আটক চার ব্লগারকে নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রধান এবং সংসদ সদস্য আন্দালিব রহমান পার্থ’র মন্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবীরা৷ তবে পার্থ বলেছেন, এটি তাঁর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং ‘পলিটিক্যালি’ করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
আটক ৪ ব্লগারকে সংবাদ মাধ্যমের সামনে হাজির করা নিয়ে যখন প্রতিবাদ হচ্ছে, তখন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন৷ তিনি সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ‘‘এই চার নাস্তিক ব্লগারকে শুধু সংবাদ মাধ্যমের সামনে হাজির নয়, তাদের নাকে খত দিয়ে কান ধরে উঠ বস করানো উচিত ছিল৷''
পার্থর এই বক্তব্যকে সংবিধান এবং আইন বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আটক ব্যক্তিদের ছবি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ না করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে৷ আর সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, আটক ব্যক্তিকে কোন ধরনের নির্যাতন এবং তার সঙ্গে কোন ধরনের অপমানজনক আচরণ করা যাবেনা৷''
হেফাজতের ১৩ দফা, অস্থির বাংলাদেশ
ঢাকায় শনিবার (০৬.০৪.১৩) মহাসমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম৷ ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে এই সমাবেশ করে তারা৷ হেফাজতের এসব দাবির বিপক্ষে অবস্থান অনেকের৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ
আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলোর হিসাবে শনিবারে ঢাকার মতিঝিলে জড়ো হন লক্ষাধিক মানুষ৷ হেফাজতে ইসলাম এর সমর্থক তারা৷ সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী এই সমাবেশ থেকে তাদের ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
কী আছে ১৩ দফায়?
শাহবাগের কথিত ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে যত ভাস্কর্য আছে সব ভেঙে ফেলা এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধের মতো দাবি রয়েছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
আক্রান্ত নারী সাংবাদিক
শনিবার মহাসমাবেশ চলাকালে হেফাজতে ইসলামের লোকজন ঢাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়৷ তারা হামলা চালিয়েছে একুশে টেলিভিশনের নারী সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর৷ পুরুষদের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন এই অজুহাত তুলে তারা শারমিনকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পেটায়৷ সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য সাংবাদিকের ওপর হামলার দায় অস্বীকার করেছে হেফাজত৷
ছবি: Getty Images
সমর্থন, ধন্যবাদ
হেফাজতের এই মহাসম্মেলনে সরাসরি সহায়তা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জোট সঙ্গী জাতীয় পার্টি৷ পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য হেফাজতে ইসলামকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর৷
ছবি: Reuters
‘নতুন কোন আইন নয়’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ইসলাম অবমাননার অভিযোগ বিচারের জন্য নতুন কোনো আইন করার পরিকল্পনা সরকারের নেই৷ একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে হাসিনা বলেন, ‘‘সরকার হেফাজতের সবগুলো দাবিই দেখবে৷ এর মধ্যে কোনোটি গ্রহণযোগ্য হলে তা পূরণ করা হবে৷ আর যেসব দাবি ‘গ্রহণযোগ্য নয়’, সেগুলো পূরণ করা হবে না৷’’
ছবি: dapd
‘দাবি মানার কোন কারণ নেই’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘হেফাজতের যে সব দাবি, তা মেনে নেয়ার কোন কারণ নেই৷ তারা দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়৷ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলাও ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে৷ এই হুমকিকে ভয় পায়না স্বাধীনতা এবং প্রগতির পক্ষের শক্তি৷’’
ছবি: AP
‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নারী স্বাধীনতা, প্রগতি, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, ঐতিহ্য ও বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি বিরোধী৷ তাদের দাবি মেনে নিলে দেশ অন্ধকার যুগে চলে যাবে৷ দেশে মোল্লাতন্ত্র চালু হবে৷ তা এদেশের মানুষ মানবেনা৷’’
ছবি: Reuters
নারী সমাজের প্রতিবাদ
নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং হেফাজতের নারী প্রগতি বিরোধী দাবির বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছেন নারী সমাজ৷ ঢাকায় একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশে তারা বলেছেন, বাংলাদেশকে মধ্য যুগে ফিরিয়ে নেয়ার চক্রান্ত সফল হবেনা৷ হেফাজত আর জামায়াত শিবির এক হয়ে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়৷ কিন্তু তাদের এই ষড়যন্ত্র কখনোই সফল হবেনা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে’
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা মনে করেন, হেফাজতে ইসলাম নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেশের অগ্রগতি রুখতে চায়৷ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘‘প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷’’
ছবি: REUTERS
ব্লগার গ্রেপ্তার
হেফাজতের শনিবারের মহাসমাবেশের আগেই অবশ্য ‘ইসলাম ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য ও কটূক্তি’র অভিযোগে চার ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ অনেকে মনে করেন, সরকার দৃশ্যত হেফাজতের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করতে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করছে৷ আরো কয়েকজন ব্লগারকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
অথচ পার্থ সেদিকে না গিয়ে একধাপ এগিয়ে বলেছেন, তাদের কান ধরে উঠ বস এবং নাকে খত দেয়া উচিত ছিল - যা দুঃখজনক এবং সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক হাফিজুর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘এই চার ব্লগারের ব্যাপারে পুলিশ শুরু থেকেই অগ্রহণযোগ্য কাজ করছে৷ তাদের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার পরও ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করেছে৷ আর গ্রেফতারের সতের দিন পর মামলা করেছে যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷''
আটক ৪ ব্লগারের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আন্দালিব রহমান একজন আইনজীবী এবং সংসদ সদস্য৷ আটক ৪ ব্লগার যে নাস্তিক তা আদালতে এখনো প্রমাণ হয়নি৷ তারা যে ধর্মের অবমাননা করেছেন তাও প্রামাণ হয়নি৷ প্রমাণ হওয়ার আগেই ৪ জনকে নাস্তিক বলে তিনি আইনজীবী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্বজ্ঞানহীতার পরিচয় দিয়েছেন৷''
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘‘পার্থ তাঁর মন্তব্যের মাধ্যমে ঘৃণার সৃষ্টি করেছেন৷ আর তাদের নাকে খত ও কান ধরে ওঠ বস করানোর কথা বলে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন৷ যা খুবই দুঃজনক৷ তিনি না জেনে না শুনে রাজনৈতিক কারণে মন্তব্য করে নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারেন না৷''
তবে আন্দালিব রহমান পার্থ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কান ধরে উঠ বস এবং নাকে খত দেয়ার কথা বলে তিনি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন৷ তিনি সব ব্লগারকে নাস্তিক বলেননি৷ আটক ৪ জনকে বলেছেন৷ আর একথা বলেছেন ‘পলিটিক্যালি'৷ কেউ নবীজীকে নিয়ে অবমাননাকর কিছু করলে স্বাভাবিকভাবেই যেকোন মুসলমান ক্ষুব্ধ হবেন৷ তিনিও হয়েছেন৷''
উল্লেখ্য, আটক ৪ ব্লগার যে ‘নাস্তিক বা ধর্মের অবমাননা করেছেন' তা পত্রিকা থেকে জেনেছেন পার্থ৷ তিনি নিজে তাদের ব্লগ পড়েননি বলে স্বীকার করেছেন৷