কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ জমি সেচের জল পাবে না। হবে না ফসল।
বিজ্ঞাপন
ইউক্রেনের কৃষি মন্ত্রী জানিয়েছেন প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে জল যেত কাখোভকা বাঁধের রিজার্ভার থেকে। বাঁধটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে সমস্ত জল বার হয়ে বন্যা হয়েছে। এবার খরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওই বাঁধ থেকে যে জমিতে জল যেত, সেখানে আর জল পৌঁছাবে না। ফলে ওই জমিগুলি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যাবে বিশ্ব বাজারে। খাদ্যশস্যের দাম বাড়বে। খাদ্যের অভাবও তৈরি হতে পারে। ইউক্রেনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, ওই অঞ্চলের জমিতে চার মিলিয়ন টনের খাদ্যশস্য এবং তেলের বীজ তৈরি হতো। যার বাজারমূল্য সব মিলিয়ে এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই বাজারটি এবার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।
ইউক্রেনে বাঁধে হামলা: ভেসে গেছে খেরসন
কাখোভকা বাঁধে হামলার দায় এখনো একে অপরের ওপর চাপাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন৷ হামলার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের খেরসন শহর ভেসে গেছে৷ শুক্রবার পর্যন্ত কমপক্ষে ৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ৷ অন্তত ১৩ জন নিখোঁজ৷
ছবি: Libkos/AP Photo/picture alliance
ভেসে গেছে খেরসন
গত মঙ্গলবার ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের খেরসন রাজ্যে দেনিপার নদীর ওপর কাখোভকা বাঁধে হামলা করা হয়৷ এতে বাঁধের পানিতে ভেসে যায় খেরসন অঞ্চল৷ বেশ কয়েকটি মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়৷ এমনকি নিখোঁজও হন অনেকে৷
ছবি: Planet Labs PBC via AP/picture alliance
উদ্ধার কার্যক্রম
খেরসনের অন্তত ১৭টি শহরের ২২ হাজারের বেশি ঘর ভেসে গেছে৷ চলছে উদ্ধার কার্যক্রম৷
ছবি: Genya Savilov/AFP
আরো দশদিন চলবে
কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্যার পানি সহসা কমবে না৷ আরো অন্তত দশদিন এই এলাকাগুলো প্লাবিত হতে থাকবে৷
ছবি: Libkos/AP Photo/picture alliance
দোষারোপ চলছেই
শুরু থেকেই ইউক্রেন ও রাশিয়া একে অপরকে এই হামলার জন্য দায়ী করে আসছে৷ সেখানে যোগ দিয়েছে তাদের মিত্র দেশগুলোও৷
ছবি: Ukraine Presidency/AFP
‘বোমা হামলা নয়, বিস্ফোরকের ব্যবহার’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দপ্তরের প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, বোমা হামলা নয়, বাঁধ ধ্বংসে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে৷
ছবি: European Union
নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি সররবাহ
ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক কেন্দ্রটি রয়েছে এখানে৷ সেটি ঠান্ডা করার জন্য পানি সরবরাহ হয় এই বাঁধ থেকে৷ তবে এখন পর্যন্ত পারমাণবিক কেন্দ্রে পানি সররবাহে ঘাটতি হয়নি৷
সমস্যার সূত্রপাত আগেই। পূর্ব ইউরোপের এই অঞ্চলের বেশ অনেকটা অংশ আগেই রাশিয়া দখল করেছিল। গত দেড় বছর ধরে সেখানে লাগাতার যুদ্ধ চলছে। ফলে বহু চাষী জমি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। গত বছরেও তারা নিজেদের জমিতে ফসল ফলাতে পারেননি। যুদ্ধের জন্য বহু খেত নষ্ট হয়েছে। তারই মধ্যে মিসাইলের আঘাতে বাঁধটি ভেঙে যায়। এই বাঁধের জল পূর্ব ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ চাষের জমিতে যেমন সেচের জল পৌঁছে দেয়, ঠিক তেমনই ২০১৪ সালে রাশিয়ার দখল করা ক্রাইমিয়া অঞ্চলেও জল পৌঁছে দেয়। বাঁধ ভাঙার ফলে ক্রাইমিয়ার কৃষকেরাও জল পাবেন না।
ভ্যাসাইল নিজের সম্পূর্ণ নাম জানাতে রাজি হননি ডয়চে ভেলের সাংবাদিককে। খেরসনের এই চাষি এখন নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার বাবা-মা এখনো সেখানেই আছেন। ভ্যাসাইল জানিয়েছেন, ২০২২ সালে রাশিয়া আক্রমণ চালানোর কিছুদিনের মধ্যেই তাদের এলাকা রাশিয়ার দখলে চলে যায়। রাশিয়ার সেনা জানিয়ে দেয়, সমস্ত জমি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করা হবে। অত্যাচারের ভয়ে সে সময়েই তারা পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধ বাবা-মা-কে নিয়ে আসতে পারেননি। ভ্যাসাইল স্পষ্টই জানিয়েছেন, গ্রামে ফিরে যেতে পারলেও তার বিরাট জমিতে এরপরে চাষ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।য কারণ, সেচের জল মিলবে না। আর জল ছাড়া ফসল ফলবে না।
এবার মস্কোর আবাসিক এলাকাতেও ড্রোন হামলা
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো মস্কোর আবাসিক এলাকায় ড্রোন হামলা হয়েছে৷ ইউক্রেন এই হামলা চালায়নি বলে দাবি করেছে৷ পুটিন বলছেন, এই হামলার মাধ্যমে রাশিয়াকে ভয় দেখানো ও উসকানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: Maxim Shemetov/REUTERS
প্রথমবার হামলা
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো মস্কোর আবাসিক এলাকায় ড্রোন হামলা হয়েছে৷ তবে এতে কেউ মারাত্মকভাবে আহত হননি বলে রুশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷ তবে কয়েকটি আবাসিক ভবনে ‘সামান্য’ ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তারা৷ এর আগে চলতি মাসে ক্রেমলিনের উপর দুটো ড্রোন রুখে দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: Kirill Kudryavtsev/AFP/Getty Images
৮টি ড্রোন
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, মস্কোতে আটটি ড্রোন দিয়ে হামলা করা হয়৷ এর মধ্যে কিছু ভূপতিত ও কিছু ড্রোনের দিক পরিবর্তন করে দেয়া হয়৷ অভিজাত এলাকা দক্ষিণ-পশ্চিম মস্কোর দুটি উঁচু আবাসিক ভবনে দুটি ড্রোন ভেঙে পড়ে৷ আরেকটি, অন্য এলাকার এক ভবনে কিছুটা ক্ষতি করেছে৷ বাকিগুলো মস্কোর বাইরে পড়েছে৷ অবশ্য রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘বাজা’য় ২৫টির বেশি ড্রোনের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: Lev Sergeev/REUTERS
অকল্পনীয়
মস্কোর স্থানীয় কিছু ব্যক্তি বলছেন, তারা কখনও ভাবেননি যে রাশিয়ার রাজধানীতে এমন হামলা হতে পারে৷ মস্কোর দক্ষিণ-পশ্চিমের পেনশনভোগী তাতিয়ানা কালিনিনা এএফপিকে বলেন, ‘‘আমি ভেবেছিলাম এসব অনেক দূরে ঘটে৷ এগুলো আমাদের পর্যন্ত আসবে না৷ কিন্তু এখন হঠাৎ করেই এগুলো এত কাছে চলে এসেছে৷’’ ছবিতে মস্কোতে হামলা করা একটি ড্রোনের অংশ দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Alexander Shcherbak/Tass/picture alliance
ইউক্রেনের অস্বীকার
ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ট কর্মকর্তা মিখাইলো পোডোলিয়াক মস্কোয় ড্রোন হামলার সঙ্গে কিয়েভের সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন৷ তবে ‘এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তারা আনন্দিত’ এবং ভবিষ্যতে এমন হামলা আরও হতে পারে বলে জানিয়েছেন৷ ছবিতে ড্রোন হামলার পর মস্কোর এক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের বাইরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Evgenia Novozhenina/REUTERS
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন মঙ্গলবার বলেন, মস্কোতে ড্রোন হামলার মাধ্যমে রাশিয়াকে ভয় দেখানো ও উসকানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷ মস্কোর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করেন তিনি৷ এদিকে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ বুধবার বলেন, মস্কোতে ড্রোন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ‘নিন্দা না জানানোর’ বিষয়টি রাশিয়া খেয়াল করেছে৷
ছবি: Gavriil Grigorovvia/Kremlin/Sputnik via REUTERS
হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া
মস্কোতে ড্রোন হামলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে জানিয়ে হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব কারিন জ্য-পিয়ের বলেন, ‘‘আমরা রাশিয়ার ভেতরে হামলা সমর্থন করি না৷ দ্যাটস ইট৷ পিরিয়ড৷’’ ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেয়া দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র৷ তবে তাদের শর্ত হচ্ছে, এগুলো শুধু নিজেদের প্রতিরক্ষার কাজে এবং রাশিয়ার দখল করা এলাকা মুক্ত করতে ব্যবহার করা যাবে৷
ছবি: Mandel Ngan/AFP
কিয়েভে টানা তৃতীয় দিন হামলা
মঙ্গলবার কিয়েভে রাশিয়া টানা তৃতীয় দিনের মতো ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালিয়েছে৷ ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার নিক্ষেপ করা ৩১টির মধ্যে ২৯টি ড্রোন ভূপতিত করা হয়েছে৷ ছবিতে মঙ্গলবার কিয়েভে রাশিয়ার ড্রোন হামলার পর একটি ভবনে আগুন দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Kyiv City Military Administration/Handout/REUTERS
রাশিয়ার তেল শোধনাগারে ড্রোন হামলা
রাশিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষ্ণসাগরের পাশে অবস্থিত তেল রপ্তানি করতে ব্যবহৃত দেশটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল নভোরোসিস্ক বন্দর থেকে ৬৫-৮০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত দুটি তেল শোধনাগারে বুধবার ড্রোন হামলা হয়েছে৷ হামলার কারণে একটিতে আগুন ধরেছে, অন্যটিতে কোনো ক্ষতি হয়নি৷ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা রিয়া এই তথ্য জানিয়েছে৷ মস্কোয় ড্রোন হামলার পরদিন এই হামলা হলো৷ উপরের ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
গোটা ইউক্রেনের মোট জমির পরিমাণের মাত্র দুই শতাংশ আছে ওই অঞ্চলে। কিন্তু ইউক্রেনের মোট ফসলের ১২ শতাংশ তৈরি হয় সেখানে। খেরসন অঞ্চলে মাটি উর্বর। সেখানে সবচেয়ে ভালো হয় আনাজপাতি। ওই অঞ্চলের টমেটো বিশ্ববিখ্যাত। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আগামী কিছুদিনের মধ্যে এর প্রভাব বোঝা না-ও যেতে পারে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে প্রভাব পড়তে শুরু করবে। খাদ্যশস্যের দাম তিন শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তার চেয়েও বড় সমস্যা, ইউক্রেন পরিমাণমতো খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে পারবে না। ফলে আফ্রিকা এবং ইউরোপের দেশগুলি ফের খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। বস্তুত, এর প্রভাব পড়তে পারে কৃষ্ণসাগরীয় চুক্তিতেও। ইউক্রেন এবং রাশিয়া তুরস্কের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগরের বাণিজ্যপথ খুলে রাখার চুক্তি করেছে। সেই চুক্তিতেও প্রভাব ফেলতে পারে এই ঘটনা।
কাখোভকা বাঁধে কারা আক্রমণ চালিয়েছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দুই দেশই অপরের দিকে আঙুল তুলেছে।