চিকিৎসকদের কটূক্তি, প্রতিবাদীদের মারধর, অভিযুক্ত তৃণমূল
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে ৩৯ দিন কর্মবিরতি পালন করেছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিপুল সংখ্যক জনতা। এই পর্বে শাসক শিবিরের নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের কড়া আক্রমণের মুখে পড়েছেন আন্দোলনকারীরা।
তিন মন্ত্রীর মন্তব্য
বিশ্বকর্মা পূজোর অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে।
পূর্ব বর্ধমানের কালনায় মন্ত্রী বলেন, "আমার এলাকায় একটি হোটেলে মহিলারা মদ খেতে যান। বলে দিয়েছি, ওখানে আর মহিলারা মদ খেতে যাবেন না। কোনো অঘটন ঘটলে কে দায়িত্ব নেবে? কাল রাত দুটোর সময় বৃষ্টিতে যুগলকে মদ খেতে দেখেছি। রাত দুটোয় আপনার মেয়ে কেন রাতজাগা আন্দোলনে গিয়েছেন, মা-বাবারা খোঁজ নিয়েছেন?
রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী সোমবার তির্যক মন্তব্য করেন আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। তিনি ভণ্ড বলে চিহ্নিত করেন আন্দোলনকারীদের।
সিদ্দিকুল্লা বলেন, "ভন্ডামি করছেন, বাড়াবাড়ি করছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। আন্দোলনকারীদের পিছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি আছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্বাস নেই, বেতন নেয়ার সময় বিশ্বাস হয়? পদোন্নতির সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশ্বাস হয়? যারা এসব করছেন, দ্বিচারিতা করছেন।
বিচারের দাবিতে বহু নারী পথে নেমেছেন। তারা রাত দখল করছেন। এদের উদ্দেশে কটাক্ষ করেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ।
উদয়নের ভাষায়, "চুল্লুর ঠেক ভাঙার জন্য নারীদের ঝাঁটা হাতে আন্দোলন করতে দেখেছি। কিন্তু মদের ঠেক ভাঙার জন্য কোনোদিন জিন্স প্যান্ট পরা কিংবা বব কাট চুলের নারী দেখিনি। কারণ ওটা আন্দোলন নয়।"
হুমকির সুরও শোনা যাচ্ছে। উদয়ন বলেছেন, "এই ঘটনায় যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তুলছেন, গালাগালি করছেন, পদত্যাগ চাইছেন, সেই আঙুলগুলো চিহ্নিত করে ভেঙে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।"
সাংসদের কথা
গত মাসের শেষে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের অনুষ্ঠানে মমতা দলের কর্মীদের ফোঁস করার নিদান দিয়েছিলেন। এরপর থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতারা তীব্র কটাক্ষ করেছেন আন্দোলনকারীদের। পরে তৃণমূল দলের নেতাদের সতর্ক করে বলেছে, জুনিয়র চিকিৎসকদের উদ্দেশে তির্যক মন্তব্য করা যাবে না। তবুও পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি।
আরজি কর নিয়ে একটানা আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি মেনে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সহ পুলিশ ও প্রশাসনের একাধিক কর্তা বদলি হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় বলেছেন, "এটা চিকিৎসকদের জয় বলে মনে করি না। সারা রাত মোমবাতি নিয়ে বসে থাকলে সরকার বদলানো যায় নাকি!"
বাঁকুড়ার তৃণমূল সাংসদ অরূপ চক্রবর্তী আন্দোলনকারী জনতাকে বিঁধেছেন। তার মন্তব্য, "কন্যাশ্রী, ১০০ দিনের কাজ, লক্ষ্মীর ভান্ডার, পুজোর অনুদান চাই না বলছে। এদের নিয়ে মিছিল করে দেখাক, তাহলে বাপের বেটা বলব।"
চিকিৎসকদের সংগঠন মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক ও আরজি করের প্রাক্তনী ডা. বিপ্লব চন্দ্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "শাসক দল যাই বলুক না কেন, এর মধ্যে কী রাজনীতি আছে, সেটা খুঁজে লাভ নেই। যদি রাজ্য প্রশাসন খুব দ্রুত দোষীদের খুঁজে বার করে শাস্তি দিত, তাহলে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি এতদিন ধরে চলত না।"
বিধায়কদের মুখে
তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের কর্মীদের কুকথায় লাগাম টানতে বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "স্বাস্থ্য সমাজ বা নাগরিক সমাজের কারো বিরুদ্ধে আজেবাজে মন্তব্য করবেন না। প্রত্যেকের প্রতিবাদ এবং মতপ্রকাশের অধিকার আছে।"
তবে তির্যক মন্তব্যের স্রোত এতে থামেনি।
অভিনেতা ও বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক চিকিৎসকদের বেতন নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন। আক্রমণ করেছিলেন সংস্কৃতি কর্মীদের। তার প্রতিবাদে কয়েকজন সংস্কৃতি কর্মী সরকারি পুরস্কার ফিরিয়ে দেন। রাজারহাট নিউটাউন বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক তাপস চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, "হাততালি দিয়ে ডিস্কো ডান্স করলে আন্দোলন সফল করা যায় না।"
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা কোনোদিনই ভালো ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সময় এসব নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তা হয়নি। এই প্রথম তৃণমূলকে পিছু হটতে হয়েছে। এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। এই ক্ষেত্রে মমতার দূরদৃষ্টির অভাব প্রমাণিত হলো বলে মনে হচ্ছে।"
রাজ্য দাবি করেছে, জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ফলে অনেক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই সুরে অভিনেত্রী ও বিধায়ক লাভলি মৈত্র আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের কসাইয়ের তকমা দেন।
ধরনা মঞ্চে উপস্থিত এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী, ডা. অনিন্দ্য মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই রাজনৈতিক নেতারা হয়তো ভোটে জেতেন, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে এরা কী বললেন, তাতে আন্দোলনের কিছু এসে যায় না। বরং এইসব মন্তব্যের জন্য সাধারণ মানুষ এদের ধিক্কার জানিয়েছে।"
হুমকির অভিযোগ
সাধারণ মানুষের আন্দোলন রুখতে শাসক শিবির থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
ক্যানিং পশ্চিমের তৃণমূল বিধায়ক পরেশরাম দাস বলেছেন, "সবাই সবার অঞ্চল অনুযায়ী প্রত্যেকটা বুথে নির্দেশ দিন, কোনো মেয়ে বা ছেলে রাত দখলের এই মিথ্যা চক্রান্তে না বেরোয়।"
চিকিৎসকদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি শোনা গিয়েছে।
তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর বলেছেন, "আরজি করে যে ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক বিচার চাই৷ কিন্তু আন্দোলনকারীরা দিনের পর দিন কর্মবিরতি পালন করে যাবেন, এই জিনিস আর বরদাস্ত করব না।” কবীরের বিরুদ্ধে এজন্য এফআইআর দায়ের হয়েছে।
প্রায় সাত সপ্তাহ ধরে চলা নাগরিক সমাজের আন্দোলন কোনো কোনো এলাকায় আক্রান্ত হয়েছে বলে অভিযোগ। তাদের দাবি, কোচবিহার, নৈহাটি, বারাসতে শাসক দলের নেতাকর্মীরা কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছেন। মারধর করা হয়েছে বলেও অভিযোগ।
অনেক ছোটখাটো নেতা কুকথা বলার তালিকায় রয়েছেন। নারী তৃণমূল কংগ্রেসের মালদহ জেলার সভানেত্রী সাগরিকা সরকার বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বাম ও বিজেপি নারীদের ভুল বুঝিয়ে রাস্তায় নামাচ্ছে। যারা কুৎসা করছে, তাদের ঝাঁটা হাতে মোকাবিলা করতে হবে।"
দলের নিষেধ সত্ত্বেও কেন এমন কথা বলছেন বিভিন্ন স্তরের নেতারা? সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "এই জনপ্রতিনিধিদের উপর হয়ত স্থানীয় মানুষদের চাপ আছে। তারা সরকারি হাসপাতালে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পরিষেবা পাচ্ছেন না, এলাকায় ফিরে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। তবে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা কী বলছেন, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সুপ্রিম কোর্ট কী বলছে। সরকার দাবি পূরণ করার পর চিকিৎসকরা কবে কাজে যোগ দেবেন, সেটা বেশি জরুরি।"
শুভাশিস মৈত্রর বক্তব্য, "তৃণমূল সরকার অচলাবস্থা কাটানোর পথে নিজেরাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্ভাব্য দুর্বৃত্ত বা অভিযুক্তরা সরকার বা শাসক দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।"