চিড়িয়াখানার পরিবেশ দর্শকদের মনের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে৷ প্রাণীরা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকলে তাদের দেখে মন ভালো হয়ে যায়৷ এর পেছনে রয়েছে স্থাপত্য সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা৷
বিজ্ঞাপন
বার্লিন চিড়িয়াখানায় এক পান্ডা দম্পতির জন্য আলাদা বাসা তৈরি করা হয়েছে৷ নাম ‘পান্ডা গার্ডেন'৷ দর্শক ও তাদের মাঝে রয়েছে শুধু কাচের জানালা৷ মেং মেং ও জিয়াও চিং-এর ঘরে এমনকি চৈনিক বাতিও রয়েছে৷ স্থপতি নাতাশা ময়সার এই প্রাণীগুলি দেখে মুগ্ধ৷ প্রাণীগুলির জন্য যে সে এনক্লোজার তৈরি করা হয় নি, রীতিমতো অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে তোলা হয়েছে৷ চিড়িয়াখানার গাইড ক্রিস্টিয়ান টল জানালেন, ‘‘গোটা বাড়িটির তিনটি অংশ রয়েছে৷ অর্থাৎ শোবার ঘর, বসার ঘর ও এক বিশাল বাগান৷ সত্যিকারের আরামের মরুদ্যান৷''
দর্শকদের আরামেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ চিড়িয়াখানা ঘোরার অভিজ্ঞতাকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলাই ছিল উদ্দেশ্য৷ নাতাশা ময়সার বলেন, ‘‘বর্তমান চিন্তাধারা অনুযায়ী চিড়িয়াখানার স্থাপত্যে ঘরে-বাইরে প্রাণীদের থাকার জায়গা পুরোপুরি পরিকল্পনামাফিক তৈরি করা হয়৷ প্রত্যেকটি ঝোপঝাড়, ঘাস, বেড়া ভেবেচিন্তে তৈরি করা হয়৷''
নাতাশা মনে করেন, নাটকের মঞ্চের মতো চিড়িয়াখানার স্থাপত্যও দর্শকদের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে৷ চিড়িয়াখানা আসলে প্রকৃতি উপভোগের অভিজ্ঞতার বিভ্রম সৃষ্টি করে৷ নাতাশা ময়সার প্রায় ১০ বছর ধরে চিড়িয়াখানার স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সে বিষয়ে একটি বই লিখেছেন৷ আসলে তিনি আফগানিস্তান, মালি ও ইয়েমেনের মতো সংকটপূর্ণ দেশে দূতাবাস ভবন তৈরি করেন৷ চিড়িয়াখানাও সেই কাজের কথা কিছুটা মনে করিয়ে দেয়৷ এখানেও স্থাপত্যে কড়া নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে৷
কিন্তু চিড়িয়াখানা কি আসলে কারাগার? মানুষ সেভাবে ভাবতে চায় না৷ স্থাপত্য সেই মনোভাব ভুলতে সাহায্য করে৷ নাতাশা ময়সার বলেন, ‘‘কারণ আমরা এনক্লোজারের সীমানায় সৌন্দর্য আনি৷ খাঁচার গরাদ, বেড়া বা সীমানা আর দেখা যায় না৷ তার বদলে পানির পরিখা খোঁড়া হয়েছে৷ সীমানাকেও আমরা সুন্দর করে তুলি৷ আমার মতে, প্রাণীদের এনক্লোজার মোটেই ‘মানবিক' করে তোলা যায় না৷ প্রাণীরা বন্দিই থাকে, আমরা শুধু নাটকীয়ভাবে তাকে সবার সামনে পেশ করি৷''
নাতাশা ময়সার চিড়িয়াখানার স্থাপত্যের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছেন৷ ১৮৪৪ সালে বার্লিন চিড়িয়াখানার সূচনা হয়েছিল জিরাফের এনক্লোজার দিয়ে৷ সে সময়ে ভিনদেশীয় আজব প্রাণী হিসেবে তাদের দেখানো হতো – যেন আরব্যরজনীর কাল্পনিক চরিত্র৷
১৯০০ সালে হামবুর্গ শহরে কার্ল হাগেনবেক গারদহীন চিড়িয়াখানার আইডিয়া নিয়ে আসেন৷ শিকারি প্রাণীদের পাশে ফ্ল্যামিংগো পাখি রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নাটক শুরু হয়৷ নাতাশা ময়সার বলেন, ‘‘স্বর্গের উদ্যানের একটা ছবির চাহিদা আমাদের মনের মধ্যেই রয়েছে৷ এখানে তাকিয়ে দেখলে শুধু প্রকৃতিই চোখে পড়ছে, স্থাপত্য নয়৷ আমার মনে হচ্ছে, প্রাণীরা ভালোই আছে৷''
জঙ্গলে প্রাণী দেখতে চান? তার জন্য টেলিভিশনে তথ্যচিত্র রয়েছে৷ জঙ্গলের স্বাদ নেবার চাহিদা অবশ্যই রয়েছে৷ কিছু প্রাণী আমাদের হৃদয় গলিয়ে দেয়৷ যেমন ২০০৬ সালে পরিত্যক্ত তুষার ভালুকের ছানা ক্নুট করেছিল৷ দর্শকদের প্রিয় এমন প্রাণীকে কিন্তু খাঁচায় বন্দি রাখা উচিত নয়৷ উন্মুক্ত প্রকৃতিই তাদের জন্য উপযুক্ত৷
ভবিষ্যতের চিড়িয়াখানা কেমন দেখতে হবে? সিঙ্গাপুর ও সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে যে পরিকল্পনা চলছে, তা থেকে সেই আভাস পাওয়া যায়৷
বার্লিন চিড়িয়াখানায় জলহস্তির ভবিষ্যতধর্মী ঘর প্রকৃতির মধ্যেই মিশে যাচ্ছে৷ তবে এ সব নিয়ে প্রাণীরা সম্ভবত মাথা ঘামাচ্ছে না৷
জার্মানির চিড়িয়াখানার ইতিহাস
প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ জার্মানির চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে৷ একজন দর্শনার্থী চিড়িয়াখানায় গিয়ে এখন যা দেখেন, তা এ রকম ছিল না৷ সময়ে সময়ে বদলেছে ধরণ, সমৃদ্ধ হয়েছে কালে কালে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/K. Hennig
জার্মানির প্রথম চিড়িয়াখানা
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক মার্টিন হিনরিশ লিশটেনস্টাইন লন্ডনে জুলোজিক্যাল গার্ডেন দেখে এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ এরপর তাঁর মধ্যে এ বিষয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছা জাগে৷ ১৮৪১ সালে প্রুশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রিডরিশ ভিলহেল্মকে রাজি করান৷ রাজা এক ডিক্রির মাধ্যমে বার্লিনের টিয়ারগার্টেনে ৫৪ একর জমি বরাদ্দ দেন৷ সেখানেই গড়ে ওঠে জার্মানির প্রথম জুলোজিক্যাল গার্ডেন৷
ছবি: picture alliance/dpa/arkivi
প্রথম প্রাণী
১৮৪৫ সালের মধ্যে দু’টি কোয়াটি, তিনটি সুমেরুর শিয়াল, একটি লাল শিয়াল, দু’টি ব্যাজার, ২৪টি বানর এবং তিনটি সাইবেরিয়ার ভাল্লুক এখানেআনা হয়৷ ১৮৪৬ সালে সিংহ এবং বাঘকে পৃথক ভবনে নিয়ে আসা হয়৷ ১৮৫৭ সালে প্রথম হাতি আনা হয়৷ ১৮৬১ সালে আনা হয় প্রথম জেবরা৷ তবে তখন প্রাণীর মৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/arkivi
রোল মডেলের ভূমিকায় ভিয়েনা
ভিয়েনার শ্যোনব্রুন চিড়িয়াখানা ছিল একেবারে অন্য রকম৷এ জগতে নানা সংযোজনে তাদের অবদান রয়েছে৷ ১৯০৬ সালে এখানে প্রথম হাতির বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে৷ ৭২৭ প্রজাতির ৩৫শ’ প্রাণী নিয়ে ১৯১৪ সালে এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম চিড়িয়াখানায় পরিণত হয়৷ এটা বার্লিনের চিড়িয়াখানার রোল মডেল হয়ে দাঁড়ায়৷ এটি বিদ্যমান সবচেয়ে পুরাতন চিড়িয়াখানাগুলোর একটি৷ বলা হয়ে থাকে, ইউরোপের মধ্যে এই চিড়িয়াখানাতেই সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী যায়৷
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান ভাষাভাষী দেশগুলোতে বহু চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠে৷ তবে এসব চিড়িয়াখানার পূর্বসুরী হিসাবে রয়েল পার্কের কথাই বলা হয়৷ এটাও প্রুশিয়ার রাজপরিবার গড়ে তুলেছে৷ সেখানে রাজা কেবল শিকারই করতেন না, বরং এখানে প্রকৃতি গবেষকদের বসবাস করার অনুমতি দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P.Pleul
ভবন সংরক্ষণ এবং প্রাণী সুরক্ষা
বার্লিন জুলোজিক্যাল গার্ডেনে অবস্থিত অ্যান্টিলোপ হাউজের মতো অনেক ভবনই ঊনিশ শতকে নির্মাণ করা হয়৷ এর মাধ্যমে এখানে প্রাণীদের জন্য একটা ভিন্ন আবহ আনার চেষ্টা করা হয়৷ কিন্তু এটা যতটা না নান্দনিক করা হয়েছে, নির্মাণের সময় সংশ্লিষ্ট প্রজাতির প্রাণীদের সুবিধার কথা ততটা ভাবা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb/B. Setnik
শিক্ষা
২০ শতকে এসে জার্মানি জুড়ে অনেক চিড়িয়াখানা হয়৷ মানকি পার্ক, ওশান পার্ক, বার্ড পার্ক প্রভৃতি ক্রেজ জেঁকে বসে৷ এমনকি মানুষ সাফারি পার্কের মাঝে নিজেদের গাড়ি বা বাস নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ পায়৷ ৫০ ও ৬০-এর দশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট শহরগুলোও চিড়িয়াখানা বা প্রাণী পার্ক গড়ে তোলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Leonhardt
গতির ঝড়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা উন্মাদনা দেখা দেয়৷ দূর দূর ভূখণ্ডের প্রাণী দেখতে মানুষ আকুল হয়ে উঠে৷ একটা সময়ে এসব চিড়িয়াখানা জীবন্ত ক্লাসরুমে পরিণত হয়৷ কিন্তু প্রাণীদের রাখার ক্ষেত্রে তাদের উপযোগী করে পরিবেশ তৈরির বিষয়টি তখনও অগ্রাধিকারে ছিল না৷ ৭০-এর দশকের পর প্রাণী-মনস্তত্ত্ব নিয়ে নতুন নতুন দিক বের হয়ে আসে৷ তখন চিড়িয়াখানাগুলো তাদের ডিজাইন বদলাতে শুরু করে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/K. Hennig
প্রকৃতিতে ফিরে আসা
চিড়িয়াখানা ডিজাইনে বিস্তৃত পরিসর রাখার বিষয়টি পুরো ব্যাপারটাই বদলে দেয়৷ যেমনটা হয়েছিল হামবুর্গের কার্ল হাগেনবেকে৷ সিংহ বাস করত জিরাফ, হাতি এবং জেব্রার কাছাকাছি৷ চিড়িয়াখানায় অঞ্চলভেদেও বিভক্তি ছিল৷ যেমন, চিড়িয়াখানার আফ্রিকা অঞ্চল৷ ছবিতে উঠে আসা কোলন চিড়িয়াখানার গ্রিনজোনের সব প্রাণী, যারা তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে পারে৷
ছবি: DW/Nelioubin
ভবিষ্যতের চিড়িয়াখানা
চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করবে দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপর৷ কিছু কিছু চিড়িয়াখানা কিছু প্রাণী রাখা বন্ধ করে দিচ্ছে৷ যেমন, ফ্রাঙ্কফুট চিড়িয়াখানা তাদের হাতির ঘর বন্ধ করে দিচ্ছে৷ শহরের মাঝখানে ২৭ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই চিড়িয়াখানা প্রাণীদের পর্যাপ্ত জায়গা দিতে পারছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Zinken
আসছে পান্ডা
চড়ার জন্য গাছ, কৃত্রিম নদী, পছন্দসই গাছ– এ সবই করা হচ্ছে চীনের দুই পান্ডা জিয়াও কুয়িং (ছবিতে) এবং মেং মেং-এর জন্য৷ আগামী ২৪ জুন বিমানের প্রথম শ্রেণির আসনে চড়ে তারা আসছে জার্মানিতে৷ তারা আসার পর বার্লিন জুলোজিক্যাল গার্ডেনে চালু করা হবে পান্ডাপ্লাজা৷ দুই পান্ডার জন্য এত সব আয়োজনই বলে দিচ্ছে, চিড়িয়াখানায় এসব প্রাণীর জীবন পাল্টে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিড়িয়াখানা গবেষণা
চিড়িয়াখানার নতুন নতুন প্রজাতির জন্ম হচ্ছে, যাদেরকে তাদের নিজস্ব পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হবে৷ পরিবেশ সংরক্ষণেও তারা কাজ করছে এবং প্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থান সম্পর্কে দর্শনার্থীদের জানাচ্ছে৷ কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, বিভিন্ন প্রাণীর কিছু কিছু প্রজাতিকে কেবল চিড়িয়াখানায় বাঁচিয়ে রাখা অনৈতিক৷ অবিকৃত প্রাকৃতিক বাসস্থান দেয়া লক্ষ্য হওয়া উচিত৷
জার্মানিতে খেলাধুলার চেয়ে চিড়িয়াখানায় বেশি দর্শনার্থী যায়৷ মানুষ বিনোদনের জন্য এই দিকে বেশি ঝুঁকছে৷ সম্প্রতি কোলন চিড়িয়াখানায় একটা ছোট্ট খামার উদ্বোধন করা হয়েছে৷ সেখানে দর্শনার্থীরা গরু ও ছাগলের যত্ন নিতে পারবেন৷ চিড়িয়াখানা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, কোনো কিছুই এর স্থলাভিসিক্ত হতে পারে না৷ এটা কেবল প্রাণীকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করতেই ভূমিকা রাখছে না৷ বরং বহু বিপন্ন প্রাণীর সংরক্ষণেও কাজ করছে৷