দিয়েছে তৃণমূল। মানিকতলা ও রায়গঞ্জ কেন্দ্রের বিজেপির প্রার্থীরা স্লোগানের মুখে পড়েন।

রায়গঞ্জের বিজেপি প্রার্থী মানস ঘোষ বলেন, "তৃণমূল আমাদের এজেন্টকে বুথ থেকে বার করে দিয়েছে। আমি এসে এজেন্ট বসিয়ে গেলাম। সেই কারণে ওসব স্লোগান দিচ্ছে। তাতে কিছু এসে যায় না।"

দলবদলুদের ভোট

যে চারটি কেন্দ্রে নির্বাচন, তার তিনটিতে বিজেপি জিতেছিল গত বিধানসভা নির্বাচনে। গত মাসের লোকসভা ভোটে এই তিনটি কেন্দ্রে বিজেপি লিড ধরে রেখেছে। সেই রায়গঞ্জ, রানাঘাট দক্ষিণ ও বাগদা কেন্দ্রে দলবদলু নেতাদের নাম আলোচনায় রয়েছে।

রায়গঞ্জে গতবার বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন কৃষ্ণ কল্যাণী। তিনি দলবদল করে এই লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রতীকে লড়েন। সেখানে হেরে যাওয়ার পর এখন তিনি উপনির্বাচনে লড়ছেন ঘাসফুলের প্রতীকে।

রানাঘাট দক্ষিণে একই ছবি। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে এখানে জেতেন মুকুটমণি অধিকারী। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে তিনি রানাঘাট লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন। এই ভোটে হেরে যাওয়ার পর তিনি ছেড়ে আসা বিধানসভায় এবার তৃণমূলের প্রার্থী।

বাগদা কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেন। গত মাসের লোকসভা ভোটে তিনি হেরে যান তৃণমূলের প্রতীকে লড়ে। যদিও বিশ্বজিৎ এই উপনির্বাচনে লড়ছেন না।

সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে ভারতের রাজনীতিতে সবাই শাসকের সঙ্গে থাকতে চায়। ফলে রাজনীতিতে সুবিধাবাদ নিয়ে যে আলোচনা হত বা আদর্শ যতটা গুরুত্ব পেত, সেটা এখন আর দেখা যায় না। এখন এই সুবিধাবাদী রাজনীতিকে সবাই একরকম মেনে নিয়েছে। আগে আয়ারাম গয়ারাম শব্দটা ব্যঙ্গ করে বলা হতো। কিন্তু এখন আর সেটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ নয়।"

১৩ জুলাই চারটি কেন্দ্রে ভোটগণনা হবে। কী হতে পারে ফলাফল? সুমন বলেন, "বিজেপির সাংগঠনিক ক্ষমতা কম বলে, তাদের কাছে আসন ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জের। তাই বিজেপির অনুকূলে যেটা ৩-১ রয়েছে, সেটা তৃণমূলের দিকে চলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।"