‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে' কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে আপাতত ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চা শ্রমিক ইউনিয়ন৷ তবে চা শ্রমিকদের দাবিগুলো বিবেচনার জন্য লিখিত আকারে প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করা হবে৷
বিজ্ঞাপন
রোববার রাতে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের এক বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়৷ তাতে বলা হয়, মজুরি বাড়ানোর দাবি নিয়ে শ্রমিকরা দুর্গাপূজার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলবেন, যা আয়োজনের উদ্যোগ নেবে জেলা প্রশাসন৷ আর বাগান মালিকরা বাগানের প্রচলিত প্রথা অনুসারে ধর্মঘটকালীন মজুরি শ্রমিকদের পরিশোধ করবেন৷ এরপর সোমবার সকালেই মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন৷
দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত ৯ আগস্ট থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন দেশের ২৪১টি চা বাগানের প্রায় সোয়া লাখ শ্রমিক৷ প্রথম চারদিন শ্রমিকরা প্রতিদিন দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন৷ ১৩ আগস্ট থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন শুরু করেন শ্রমিকরা৷
১১ দিন পর গত ২০ আগস্ট শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠকে দৈনিক মজুরি ১৪৫ টাকায় রাজি হয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা৷ কিন্তু আন্দোলনকারী শ্রমিকদের একটি অংশ তা প্রত্যাখ্যান করে রোববার রাজপথে নামে৷
এই প্রেক্ষাপটে রোববার রাতে আবার চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাহিদুল ইসলাম৷
দুর্দশা, যন্ত্রণার আরেক নাম চা শ্রমিক
ধীরে ধীরে খুলছে বহু বন্ধ বাগান। কিন্তু শ্রমিকের দুর্দশা কমছে না। ন্যূনতম পারিশ্রমিকটুকুও পান না পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকেরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
একনজরে বাগান
পাহাড়, ডুয়ার্স এবং তরাই মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কমবেশি ২৮৩টি চা বাগান আছে। তার মধ্যে হিমালয়ের পাদদেশে তরাই এবং ডুয়ার্সে বাগানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায চার লাখ কর্মী চা বাগানের সঙ্গে যুক্ত। তারা বিভিন্ন চা বাগানের বস্তিতে থাকেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বন্ধ বাগান
গত এক দশকে প্রায় একশটি চা বাগান বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়, ডুয়ার্স, তরাই সর্বত্র চা বাগান বন্ধ হয়েছে। কাজ হারিযেছেন হাজার হাজার শ্রমিক। অভাবে মৃত্যু হযেছে বহু শ্রমিকের। তারই মধ্যে এসেছে করোনাকাল। কাজ বন্ধ থেকেছে খোলা বাগানেরও। তবে ২০২২ সাল থেকে ফের খুলতে শুরু করেছে বহু বন্ধ বাগান। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে প্রায় সব বাগানই খুলে যাবে বলে মনে করছেন চা বাগান আন্দোলনের কর্মীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
যন্ত্রণার শেষ নেই
বাগান খুললেও যন্ত্রণা কমেনি শ্রমিকদের। বহু বাগানে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিটি বাড়ি থেকে কেবল একজন বাগানে কাজ করতে পারবেন। কর্মীদের অভিযোগ, তাদের নিয়মিত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না বাগান মালিকেরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী কী পাওয়ার কথা
মজুরি ছাড়া বাগান শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, রান্নার কাঠ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কর্মীর সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা-সহ একাধিক পরিষেবা দেয়ার কথা বাগান মালিকদের। এর জন্য কর্মীদের মজুরি থেকে টাকাও কাটা হয়। কিন্তু বাস্তবে সব পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে কর্মীদের অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
১৫ শতাংশ বৃদ্ধি
কয়েকমাস আগেও চা কর্মীরা ২০২ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। অতি সম্প্রতি ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে তা ২৩২ টাকা করা হযেছে। এই টাকাও তারা সবসময় পান না বলে অভিযোগ। ভারতে এখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৩৬৯ টাকা। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই তালিকায় ফেলা হয় না। তাদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি এর চেয়ে অনেক কম। চা কর্মীরা এখন দৈনিক ২৩২ টাকা পান।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অক্লান্ত পরিশ্রম
সকাল সাড়ে সাতটায় বাগানে পৌঁছাতে হয় চা শ্রমিকদের। দুপুরে আধঘণ্টার বিরতি পান তারা। তারপর ফের কাজে নেমে পড়তে হয়। ছুটি হয় চারটের সময়। পাতা তোলার কাজ করেন মূলত মেয়েরা। বাড়ি থেকে জল নিয়ে বাগানে যান কর্মীরা। অভিযোগ, সেই জল শেষ হয়ে গেলে সামান্য খাওয়ার জলটুকুও তাদের দেয়া হয় না। বাগানে জলের ট্যাঙ্ক যাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় তা পাওয়া যায় না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এভাবেই থাকে শিশুরা
বাগানের ধারে এভাবেই শিশুদের রেখে কাজে চলে যান মায়েরা। সারাদিন শিশুদের খোঁজও নিতে পারেন না তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মায়ের অপেক্ষায়
মায়ের জন্য অন্তহীন অপেক্ষায় কোলের শিশু। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। তাদের কান্নাটুকু শোনার জন্যেও কেউ নেই।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বন্ধ বাগানের কর্মীরা
বন্ধ চা বাগানের কর্মীরা এভাবেই অন্য বাগানে চলে যান ভাগ খাটতে। প্রয়োজন মতো বিভিন্ন বাগান তাদের দিয়ে কনট্রাক্টে কাজ করায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ওজন এবং পরোটা
প্রতিদিন দুইবার পাতার ওজন হয়। দিনে গড়ে ২৪ কেজি পাতা তুলতে হয় শ্রমিকদের। বেশি তুললে কেজি প্রতি সাড়ে তিন টাকা করে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু কম তুললেই পরোটা। প্রো রেটা বেসিসে মজুরি কমানো হয়। চা বাগানে সেই প্রো রেটা মুখে মুখে হয়ে গেছে 'পরোটা'।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রেশনের লাইন
আগে চা বাগান থেকে কর্মীদের রেশন দেওয়া হতো। এখন সরকার দেয়। তাই বাগান আর দেয় না। সপ্তাহের চাল-ডাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে কর্মীরা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মাসের রোজগার
প্রতিদিন কাজ করতে পারলে মাসে হাজার চারেক টাকা রোজগার হয় একজন কর্মীর। সেই টাকা থেকেই বিদ্যুতের বিল, ছেলেমেয়ের স্কুলে খরচ, রান্নার গ্যাস, ওষুধপত্রের টাকা দিতে হয় কর্মীদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সরকার কোথায়
চা বাগান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য, বহু আন্দোলনের পর সরকারের হস্তক্ষেপে ১৫ শতাংশ মজুরি বেড়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা নেহাতই কম। চা শ্রমিকদের বক্তব্য, কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না।রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের কথা ভাবছে না বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
হতাশ কর্মীদের কথা
হতাশ কর্মীরা পরের প্রজন্মকে আর চা বাগানে রাখতে চান না। চা কর্মীদের নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বক্তব্য, গত কয়েকদশকে বাগান থেকে পালাতে গিয়ে নারীপাচার চক্রের হাতে পড়তে হয়েছে বহু মেয়েকে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
14 ছবি1 | 14
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে ‘সম্মান' জানিয়ে ১২০টাকা মজুরিতেই সোমবার থেকে কাজে যোগ দিচ্ছেন তারা৷ যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে বিজয় ছাড়াও রয়েছেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল, সহসভাপতি পংকজ চন্দ্র, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালন্দি প্রমুখ৷
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘মামনীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তার সম্মানে চা শ্রমিক ইউনিয়ন রেজি নং-বি ৭৭ তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে আগামীকাল ২২/০৮/২২ কাজে যোগ দেবেন৷ আপাতত চলমান মজুরি অর্থাৎ ১২০/-(একশত বিশ) টাকা হারেই শ্রমিকগণ কাজে যোগদান করবেন৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্স পরবর্তীতে মজুরির বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনার পর চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে মর্মে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ দাবি জানান৷
‘‘আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার পূর্বে মামনীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হওয়ার জন্য চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ আবেদন করেছেন যা জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থাপিত হবে৷ চা শ্রমিকদের অন্যান্য দাবিসমূহ লিখিত আকারে জেলা প্রশাসকের নিকট দাখিল করবেন৷ জেলা প্রশাসক প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনার জন্য দাবিসমূহ প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করবেন৷’’
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
বাগান থেকে ‘চা’-এর কাপে আসার গল্প
শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে চোখ জুড়ানো বেশ কিছু চা বাগান৷ সেসব বাগানের চা বাগান থেকে কিভাবে চায়ের কাপে আসে তারই গল্প থাকছে এই ছবিঘর-এ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা বাগান
চা বোর্ডের হিসেবে পুরো বাংলাদেশে চা বাগান রয়েছে মোট ১৬২টি৷ তার মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাগানসহ মৌলভীবাজার জেলায় মোট বাগানের সংখ্যা ৯০টির মতো৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা শ্রমিক
সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে চা শ্রমিকরা পাতা তুলতে শুরু করেন৷ যাঁর চা পাতার ঝুলির ওজন বেশি হয়, তিনি পারশ্রমিক বেশি পান৷ তাই তাঁদের মধ্যে সব সময় এক ধরনের তাড়া কাজ করে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চা কন্যা
চা শ্রমিকদের মধ্যে নারীই বেশি৷ চা শ্রমিক, চা শিল্পী, চা কন্যা বা পাতিয়ালী – যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, তাঁরা কঠোর পরিশ্রমী৷
ছবি: DW/M. Mamun
এবার মাপার পালা
পাতা তোলার পর কে কতটা তুলেছেন তা মাপা হয় বাগানেরই কাছের ছোট এক কুটিরে৷ চা পাতার ওজন অনুপাতেই শ্রমিকরা তাঁদের পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন৷ পাতা মাপার পর এক ফাঁকে ঝটপট বাড়ি থেকে নিয়ে আসা নাস্তাটা তাঁরা সেরে নেন৷ আবার যে বাগানে যেতে হবে !
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
কারখানায় যাচ্ছে পাতা
মাপার পর এবার পাতা যাচ্ছে চা কারখানায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
পাতা বহমান
কারখানায় পৌঁছানোর পর ছোট ছোট ব্যগে করে ইলেক্ট্রিক মেশিনের সাহায্যে ঘুরে ঘুরে পাতা যাচ্ছে আরেক জায়গায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
ছড়ানো পাতা
এখানে পাতাগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ভালো করে পরিস্কার করে বেছে নেওয়া হবে৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
পাতার সোঁদা গন্ধ
পাতা পরিস্কারের পর এবার যাচ্ছে মেশিনে৷ কয়েকটি মেশিনে একসাথে কাজ হচ্ছে৷ মেশিনে ‘প্রসেস’ হওয়ার সময় সবুজ পাতা কেমন যেন এক সোঁদা আর মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
বদলে যায় রং
এবার চা পাতা শুকানোর পালা৷ এরই মধ্যে এই মেশিনের গরম তাপে চা পাতার রং বদলে গিয়ে গাঢ় বাদামী হয়ে গেছে৷ চা বাগানে ঘোরাঘুরির পর তৈরি গরম চায়ের গন্ধ, চেহারা আর হাত দিয়ে ধরে দেখার অনুভূতি কিন্তু চা প্রেমীদের কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর !
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
গুণগত মান পরীক্ষা
গুড়ো চা শুকিয়ে যাবার পর এবার গুণগত মান পরীক্ষার পালা৷ চা টেস্টের পর সব ঠিক থাকলেই কেবল তা বড় বড় বস্তায় ভরে প্যাকিং এবং রপ্তানির জন্য পাঠানো হয় চট্টগ্রামে৷
ছবি: DW/Nurunnahar Sattar
শেষ ধাপ: ‘চা’ এলো কাপে
চট্টগ্রামের কারখানা থেকে প্যাকেট হয়ে বাজারে আসে চা৷ তারপর তো দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সেই চা আমাদের কাপে৷ ‘চা’-এর তুলনা শুধু চা-ই৷
ছবি: DW/N. Sattar
সব সময়ের সঙ্গী ‘চা’
উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় ‘চা’৷ ফিনলে চা কারখানার দেয়ালে লাগানো বোর্ডের এই কথাগুলো কতটা সত্যি, তা মনে হয় যে কোনো চা প্রেমীই জানেন৷