৭ ফুট বাই ১৪ ফুট ঘরে পুরো পরিবারের বাস, শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়েতো ভাবার সুযোগই নেই৷ উপরন্তু দ্রব্যমূল্য পাল্লা দিয়ে বাড়লেও তাঁদের বেতন সেভাবে বাড়ে না৷ এভাবে নানা বঞ্চনা নিয়ে দুর্দশার জীবন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা৷
বিজ্ঞাপন
একরকম দাসের মতো জীবন কাটালেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উৎপাদন ধরে রেখেছেন চা শিল্পীরা৷ তাই জীবন সম্পর্কে শুধু আক্ষেপই ঝরে তাঁদের কণ্ঠে৷
‘‘চা বাগানের মানুষের জীবন কষ্টে-দুর্দশায় যায়৷ মানুষ মনে করে যে, আমাদের এই রকমই দিন যাবে,'' ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন মৌলভীবাজারের করিমপুর চা বাগানের নারী শ্রমিক কাজল রায়৷ ‘‘সারাজীবন কষ্ট করে করে আমাদের দিন পার করব, যাওয়ার তো আর কোনো জায়গাও নাই৷ আর কোনো কিছু করারও নেই আমাদের৷ ভাবতে ভাবতে এরকমই তাঁরা জীবনযাপন পার করে৷''
বেতন বৈষম্য, বাসস্থান আর শিক্ষা-চিকিৎসার দুরবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে স্বর নেমে আসে কাজল রায়ের
বেতন বৈষম্য, বাসস্থান আর শিক্ষা-চিকিৎসার দুরবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে এভাবে স্বর নেমে আসে কাজল রায়ের৷ করিমপুরের চা বাগানে প্রায় ১৮ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি৷
বাংলাদেশে চা বোর্ডের নিবন্ধিত ১৬৬টি চা বাগানে কাজ করেন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক৷ একটি বড় রপ্তানি খাতের চাকা চালু রাখলেও তাঁদের বেশিরভাগেরই গল্প কাজল রায়ের মতোই৷
১৮ বছর আগে কাজল রায় যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখন শ্রমিকদের বেতন ছিল দৈনিক ২২ টাকা৷ সময়ের ধারাবাহিকতায় তা ১০২ টাকা হলেও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে পেরে উঠছেন না বলে জানান তিনি৷
চায়ের দেশ মৌলভীবাজার
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চা বাগান আছে মৌলভীবাজার জেলায়৷ ফলে ঢাকা থেকে প্রায় ২১০ কিলোমিটার দূরের এই চায়ের রাজ্য এখন বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য৷
ছবি: DW/M. Mamun
একটি কুড়ি দু’টি পাতা
একটি কুড়ি দু’টি পাতা, রতনপুর বাগিচায়....চা বাগান নিয়ে ভুপেন হাজারিকার বিখ্যাত সেই গান৷ মৌলভীবাজারে মোট ৯২টি চা বাগান আছে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ফিনলে, মিতিংগা, ডানকান, শাহবাজপুর, সাতগাঁও, মাইজদিহি, মাথিউরা ও রাজনগর৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভাস্কর্য ‘চা কন্যা’
ঢাকা থেকে সড়কপথে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রবেশের আগে দৃষ্টিনন্দন এই ভাষ্কর্যটি দেখা যায়৷ সাতগাঁও চা বাগানের সহায়তায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন এটি তৈরি করেছে৷ এর সামনেই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে সাতগাঁও চা বাগান৷
ছবি: DW/M. Mamun
শ্রীমঙ্গলের চা বাগান
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় আছে বেশ কিছু চা বাগান৷ ছোট্ট এই শহরকে পেছনে ফেলে ভানুগাছা সড়ক ধরে এগিয়ে যেতে দুই ধারে শুধুই চা বাগান চোখে পড়ে৷ এই পথে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) ভেতর থেকে দক্ষিণমুখী সড়কটি ধরে গেলে ফিনলের চা বাগান ছাড়াও আছে বিটিআরআই-এর নিজস্ব বাগান৷ এছাড়া ভানুগাছা সড়কের গ্রান্ড সুলতান রিসোর্টের সামনে থেকে হাতের ডানের সড়ক ধরে কয়েক কিলোমিটার গেলে পাওয়া যাবে জেরিন টি এস্টেট৷
ছবি: DW/M. Mamun
কুড়ি সংগ্রহের মৌসুম
সাধারণত এপ্রিল মাস থেকে এই মৌসুম শুরু হয়৷ চা বাগান ভ্রমণের এটিই উত্তম সময়, কেননা এই সময় চা বাগানের সৌন্দর্য ছাড়াও চা শ্রমিকদের ব্যস্ততা দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
লেক ঘেরা চা বাগান
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড় ঘেরা চা বাগানের মাঝে বিশাল এক হ্রদ ‘মাধবপুর লেক’৷ এ পথে যাবার সহজ পথ নূরজাহান টি এস্টেটের পথ ধরে৷ তাহলে পুরো পথেই চোখ জুড়ানো চা বাগান দেখা যাবে৷ মাধবপুর লেকের চারপাশের এ বাগানটি বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল টি কোম্পানির বাগান৷
ছবি: DW/M. Mamun
শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগান
মাধবপুর লেক থেকে সামনে গেলেই বেসরকারি মালিকানাধীন শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগান৷ এ বাগানটির পেছনেও সুন্দর একটি লেক আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ
মাধবপুর লেকের সামনের সড়কটি ইতি টেনেছে ধলই সীমান্তে৷ এ পথের দু’ধারেই সমতল চা বাগান৷ সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সীমান্ত ফাঁড়ির পাশেই এই স্মৃতিসৌধ অবস্থিত৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাগানঘেরা দীর্ঘ পথ
ধলই সীমান্তে ধলই চা-বাগানের ভেতর থেকে পশ্চিমমুখী সরু সড়কটি অনেকগুলো চা বাগানের ভেতর দিয়ে শ্রীমঙ্গলে এসে থেমেছে৷ ছায়াঢাকা এ পথটি যে কোনো পর্যটকের কাছেই আকর্ষণীয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা শ্রমিকদের কষ্টের জীবন
দিন শেষে নিজেদের সংগ্রহ করা পাতা নিয়ে পরিমাপের জন্য যাচ্ছেন চা শ্রমিকরা৷ চা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বর্তমান বাজারের তুলনায় খুবই কম৷ বর্তমানে সারাদিন কাজ করে একজন শ্রমিক পাঁচ তারকা হোটেলের এক কাপ চায়ের মূল্যের সমানও পারিশ্রমিক পান না৷
ছবি: DW/M. Mamun
বেশিরভাগই নারী
চা শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী৷ এ সব শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে কোনো স্বাধীনতা নেই৷ বাগানের মধ্যে নেই ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রমও৷
ছবি: DW/M. Mamun
জুড়ির চা বাগান
মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলাতেও আছে বেশ কয়েকটি চা বাগান৷ এ বাগানগুলোও বেশ সুন্দর৷
ছবি: DW/M. Mamun
রাবার বাগান
চা বাগানের পাশাপাশি মৌলভীবাজার জেলায় আছে বেশ কিছু রাবার বাগান৷ এ সব বাগানে গেলে দেখা যাবে গাছ থেকে রাবার সংগ্রহের কৌশল৷
ছবি: DW/M. Mamun
মৌসুমি ফল চাষ
শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছা সড়ক ধরে নানান ফলমূল নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন কৃষকরা৷ শ্রীমঙ্গলে চা বাগানের পাশাপাশি টিলাগুলোতে বিভিন্ন মৌসুমি ফলমূলও চাষ করেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
13 ছবি1 | 13
প্রতি সপ্তাহে চা বাগান থেকে সাড়ে তিন কেজি চাল কিংবা আটা এবং সন্তানের জন্য এক কেজি চাল কিংবা আটা রেশন হিসাবে পান কাজল৷ এর সঙ্গে স্থানীয় রাবার বাগানের শ্রমিক স্বামীর আয় মিলিয়ে কোনোমতে সংসার চলে যাচ্ছে তাঁদের৷ এর মধ্যেও চার মেয়ের তিন মেয়েকে পড়াশোনা করাতে পারায় নিজেকে অন্য অনেক চা শ্রমিকের চেয়ে সৌভাগ্যবানই মানছন তিনি৷
‘‘সপ্তাহে ৭১৪ টাকা পাই৷ কয় টাকায় চাল কিনবে, তারপরে তেল, সাবান, বাচ্চাকাচ্চাদের লেখাপড়া৷ অনেক কষ্টের মধ্যে চা বাগানের মানুষ চলে, তারপরেও লেখাপড়া করাতে হয় বাচ্চাদের,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন কাজল৷
৭ বাই ১৪ ফুটের ঘরে থাকার কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কোম্পানির যে ঘর, তাতে দুইজন মানুষের থাকতেই কষ্ট হয়৷ এর মধ্যে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে থাকতে আরো কষ্ট৷ কারো বাচ্চা তিনটা, কারো ৪টা৷''
গত বছর চা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মালিকদের চুক্তির ফলে দৈনিক বেতন ১০২ টাকা দাঁড়ায় শ্রমিকদের৷ ওই ১০২ টাকা পেতে প্রতিদিন ২০ কেজি করে চা পাতা তুলে দিতে হয়৷ তবে কোনো কোনো চা বাগান ২০ কেজির চেয়েও বেশি তুলতে বাধ্য করে বলে জানালেন শ্রমিকরা৷
সংগঠনের তরফ থেকে ৩০০ টাকা দাবি করলেও ১০২ টাকায় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে: দীপংকর রায়
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপংকর রায় জানান, ২০১৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী ৮ ঘন্টা শ্রম দিলে ১০২ টাকা করে দেয়া হয়৷ কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় ওই ১০২ টাকার জন্য ২৪ থেকে ২৬ কেজি পাতা তুলতেও বাধ্য করে৷
‘‘চুক্তিতে কিছু ফাঁক রেখে দিয়েছে মালিকপক্ষ ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা৷ যেখানে চা বাগানের পঞ্চায়েতরা দুর্বল, সেখানে প্রেসার দিয়ে ২০ কেজি থেকে ২৪ কেজি নিচ্ছে৷ গত বছরের চুক্তিতে ফাঁক রেখে দিয়েছে, মালিকপক্ষ চাইলে নিরিখ বাড়াতে পারে'', ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
তিন পুরুষ ধরে চা বাগানে কাজ করছে দীপংকরের পরিবার৷ শ্রমিক হিসাবে দাদা ও বাবা অবসরে যাওয়ার পর তিনিও এ পেশায় এসেছেন৷ ব্রিটিশ আমলে মাদ্রাজ থেকে এসে এখানকার চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন তাঁর পূর্বপুরুষরা৷
মালিক কাটে ৭টাকা, শ্রমিককে দেন দেড় টাকা
বাগানে নির্দিষ্ট ওজনের কম-বেশি চা তুললে টাকা কেটে নেওয়া এবং মজুরি দেওয়ার কার্যক্রম চালু আছে৷ এক্ষেত্রে মালিক আর শ্রমিকের জন্য ভিন্ন নিয়ম চালু আছে৷
চা শ্রমিক কাজল রায় জানান, তাঁর কর্মস্থল ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন করিমপুর চা বাগানে ২০ কেজির মানদণ্ডেই চা তুলতে হয়৷ কিন্তু বেশি তুললে প্রতি কেজিতে শ্রমিকদের দেওয়া হয় দেড় টাকা করে৷ আর কমের জন্য প্রতি কেজিতে কেটে নেওয়া হয় সাত টাকা করে৷
বাগান থেকে ‘চা’-এর কাপে আসার গল্প
শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে চোখ জুড়ানো বেশ কিছু চা বাগান৷ সেসব বাগানের চা বাগান থেকে কিভাবে চায়ের কাপে আসে তারই গল্প থাকছে এই ছবিঘর-এ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা বাগান
চা বোর্ডের হিসেবে পুরো বাংলাদেশে চা বাগান রয়েছে মোট ১৬২টি৷ তার মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাগানসহ মৌলভীবাজার জেলায় মোট বাগানের সংখ্যা ৯০টির মতো৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা শ্রমিক
সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে চা শ্রমিকরা পাতা তুলতে শুরু করেন৷ যাঁর চা পাতার ঝুলির ওজন বেশি হয়, তিনি পারশ্রমিক বেশি পান৷ তাই তাঁদের মধ্যে সব সময় এক ধরনের তাড়া কাজ করে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা কন্যা
চা শ্রমিকদের মধ্যে নারীই বেশি৷ চা শ্রমিক, চা শিল্পী, চা কন্যা বা পাতিয়ালী – যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, তাঁরা কঠোর পরিশ্রমী৷
ছবি: DW/M. Mamun
এবার মাপার পালা
পাতা তোলার পর কে কতটা তুলেছেন তা মাপা হয় বাগানেরই কাছের ছোট এক কুটিরে৷ চা পাতার ওজন অনুপাতেই শ্রমিকরা তাঁদের পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন৷ পাতা মাপার পর এক ফাঁকে ঝটপট বাড়ি থেকে নিয়ে আসা নাস্তাটা তাঁরা সেরে নেন৷ আবার যে বাগানে যেতে হবে !
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
কারখানায় যাচ্ছে পাতা
মাপার পর এবার পাতা যাচ্ছে চা কারখানায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
পাতা বহমান
কারখানায় পৌঁছানোর পর ছোট ছোট ব্যগে করে ইলেক্ট্রিক মেশিনের সাহায্যে ঘুরে ঘুরে পাতা যাচ্ছে আরেক জায়গায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
ছড়ানো পাতা
এখানে পাতাগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ভালো করে পরিস্কার করে বেছে নেওয়া হবে৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
পাতার সোঁদা গন্ধ
পাতা পরিস্কারের পর এবার যাচ্ছে মেশিনে৷ কয়েকটি মেশিনে একসাথে কাজ হচ্ছে৷ মেশিনে ‘প্রসেস’ হওয়ার সময় সবুজ পাতা কেমন যেন এক সোঁদা আর মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
বদলে যায় রং
এবার চা পাতা শুকানোর পালা৷ এরই মধ্যে এই মেশিনের গরম তাপে চা পাতার রং বদলে গিয়ে গাঢ় বাদামী হয়ে গেছে৷ চা বাগানে ঘোরাঘুরির পর তৈরি গরম চায়ের গন্ধ, চেহারা আর হাত দিয়ে ধরে দেখার অনুভূতি কিন্তু চা প্রেমীদের কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর !
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
গুণগত মান পরীক্ষা
গুড়ো চা শুকিয়ে যাবার পর এবার গুণগত মান পরীক্ষার পালা৷ চা টেস্টের পর সব ঠিক থাকলেই কেবল তা বড় বড় বস্তায় ভরে প্যাকিং এবং রপ্তানির জন্য পাঠানো হয় চট্টগ্রামে৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
শেষ ধাপ: ‘চা’ এলো কাপে
চট্টগ্রামের কারখানা থেকে প্যাকেট হয়ে বাজারে আসে চা৷ তারপর তো দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সেই চা আমাদের কাপে৷ ‘চা’-এর তুলনা শুধু চা-ই৷
ছবি: DW/N. Sattar
সব সময়ের সঙ্গী ‘চা’
উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় ‘চা’৷ ফিনলে চা কারখানার দেয়ালে লাগানো বোর্ডের এই কথাগুলো কতটা সত্যি, তা মনে হয় যে কোনো চা প্রেমীই জানেন৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
12 ছবি1 | 12
‘‘ (বেশি পাতা তুললে প্রতি কেজির জন্য) দেড় টাকা দেয়৷ আর কম হলে প্রতি কেজিতে ৭ টাকা কেটে নেয়৷ আমাদের সবক্ষেত্রে ঝামেলা৷ চা বাগানের মানুষের সবক্ষেত্রেই কষ্ট'', নিজেদের অবস্থার বোঝাতে গিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন কাজল রায়৷
শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দুরবস্থা
চা শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা দীপংকর রায় বলেন, ‘‘বর্তমানে চা বাগানে শিশু শ্রম অনেকাংশে কমলেও শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ তেমন নেই৷ ১৬ থেকে ১৭টি চা বাগানে সরকারি প্রাইমারি স্কুল আছে৷ ২০০৮ সালে ছিল ৬টি৷ আন্দোলনের কারণে ১৪টা হয়েছে৷ সবখানে মালিকদের নিজস্ব মেকানিজম দাঁড় করায়৷ ক্লাস বা পড়াশোনার কোনো গুরুত্ব থাকে না৷ আর তিনশ' জন স্টুডেন্টকে তো এক বা দুইজন শিক্ষক দিয়ে পড়ানো সম্ভব না৷''
নিজস্ব চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা তেমন না থাকায় ডাক্তার দেখাতে হলে তাঁদেরকে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা থেকে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও যেতে হয় বলে জানান কাজল রায়৷ ‘‘অসুস্থ হলে সিলেট ওসমানী মেডিকেলে নিয়ে যেতে হয়৷ যেতেই ৭-৮শ' টাকা খরচ হয়ে যায়৷ চিকিৎসাতো পরের বিষয়৷''
শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে শ্রমিক নেতা দীপংকর বলেন, ‘‘আমাদের দেশে চা শ্রমিকদের অবস্থা খুবই করুণ৷ তারা প্রতিদিন যে শ্রম দেয়, শ্রমের বিনিময়ে যে ১০২ টাকা পায়, বর্তমান বাজারের যে অবস্থা, তাতে খুবই কষ্টের মধ্যে এদের জীবন যায়৷ ১০২ টাকা তো এমনিতে প্রতিদিন খরচ হয়ে যায়৷ আমরা আমাদের সংগঠনের তরফ থেকে ৩০০ টাকা দাবি করেছিলাম৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০২ টাকায় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে৷''
চা শিল্পীদের জীবন যেমন
সস্তা পানীয় চা৷ সেই পানীয়ের তৃপ্তি দিতে সবচেয়ে সস্তায় শ্রম দেন তাঁরা৷ তাঁরা চা শ্রমিক৷ চা শিল্পের প্রকৃত শিল্পী৷ তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি
চা গাছের এমন দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি থেকেই আমরা পাই সুপেয় চা৷ বাংলাদেশে এক সময় শুধু বৃহত্তর সিলেট জেলাতেই চা বাগান ছিল৷ সিলেটের অন্য নাম তাই ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ’৷ ধীরে ধীরে বাংলাদেশে চায়ের রাজ্য বেড়েছে৷ চা বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী, এখন মোট ১৬২টি চা বাগান রয়েছে বাংলাদেশে৷ এর মধ্যে ৯০টি মৌলভীবাজার জেলায়, ২৩টি হবিগঞ্জ, ১৮টি সিলেট, ২১টি চট্টগ্রাম এবং বাকি ৯টি পঞ্চগড় জেলায়৷
ছবি: Khukon Singha
চা শিল্পী
তাঁদের অক্লান্ত শ্রমেই গড়ে ওঠে চা বাগান, বাগান থেকে তাঁদের হাতই তুলে আনে ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি’, তাঁদের শীর্ণ পিঠে চড়েই কারখানায় যায় সোঁদা গন্ধের পাতার বোঝা৷ তাঁরা চা শ্রমিক৷ চা শিল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পীও তাঁরা৷ বাংলাদেশে এমন ‘শিল্পী’ এখন ১ লাখ ২২ হাজারের মতো৷
ছবি: DW/K. Thaunaujam
বেশি ঘাম, অল্প আয়
চা শিল্পের সূচনালগ্নে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই৷ তিন দশক আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলেও চা শিল্পের বিস্তারের সঙ্গে শ্রমিকের অবস্থার উন্নতির দৃষ্টিকটু পার্থক্যটা স্পষ্ট হবে৷ তিন দশক আগে একজন চা শ্রমিক পাহাড়ি বাগানের রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সারাদিনের কাজ শেষে পেতেন সাত টাকা, এখন ‘হাজিরা’ বা মজুরি ৮৫ টাকা৷ এই দুর্মূল্যের বাজারে চা শ্রমিকের মাসিক আয় দু’হাজার টাকার চেয়ে সামান্য বেশি৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
‘লেবার লাইনের’ ঘুপচি
চা বাগানেই চা শ্রমিকদের বাস৷ বাগানের ‘লেবারার’, অর্থাৎ শ্রমিকেরা এক পাড়ায় থাকেন বলে পাড়ার নাম হয়ে গেছে ‘লেবার লাইন’৷ ৮ হাত বাই ১২ হাতের এক টুকরো জমির ওপর গড়ে তোলা মাটির ঘরে গাদাগাদি করে থাকে শ্রমিক পরিবার৷ কোনো কোনো পরিবারে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য৷ ওই ৮ বাই ১০ বাই ১২ হাতের জায়গাটুকুই কিন্তু সম্বল!
ছবি: Khukon Thaunaujam
শিশু শিক্ষায় শত দুর্ভোগ
২০০৭ সালেও চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র ৩৫ টাকা৷ এখন তা বেড়ে ৮৫ টাকা হয়েছে৷ এ আয়ে সংসারই চলে না, সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবেন কী! কোনো কোনো বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে৷ অনেকগুলোরই ছাদ আছে তো, দেয়াল নেই৷ প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকও অনেক কম৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
চিকিৎসাসেবা
বেশির ভাগ বাগানে শ্রমিকের চিকিৎসার সুব্যবস্থাও নেই৷ জটিল রোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা, সর্দি-জ্বারের চিকিৎসাও সময়মতো পাওয়া মুশকিল৷ হাসপাতালের বারান্দায় বসে ডাক্তারের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে গুণতেই বেলা বয়ে যায়৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
উৎসবের আনন্দে
রিলে, হাজরা, হারাম, সাঁওতাল, সাধু, টগর, মুন্ডাসহ অনেকগুলো নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছে চা শ্রমিকদের মাঝে৷ তাই ছোট-বড় নানা ধরণের উৎসব লেগেই থাকে সারা বছর৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
টিকে থাকার সংগ্রাম
চা বাগানের মজুরিতে সংসার চলে না বলে বাড়তি উপার্জনের জন্য শ্রমিকদের অবসর সময়েও কিছু না কিছু করতে হয়৷ ঘরে তৈরি বিভিন্ন পণ্য বাজারে বিক্রি করেও দ্রব্যমূ্ল্যের ঊর্ধগতির সময়ে টিকে থাকছেন অনেকে৷
ছবি: Khukon Thaunaujam
পরের জায়গা পরের জমি...
দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে চা-বাগান সংলগ্ন জমিকেই নিজের জমি মনে করে সেখানে বংশ পরম্পরায় চাষবাষ করে আসছে শ্রমিক৷ সেই জমিও হাতছাড়া হলে ৮৫ টাকা মজুরির শ্রমিক বাঁচবে কী করে? গত বছর তাই বাগানের লিজ নেয়া জমিতে সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করার পরিকল্পনা করায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল হবিগঞ্জের কয়েকটি বাগানের শ্রমিক৷ মৌলভীবাজার এবং সিলেটের অনেক শ্রমিকও যোগ দিয়েছিল ভূমি রক্ষার সে আন্দোলনে৷