চিকিৎসা ও কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার
২৫ মার্চ ২০২৪
প্রযুক্তির বিকাশ মানুষের জীবনযাত্রা দ্রুত বদলে দিচ্ছে৷ কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই প্রবণতা আরো জোরালো করে তুলতে পারে৷
ছবি: Frederic J. Brown/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
বাইরে থেকে দেখলে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কোনো অভিনবত্ব বোঝা যায় না৷ কিন্তু ভেতরেই তার আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে৷ কারণ একমাত্র নির্দিষ্ট পরিবেশেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলে৷
কোয়ান্টাম বিটস বা কিউবিট নামের অতি দ্রুত গতির কণা চলাচলের জন্য তাপমাত্রা অসম্ভব শীতল রাখতে হয়৷ তার জন্য কুলিং সিস্টেম, লেজার ইমপাল্স, কনট্রোল টেকনোলজির প্রয়োজন হয়৷ অফিসের টেবিলের নীচে এমন কম্পিউটার রাখা সম্ভব নয়৷ তবে এটাও মনে রাখতে হবে, যে সাধারণ বিটের তুলনায় কিউবিটের ক্ষমতা অনেক বেশি৷
সুইজারল্যান্ডে আইবিএম কোম্পানির গবেষণা কেন্দ্রে এমনই এক কম্পিউটার কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল৷ সেই কম্পিউটার সব সময়ে মোড়কবন্দি থাকে৷ কোম্পানির প্রতিনিধি আন্দ্রেয়াস ফুয়রার সেটি দেখিয়ে বলেন, ‘‘এটা এক কোয়ান্টাম কম্পিউটার৷ এই মুহূর্তে সেটির মধ্যে কোনো প্রসেসর নেই৷ নীচে থেকে সেটা বসাতে হয়৷ সেটাই মূল কোয়ান্টাম প্রসেসর৷ এখনে আসলে এক রেফ্রিজারেটর দেখা যাচ্ছে যা মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অর্থাৎ সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বজায় রাখতে পারে৷''
এভাবে প্রসেসরগুলিকে বাহ্যিক প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেওয়া যায়৷
কোয়ান্টাম কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে, সেটা জানতে ক্ষুদ্রতম কণা, অর্থাৎ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে ডুব দিতে হবে৷ অত্যন্ত অদ্ভুত ও প্রায় অস্বস্তিকর সেই জগত একই সঙ্গে আকর্ষণীয়ও বটে৷
পরমাণুর সেই সাম্রাজ্যে সব কিছুই অন্যরকম৷ সবই গতিময়, একে অপরের উপরে অবস্থিত৷ প্রায় একই সঙ্গে একাধিক জায়গায় সেটা ঘটে৷ এমন এক চিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া বেশ কঠিন৷ কারণ মানুষের পক্ষে সেই জগত পর্যবেক্ষণ করাই সম্ভব নয়৷ যখনই কিছু পরিমাপ করার চেষ্টা হয়, কোয়ান্টাম উধাও হয়ে যায়৷ সেই জগত বোঝার জন্যও শিক্ষা চাই৷
চিকিৎসা ও কৃষিতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অবদান
04:07
This browser does not support the video element.
এখনো পর্যন্ত মানুষ প্রচলিত বিট চিনতো৷ ট্রানজিস্টরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সেই সার্কিট হিসেবে বিট হয় এক বা শূন্য হতে পারে৷ সেই ডিজিটাল জগতের মধ্যে সংযোগের পেছনে একটা যুক্তি রয়েছে৷ ফলে সেই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক সার্কিট পর পর চলে৷ তার গতি অত্যন্ত দ্রুত হলেও সব সময়ে ক্রমান্বয়ে, অর্থাৎ একের পর এক ছন্দে ঘটে৷
কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সেই বিট কিউবিট হয়ে যায়৷ মাইক্রোওয়েভ বা লেজার পাল্সের মাধ্যমে তার মধ্যে রদবদল ঘটিয়ে শুধু এক বা শূন্যের বদলে আরো বেশি অবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব৷
তথাকথিত ‘সুপার পোজিশন’ অবস্থায় কোনো কিউবিট একই সঙ্গে এক ও শূন্য হতে পারে এবং দুইয়ের মাঝের সব অবস্থাও ধারণ করতে পারে৷ অনেকটা ঘূর্ণীয়মান পয়সার সঙ্গে সেই অবস্থার তুলনা করা যায়৷ যতক্ষণ সেটি ঘুরে চলেছে, ততক্ষণ কিছুই বলা যায় না৷ একমাত্র পরিমাপ করলে তবেই কিউবিট দুটি মূল অবস্থার মধ্যে একটি বেছে নেয়৷
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা যায়৷ ধরা যাক, জটিল সিস্টেমের মধ্যে একটি কম্পিউটারকে সবচেয়ে সরাসরি পথ বেছে নিতে হবে৷ প্রচলিত কম্পিউটার একের পর এক ধাপে সব সম্ভাব্য পথ খতিয়ে দেখে৷ ফলে সেই কাজ যত জটিল হয়, সেটা করতে তত বেশি সময় লাগে৷
অন্যদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত কিউবিটের মাধ্যমে এমন এক সমস্যা একই সময়ে সমাধানের চেষ্টা করে এবং অনেক দ্রুত আদর্শ পথ খুঁজে পায়৷
কিন্তু ঠিক কোন কাজের জন্য এমন কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজে লাগানো যেতে পারে? চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের জন্য তার নির্দিষ্ট রোগ অনুযায়ী আলাদা করে ওষুধ সৃষ্টি করা যাবে৷
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কল্যাণে কৃষিক্ষেত্রও আরো টেকসই করে তোলা সম্ভব৷ যেমন সেই কম্পিউটার আরো টেকসইভাবে সার উৎপাদনের পথ বাতলে দিতে পারে৷ অ্যামোনিয়া উৎপাদন আরো আদর্শ করে তুলতে সেই প্রযুক্তি সাহায্য করতে পারে৷
এখনো বিশাল ক্ষমতার কোয়ান্টাম কম্পিউটার গড়ে তোলা হয় নি বটে, তবে এ ক্ষেত্রে অভীবনীয় সম্ভাবনা রয়েছে৷
ক্রিস্টিয়ান বাখমান, সান্ড্রা ওডারমাট/এসবি
কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা: আদি থেকে বর্তমান
বর্তমানে প্রযুক্তি জগতের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় চ্যাটজিপিটি৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা দিয়ে এটি তৈরি৷ এআই প্রযুক্তির শুরু থেকে এই পর্যায়ে আসার পেছনে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনার কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Torsten Sukrow/SULUPRESS.DE/picture alliance
দৈনন্দিন জীবনে এআই
স্মার্টফোন খুলতে ফেস আইডির ব্যবহার, ফেসবুকে পছন্দের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, জীবনযাপনে সিরি-আলেক্সার ব্যবহার - এসবের পেছনে আছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ৷ কিন্তু একদিনে এই প্রযুক্তি এত দূর আসেনি৷
ছবি: Reuters/T. Peter
এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রকে কিছু ‘শেখানোর’ মাধ্যম হচ্ছে ‘আর্টিফিসিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কস’ বা এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম৷ ১৯৪৩ সালে মার্কিন নিউরোফিজিওলজিস্ট ও সাইবারনেটিশিয়ান ওয়ারেন ম্যাককালেক এবং কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্টিস্ট ওয়াল্টার পিটসের গবেষণাপত্রে প্রথম এএনএন ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়৷
ছবি: Axel Bueckert/Zoonar/picture-alliance
প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোবট
মার্কিন বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নিউরোফিজিওলজিল্ট ও সাইবারনেটিসিয়ান উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার ১৯৮৪ সালে এলমার ও এলসি নামে দুটি রোবট তৈরি করেছিলেন৷ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারা প্রথম রোবট এগুলো৷ আলো ও স্পর্শ ব্যবহার করে তারা বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারতো৷
ছবি: United Archives/IMAGO
পড়াশোনার বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি
মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি (ছবি) ১৯৫৫ সালে প্রথম ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ টার্মটি ব্যবহার করেন৷ এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন যেখানে পড়াশোনার বিষয় হিসেবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্বীকৃতি পায়৷
ছবি: AP/picture alliance
প্রথম চ্যাটবট
সিরি, আলেক্সার কথা আমরা সবাই জানি৷ তবে ১৯৬৬ সালে ‘এলিজা’ নামে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল, যাকে প্রথম এআই চ্যাটবট বলা হয়৷ এলিজা মানুষের কথা বুঝতে পারত, কথাও বলতে পারত৷ যদিও তার নির্মাতা জার্মান-অ্যামেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইওসেফ ভাইৎসেনবাউম (ছবি) প্রায়ই বলতেন, এলিজা বুদ্ধিমান নয়৷
স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা এসআরআই-এর ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার’ ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ‘শেকি’ নামে একটি রোবট তৈরি করেছিল, যেটি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো৷ শেকির আগে তৈরি সব রোবটকে প্রতিটি ধাপে নির্দেশ দিতে হত৷ কিন্তু শেকির তা প্রয়োজন ছিল না৷ এসআরআই-এর ওয়েবসাইট বলছে শেকি ছিল প্রথম মোবাইল রোবট যার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার ক্ষমতা ছিল৷
ছবি: SRI International
দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারানো
এআই গবেষণার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে খেলা৷ একটি এআই চেস প্রোগ্রাম ১৯৮০র দশকে চেস মাস্টার ডেভিড লেভিকে খেলায় হারিয়ে দিয়েছিল৷ আর ১৯৯৬ সালে আইবিএম এর ‘ডিপ ব্লু’ কম্পিউটার তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল৷
ছবি: Stan Honda/AFP/Getty Images
প্রথম রোবটিক খেলনা
একটি মার্কিন কোম্পানি ১৯৯৮ সালে রোবোটিক খেলনা ‘ফার্বি’ বাজারে এনেছিল৷ প্রথমে এটি ‘ফার্বিশ’ বলতো৷ কিন্তু তাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে, তাকে ইংরেজি ভাষা ও শব্দ শেখানো শুরু করলে সে একসময় তা বলতে পারতো৷ ফার্বির মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ প্রথম বুঝতে পারে যে, চাইলে যন্ত্রকে কিছু শেখানো যায়৷
ছবি: PA Fearn/dpa/picture alliance
জিওপার্ডি! কুইজ শো জয়
২০১০ ও ২০১১ সালে আইবিএম-এর ওয়াটসন কম্পিউটার সিস্টেম মার্কিন টেলিভিশন কুইজ শো ‘জিওপার্ডি!’তে অংশ নিয়ে দুজন চ্যাম্পিয়নকে হারাতে সক্ষম হয়৷
ছবি: IBM/dpa/picture alliance
ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট সিরির আগমন
২০১১ সালে অ্যাপল ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট ‘সিরি’ নিয়ে আসে৷ এটি মানুষের কথা বুঝতে পেরে সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে৷ এআই জগতে সেই সময় এটি একটি অন্যতম সাফল্যের ঘটনা ছিল৷ সিরির পর এসেছে আলেক্সা, গুগল- যা এখন প্রায় সবাই ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ লিখেছিল রোবট
২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট জিপিটি-৩৷ এটি মার্কিন এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই-এর ল্যাঙ্গুয়েজ-জেনারেটর৷ প্রবন্ধটি পড়তে এই লিংকে (shorturl.at/cjnzT) ক্লিক করুন৷
ছবি: Getty Images
রোবোকাপ
রোবোটিকস ও এআই গবেষণা এগিয়ে নিতে ১৯৯৬ সালে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রোবোকাপ টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন৷ এটি প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে৷ ‘রোবট সকার ওয়ার্ল্ড কাপের’ সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে রোবোকাপ৷
ছবি: JACK TAYLOR/AFP/Getty Images
বিশ্বকাপের বলে এআই প্রযুক্তি
কাতার বিশ্বকাপে অফসাইড ধরতে এআই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছিল ফিফা৷ এর সাহায্যে বলের মধ্যে থাকা সেন্সর ও ছাদে থাকা ১২টি ক্যামেরার মাধ্যমে ফুটবলার ও বলের অবস্থান আরও ভালোভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: DW
চ্যাটজিপিটি
মার্কিন ওপেনএআই কোম্পানির তৈরি চ্যাটজিপিটি একটি শক্তিশালী মেশিন লার্নিং মডেল৷ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের মতো লেখা বা টেক্সট তৈরি করার ক্ষমতা৷ এর মানে হলো, কোনো একটি বিষয়ে একজন মানুষ যেমন প্রত্যুত্তর দিতে পারে, চ্যাটজিপিটিও সেরকমই জবাব লিখে জানাতে পারে৷ এটি চ্যাটবটের মতো অ্যাপগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী৷