মিউজিয়ামে গিয়ে মোনালিসা বা অন্য কোনো চিত্রের সামনে দাঁড়ালে শিল্পবোদ্ধারা অনেক ব্যাখ্যা দিতে পারেন৷ এবার বিশেষ স্ক্যানার ও স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে সেই চিত্রের আরও গভীরে প্রবেশ করার পথ বাতলে দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
স্ক্যানারের নীচে ছবি
দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক বস্তু বা শিল্পকর্মের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করছে নতুন ধরনের এক স্ক্যানার যন্ত্র৷ গ্রাফিন নামের বিশেষ উপাদানের দৌলতেই এমনটা সম্ভব হচ্ছে৷ স্পেনের ওভিয়েদো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়াররা এই স্ক্যানার তৈরি করেছেন৷ টেলিযোগাযোগ ইঞ্জিনিয়ার সামুয়েল ভের ওয়েইয়ে বলেন, ‘‘গ্রাফিন তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়, খুব সহজেই নিম্ন মাত্রার তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে উচ্চ মাত্রার তরঙ্গদৈর্ঘ্য সৃষ্টি করতে পারে৷ গ্রাফিন আমাদের শিল্পকর্মের গভীরে উঁকি দিয়ে তাতে ব্যবহৃত উপাদানের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে পারে৷''
স্ক্যানার দিয়ে শিল্পকর্মের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন
03:58
এই গ্রাফিন স্ক্যানারের সাহায্যে পাওয়া ছবির সঙ্গে ইমেজ প্রসেসিং প্রযুক্তি ও থ্রিডি হাই পারফরমেন্স স্ক্যানিং-এর সমন্বয়ে ত্রিমাত্রিক বস্তু সৃষ্টি করা হয়৷ ফলে সহজেই তার গোপন রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চালানো যায়৷ কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইয়ানিক ফ্রানকেন বলেন, ‘‘এখানে শিল্পকর্মের আসল রং দেখা যাচ্ছে৷ ভারচুয়াল পদ্ধতিতে তা আলোকিত করা হয়েছে এবং ক্যামেরার সাহায্যে রেকর্ড করা হয়েছে৷ ভিন্ন ভিন্ন স্ক্যানগুলি সমন্বয় করাই সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ৷ স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্যানগুলি পরস্পরের উপর ঠিকমতো বসাতে হবে৷ শূন্য দশমিক ২ মিলিমিটারের বেশি ত্রুটি থাকলে রংগুলি বিকৃতভাবে ফুটে উঠবে৷''
হালকা ও সস্তা সমাধানসূত্র
দ্বিমাত্রিক চিত্র ও ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করতে এক ইউরোপীয় গবেষণা প্রকল্পের আওতায় বিজ্ঞানীরা এই স্ক্যানার ডিজাইন করেছেন৷ শিল্প সংরক্ষণ ও পুনর্গঠনের কাজে যে ধরনের বহুমুখী গুণাগুণের প্রয়োজন, গবেষকদের মতে এই স্ক্যানারের মধ্যে সেই ক্ষমতা রয়েছে৷ প্রকল্পের সমন্বয়ক খাবিয়ের গুতিয়েরেস মেয়ানা বলেন, ‘‘বর্তমানে শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করতে যে সব স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়, সেগুলি খুব ব্যয়বহুল৷ আমাদের প্রযুক্তি সে তুলনায় অনেক সস্তার৷ ফলে আরও ছোট ও হালকা এই স্ক্যানার সহজে মিউজিয়াম বা গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগানো যাবে৷''
কাছ থেকে ভিঞ্চির সেরা চিত্রকর্ম
মোনা লিসার কথা কে না জানে? চিত্রকর্মের ইতিহাসে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র কয়েকটি কাজ অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ এমনই কয়েকটি মাস্টারপিস নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Wenig
সালভাদর মুন্ডি
সম্ভবত ভিঞ্চির একমাত্র চিত্রকর্ম; যা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে৷ ২০১৭ সালে রেকর্ড ভাঙা ৪৫ কোটি মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হয় এটি৷ ১৫০০ সালে আঁকা ছবিটি অক্ষত অবস্থায় থাকা ভিঞ্চি’র আঁকা ২০টি ছবির একটি, যদিও ১৯৫৮ সালে এটি সত্যি তাঁর হাতে আঁকা কিনা সন্দেহ থাকায় একজন ৬০ ডলারে বিক্রি করে দেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Wenig
মোনা লিসা
ভিঞ্চির সবচেয়ে চর্চিত ছবি বোধ হয় এটিই৷ ইটালিতে রেনেসাঁ যুগ যখন শিখরে, তখনই আঁকা হয় এটি৷ তবে ছবির নারীটি কে এবং এটি কত সালে আঁকা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ এটি এখন প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে আছে৷
ছবি: picture-alliance/United Archive
সেন্ট জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট
এটিও ল্যুভর জাদুঘরে আছে৷ জন দ্য ব্যাপ্টিস্টই হলেন সেই সাধু, যিনি যিশুকে মেসিয়াহ বা বার্তাবাহক হিসেবে নিউ টেস্টামেন্টে উল্লেখ করেন এবং তাঁর আগমনের বার্তা ছড়িয়ে দেন৷ ১৫১৩ থেকে ১৫১৫ সালে ভিঞ্চি ভ্যাটিকানে কাজ করতেন৷ তখন পোপ লিও ১০ এই শিল্পকর্মটি তাঁকে তৈরির কাজ দেন৷ সম্ভবত এটিই তাঁর শেষ কাজ৷ ম্যাডোনা অফ দ্য ইয়ার্নউইন্ডার তাঁর আরেকটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম৷
ছবি: picture-alliance/akg-images/A. Held
দ্য লাস্ট সাপার
ভিঞ্চির ‘লাস্ট সাপার’ও জগৎজুড়ে সাড়া ফেলেছিল৷ মিলানের একটি ভবনে এটি একটি ফ্রেস্কো-সেকো ওয়াল পেইন্টিং৷ যেহেতু এটি লাইম প্লাস্টারের ওপর করা, তাই কিছু দিন পরপর ঠিক করতে হয়৷ ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে৷
ছবি: picture-alliance/R. Goldmann
পোর্ট্রেট অফ আ ম্যান ইন রেড চক
‘পোর্ট্রেট অফ আ ম্যান ইন রেড চক’ চিত্রকর্মটি ভিঞ্চির আত্মপ্রতিকৃতি৷ তবে এটি আসল না নকল তা পরিষ্কার নয় বিশেষজ্ঞদের কাছে৷ রয়্যাল লাইব্রেরি অফ টুরিন-এ আছে এটি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Bertorello
স্কেচ
বিজ্ঞানে আগ্রহ ছিল ভিঞ্চির৷ তাই তিনি স্থাপত্য, জীববিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অ্যানাটমি’র নানা ধারণা স্কেচে তুলে ধরেন৷ তিনি ফ্লাইং মেশিন, হেলিকপ্টারের মতো একটি যন্ত্র ইত্যাদি এঁকেছেন৷ এছাড়া তাঁর ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ খুবই বিখ্যাত স্কেচ৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
6 ছবি1 | 6
এই যন্ত্র পরীক্ষার জন্য আস্তুরিয়াস মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস-এর সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা গবেষকদের ক্যানভাস সরবরাহ করেছেন৷ স্ক্যানারের মাধ্যমে মিউজিয়ামের সংগ্রহে রাখা মূল্যবান ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করেও চমকপ্রদ ফল পাওয়া গেছে৷ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ মার্তা ফ্লোরেস ইগুয়াল মনে করেন, ‘‘আমরা বার্নিশের গভীরতা ও রংয়ের স্তর আবিষ্কার করতে পারি৷ মূল চিত্রের নীচে প্রাথমিক কোনো চিত্র ছিল কিনা, কোন উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, সে সবও দেখতে পারি৷ পেইন্টিং-এর মধ্যে বার্নিশ, বাইন্ডার ও পিগমেন্টের মতো যে সব উপাদান রয়েছে, স্ক্যানার তাও শনাক্ত করতে পারে কিনা, আমরা তা জানার চেষ্টা করছি৷''
স্মার্টফোনের প্রয়োগ
গ্রাফিন স্ক্যানারের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্মার্টফোনের জন্য একটি অগমেন্টেড রিয়ালিটি অ্যাপ তৈরি করা হচ্ছে৷ তার সাহায্যে মিউজিয়ামের দর্শকরা র আরও গভীর স্তরে প্রবেশ করতে পারবেন বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা৷ খাবিয়ের গুতিয়েরেস মেয়ানা বলেন, ‘‘এই অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারী পেইন্টিং-এর ভেতরের স্তর দেখতে পারবেন৷ যেমন এই চিত্রে রংয়ের স্তরের নীচে রহস্যজনক সংখ্যা ‘৩৪' চোখে পড়েছে৷ একটি আচ্ছাদন আসলে সবুজ রংয়ের ছিল বলেও আমরা জানতে পেরেছি৷''
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গ্রাফিন স্ক্যানার ও তার প্রয়োগ বাজারে আসতে চলেছে বলে গবেষকরা আশা করছেন৷
মোনালিসা সম্পর্কে যে ৭টি তথ্য আপনার হয়ত জানা নেই
রহস্যময় হাসির কারণে কয়েক শতাব্দী ধরে সারা দুনিয়ায় আলোচনার বিষয় ‘মোনালিসা’৷ বহু শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সঙ্গীতশিল্পী এবং লেখককে অনুপ্রেরণা জোগায় এই শিল্পকর্ম৷ মোনালিসার ৫০০ বছরের ইতিহাস এখনও মানুষকে আবিষ্ট করে৷
ছবি: Museum Louvre/Basiliscus Production
নানা জল্পনা-কল্পনা
১৬ শতকের শুরুতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যার ছবি আঁকেন তা নিয়ে নানান ধরনের জল্পনা- কল্পনা ছিল৷ অনেকে বলতেন, নারী ও পুরুষ- উভয়েই ঐ ছবির মডেল হয়েছিলেন৷ তবে আরও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ব্যাখ্যা মতে, মোনালিসা আসলে ফ্লোরেনটাইনের এক রেশম ব্যবসায়ীর স্ত্রী লিসা দেল জিওকোন্ডো৷
ছবি: Imago/Cinema Publishers Collection
বিখ্যাত অনুরক্তরা
১৫১৯ সালে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মৃত্যুর পর ফরাসি রাজাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছবিটি রাখা হয়৷ ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শোবার ঘরে জায়গা হয় মোনালিসার৷১৮১৫ সালে জনসাধারণের দেখার জন্য এই চিত্রকর্ম রাখা হয় প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে৷
ছবি: picture-alliance/aka-images
মোনালিসার জুড়ি
যমজ মোনালিসার দেখা মেলে মাদ্রিদের মিউজিও ডেল প্রাডোতে৷ ২০১২ সালে জানা যায় যে এই ছবিটি মূল ছবির সময়েই আঁকা হয়েছিল৷ দুটি ছবি একই ইতালীয় ব্যাকগ্রাউন্ড ও ল্যাণ্ডস্কেপে করা৷ দ্বিতীয় ছবিটি সম্ভবত ভিঞ্চির এক ছাত্র ফ্রান্সিসকো মেলজির আঁকা৷
ছবি: dapd
অদৃশ্য কাজ
হারিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ‘মোনালিসা’ কিন্তু সেই অর্থে বিখ্যাত কোনো শিল্পকর্ম ছিল না৷ নিজের দেশে ফেরত নিয়ে যাবার আশায় এক ইতালীয় ১৯১১ সালে প্যারিসের ল্যুভর থেকে ছবিটি চুরি করে৷ ঐ ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রায় দুই বছর ছবিটির কোনো হদিস ছিল না৷ তারপর ছবিটি আবারও ল্যুভরে ফিরে আসে৷
ছবি: picture alliance/Mary Evans Picture Library
আক্রমণের লক্ষ্য
মোনালিসাকে নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করে থাকেন, যার সবই কিন্তু ইতিবাচক নয়৷ ১৯৫৬ সালে এই ছবির ওপর ভাঙচুরের দুটি ঘটনা ঘটে৷ একজন তো ছবিটির ওপর অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে৷ ফলে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় চিত্রকর্মটি৷ এরপর এক বলিভিয়ান পর্যটক এর ওপর পাথর ছোঁড়ে৷ তারপর থেকে, মোনালিসাকে বুলেটপ্রুফ কাঁচের ভেতরে সুরক্ষিত রাখা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Godong/F. de Noyelle
রহস্যের পেছনে ‘স্ফুম্যাটো'র প্রভাব
অগণিত বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ এই শিল্পকর্মের বিশ্লেষণ করেছেন৷ পেয়েছেন বিস্ময়কর সব তথ্য৷ ২০০৮ সালে, মোনালিসার হেঁয়ালিপূর্ণ হাসির রহস্য ভেদ করা হয়৷ ছবি আঁকার একটি কৌশলের নাম ‘স্ফুম্যাটো’৷ ভিঞ্চি ঝাপসা এক ধরণের এফেক্ট তৈরি করতে রংয়ের পাতলা অনেকগুলো স্তর তৈরি করতেন৷ এর ফলেই ছবিতে সৃষ্টি হতো এক ধরনের রহস্যময়তা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C2RMF/V.A. Solé/ESRF
এক দীর্ঘ ইতিহাস
শিল্পের ইতিহাসে ‘মোনালিসা’ কেবল প্রশংসাই লাভ করেনি, বরং অগণিত শিল্পীকে বৈচিত্রপূর্ণ কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছে৷ বিংশ শতাব্দীর এই মিডিয়া আইকনকে সাহিত্য, সঙ্গীত, বিজ্ঞাপন সবকিছুতেই পাওয়া যায়৷ বব ডিলান একবার বলেছিলেন, ‘‘মোনালিসার অবশ্যই হাইওয়ে ব্লুজ আছে৷ ওর হাসি দেখেই তা বলে দেয়া যায়৷’