ঢাকার রেইনট্রি হোটেলে চার বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়৷ আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণার তারিখ মঙ্গলবার থাকলেও তা পিছিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী৷
বিজ্ঞাপন
ট্রাইবুনালের পিপি আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ ২ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার ছুটিতে আছেন, রায় প্রস্তুত হয়নি৷ রায়ের তারিখ পরে জানিয়ে দেওয়া হবে৷''
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে৷ ধর্ষিতা দুই তরুণীর অভিযোগ, ওই হোটেলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাতভর আটকে রেখে সাফাত ও নাঈম তাদের ধর্ষণ করেন৷ অন্য আসামিরা তাদের সহায়তা করেন৷
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলার আসামি পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল৷ আসামিদের জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয় ৩ অক্টোবর৷ রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২২ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর চার বছর আগের এই মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে৷
ধর্ষণ: কিছু ঘটনা ও দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশে প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় একাধিক ধর্ষণের খবর প্রকাশ হয়৷ কোনোটি আলোচিত হয়, কোনোটি আড়ালেই থেকে যায়৷ এই প্রবণতা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, বয়সের গণ্ডিতে আটকে নেই৷ শিক্ষা, ধর্ম, আইন কোনো কিছুই মানছেন না ধর্ষকরা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ক্ষমতার দাপট
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ তাকে ধর্ষণ করেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী৷ ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ এক মাস আগে ঘটলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অনিরাপদ পরিবহণ
২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আলোচিত হয়৷ তবে এর পরেও নারীদের জন্য গণপরিবহণ নিরাপদ হয়ে ওঠেনি৷ গত ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে এক বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর গণপরিবহণে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
নিরাপত্তাহীন সড়ক
২০২০ সালের পাঁচ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ বাস থেকে নামার পরপরই তাকে সড়কের পাশে তুলে নিয়ে যায় ধর্ষক মজনু৷ খোদ রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় এই ঘটনায়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
শিশুরাও ধর্ষণের শিকার
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের খবর উঠে আসছে৷ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর হিসাবে ২০২০ সালে ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এই সংখ্যাটি ৯৭৪৷ এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্য বা স্বজনরাও জড়িত৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বাদ নেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক গত দুই বছর প্রতিরাতে শিশু ছাত্রদের যৌন নিপীড়নে বাধ্য করতেন বলে স্বীকার করেছেন৷ নভেম্বরে কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় ১১ বছরের ছাত্রকে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ গত ১২ মার্চ রাজধানীতে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মসজিদের ইমাম গ্রেপ্তার হন৷ অক্টোবরে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দেড় হাজার নারী
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন৷ ২০১৯ সালে ১,৪১৩ জন নারী, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১,২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে৷ যদিও প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও বেশি বলে মনে করা হয়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
রক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে খুলনা রেলওয়ে থানায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে৷ একই বছর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে৷ গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ধর্ষণের মামলায় পুলিশের এক উপপরিদর্শককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অক্টোবরে রংপুরে পুলিশের এক এএসআইকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বিচারহীনতা
২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৫টি ধর্ষণ মামলা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে তারা দেখেছে প্রতিটি মামলাতেই আসামি ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছে৷ তিন জন অভিযুক্ত কারাগারে রয়েছেন, দুই জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় রয়েছে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের গ্রেফতার করা যায়নি৷ গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই তথ্য জানিয়েছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
সমাধান বিয়ে!
ধর্ষণের পর সালিশ বা আদালতের মাধ্যমে সমাধান হিসেবে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে হয়৷ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দায় পোশাকের?
ধর্ষণের হাত থেকে শিশু, বৃদ্ধ নিস্তার পাচ্ছেন না কেউ৷ বাদ নেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই৷ তবুও এই প্রবণতার জন্য কেউ কেউ নারীর পোশাককে কটাক্ষ করেন৷ ধর্ষণের জন্য ‘অশালীন পোশাককে’ দায়ী করে এক ভিডিও বার্তা দিয়ে সমালোচিত হন চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল৷ নভেম্বরে সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিলের আলোচনায় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে বক্তব্য দেন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
10 ছবি1 | 10
ধর্ষণের মামলাটি করার কয়েকদিনের মধ্যে সিলেট থেকে ১১ মে সাফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ গ্রেপ্তার হন অন্য আসামিরাও৷ এই ধর্ষণের ঘটনায় তুমুল আলোচনার মধ্যে আপন জুয়েলার্সের বিভিন্ন শাখায় শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযান শুরু হয় এবং বেআইনি সোনা পাওয়ায় দিলদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়৷
আসামি পক্ষের আইনজীবীদের মতে, ধর্ষণের মামলাটি সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার ইন্ধনে হয়েছে৷ মামলা হওয়ার কয়েক মাস আগে সাফাতের সঙ্গে পিয়াসার বিচ্ছেদ হয়৷ মামলা হয় পিয়াসা এবং তার সাবেক শ্বশুর দিলদারের মধ্যেও৷
সাফাতের সাবেক স্ত্রী পিয়াসা সম্প্রতি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে৷