বন্ধ হয়ে গেল একসময়ের বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্যপ্রযুক্তি মেলা ‘সেবিট'৷ আবার সেবিটকে আকর্ষণীয় করে তুলে অংশগ্রহণকারীদের আগ্রহ ফেরানোর অনেক চেষ্টা করলেও ব্যর্থ আয়োজনকারীরা৷
বিজ্ঞাপন
হানোফার শহরে প্রতি বছর হয়ে আসা এই মেলা বন্ধের পেছনে ক্রমহ্রাসমান দর্শকসংখ্যাকেই মূলত দায়ী করেছেন আয়োজকরা৷ একই সাথে এর পেছনে যে বিপুল পরিমাণ খরচ হয়, মেলার প্রদর্শনীর ভাড়া থেকে তার কিছুই ফেরত না আসাও অন্যতম কারণ৷
একসময় নানা দেশ থেকে সাড়ে আট লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নিতেন বার্ষিক এই আয়োজনে৷ বিশেষ করে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে প্রযুক্তি কোনদিকে যাচ্ছে, তার ব্যারোমিটার হিসেবে ধরে নেয়া হতো এই মেলাকে৷
কিন্তু নতুন শতাব্দীতে এসে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও বিশ্বের নানা জায়গায় আরো আকর্ষণীয় মেলার আয়োজনের ফলে একসময় আকর্ষণ হারাতে থাকে সেবিট, কমতে থাকে যোগদানকারীর সংখ্যা৷
সেবিট মেলায় জাপানের চমক
‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’ বলে পরিচিত জাপান হানোফার শহরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্য-প্রযুক্তি মেলা সেবিট-এ সহযোগী দেশ৷ ‘সোসাইটি ৫.০’ বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রায় ১২০টি কোম্পানি জীবনযাত্রার উপর ডিজিটাল প্রভাবের কিছু নমুনা তুলে ধরেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
রোবট ও কঙ্কাল
‘এক্সোস্কেলিটন’ বা কঙ্কালসার রোবট কারখানার কর্মীদের ভারি জিনিসপত্র বহন করতে সাহায্য করে৷ পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে চলাফেরায়ও সহায়তা করতে পারে তারা৷ এর প্রস্তুতকারক নেডো নামের জাপানি কোম্পানির কর্মীরা মেলায় জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-র জন্য অপেক্ষা করছেন৷
ছবি: DW/A. Becker
আগন্তুক, পরিচিত না বন্ধু?
এ বছরের সেবিট মেলায় অনেক রোবট তাদের কেরামতি দেখাচ্ছে৷ জাপানের ইঞ্জিনিয়াররা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করে রোবটদের আচরণ যতটা সম্ভব মানুষের মতো করে তোলার চেষ্টা করছেন৷ সেই রোবট মুখ দেখে মানুষ চিনতে পারে, ‘বন্ধু’-দের আলাদা করে খাতির-যত্ন করে৷ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জাপানে রোবটরা আরও বেশি করে বয়স্ক মানুষদের দেখাশোনা ও হোটেলে পরিষেবার কাজ করছে৷
ছবি: DW/A. Becker
রূপে-গুণে লক্ষ্মী
এই রোবট ‘চিয়ারলিডার’-রা শুধু দেখতেই মিষ্টি নয় – কাজেকর্মে তারা কম যায় না৷ নানা রকম সেন্সর ও মোটর ভরা এই যন্ত্রদের যা শেখানো হয়, তা নির্ভুলভাবে করে দেখায় তারা৷ শিল্পক্ষেত্রে রোবটের প্রয়োগের ক্ষেত্রে জাপান দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে৷ প্রতি ১০,০০০ কর্মীর অনুপাতে ২১১ টি করে রোবট সেখানে কাজ করে৷ শীর্ষ স্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, তৃতীয় স্থানে জার্মানি৷
ছবি: DW/A. Becker
অ্যাপ-সর্বস্ব জীবনযাত্রা
জাপানে সন্তানসম্ভবা মায়েদের এক তৃতীয়াংশই ‘নিম্পু টেকু’ নামের একটি অ্যাপ ব্যবহার করেন৷ অন্তত তার নির্মাতা হাকুহোডো কোম্পানি এমনটাই দাবি করে৷ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য, ডাক্তারদের কাছে প্রশ্ন, চেকআপ-এর সময় স্থির করা – এই সব কাজ একটি অ্যাপের মাধ্যমেই করা যায়৷ ১৯৪২ সাল থেকে জাপানে যে ‘মাদার্স পাসপোর্ট’ চালু আছে, এই অ্যাপ তারই উত্তরসূরি৷ সন্তান মানুষ করার কাজে সাহায্য করতেও আলাদা অ্যাপ রয়েছে৷
ছবি: DW/A. Becker
উড়ন্ত সঙ্গী বেশি দূরে নেই!
শক্তিশালী হাত ও মোটরের কল্যাণে ‘প্রোড্রোন’ নামের উড়ন্ত যন্ত্র বেশ ভারি জিনিসপত্র বহন করতে পারে৷ এমনকি আপনাকেও তুলে নিয়ে উড়ে যেতে পারে৷ এর আরেকটি সংস্করণের আবার চাকাও আছে৷ ফলে সেটি দেওয়াল বা সিলিং-এর উপর চলে বেড়াতে পারে, ফাটল শনাক্ত করতে পারে৷ মূল্য প্রায় ৫০,০০০ ইউরো৷ তবে ধীরে ধীরে এমন ড্রোনের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে৷
ছবি: DW/A. Becker
কাগজপত্র নিয়ে মাথাব্যথা
ব্যবসা বা অফিসের কাজে বাইরে গেলে খরচের দিকে নজর রাখতে হয়৷ সেই কাজে সাহায্য করতে এসে গেছে অ্যাপ৷ এক্ষেত্রে জাপানের অন্যতম প্রধান কোম্পানি এআইওয়ার্কস এমন এক অ্যাপ তৈরি করেছে, যা দিয়ে বিলের ছবি তুললেই চলবে৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার বাকি কাজ করে দেবে৷ কোম্পানির মতে, জাপানের অফিস কর্মীরা গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ সময় ডেটা এন্ট্রি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন৷ এবার সেটা বদলাতে চলেছে৷
ছবি: DW/A. Becker
নিজের বাস্তব পছন্দ নয়? অন্য একটি বেছে নিন!
অদূর ভবিষ্যতে কোটি কোটি মানুষ নিজেদের ব্যস্ততা ও সমস্যা ভরা জীবনযাত্রা থেকে রেহাই পেতে ‘ভার্চুয়াল রিয়ালিটি’ পরিবেশে ডুব দেবেন বলে পূর্বাভাষ শোনা যাচ্ছে৷ সেরেভো-র মতো কোম্পানি শরীরের বিভিন্ন অংশে পরার জন্য ভি-আর টুল তৈরি করছে৷ যেমন এই বিশেষ জুতো ব্যবহারকারীর পায়ের নীচে সিমেন্ট, ঘাস বা বরফের উপর চলার অনুভূতি সৃষ্টি করে৷ এর পরের ধাপে সারা শরীরের জন্য ভি-আর স্যুট তৈরির পরিকল্পনা চলছে৷
ছবি: DW/A. Becker
চারিদিকে সারাদিন কারাওকি!
‘লিরিক স্পিকার’ আসলে এক সাধারণ লাউডস্পিকার – শুধু একটি পর্দা ও বিশেষ সফটওয়্যারের সঙ্গে যুক্ত, যা কোনো গান চালালেই শনাক্ত করতে পারে৷ তারপর তালে তালে গানের কথা পর্দায় ফুটে ওঠে৷ অতএব আলাদা করে কারাওকি বার-এ যাবার দরকার নেই৷ যখন খুশি, যেখানে খুশি পছন্দের গান সঠিকভাবে গাইতে পারেন৷
ছবি: DW/A. Becker
8 ছবি1 | 8
তবে এবার শুধু প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধ না থেকে, এর সাথে মজার কিছু আবহ যোগ করে দর্শক টানার চেষ্টা করেছিলেন আয়োজকরা৷ প্রয়ুক্তির নানা মজার মজার ব্যবহার, বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের আকৃষ্ট করবে বলে ধারণা ছিল তাঁদের৷ কিন্তু তাতেও খুব একটা সাড়া মেলেনি৷
সেবিটকে নতুনভাবে সাজানোর মাধ্যমে হারানো শীর্ষস্থান ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবে রাজী হয়েছিল হেওলেট প্যাকার্ড এন্টারপ্রাইজ, ভোডাফোন এবং সেলসফোর্সের মতো প্রযুক্তি খাতের শীর্ষ কোম্পানিগুলো৷ কিন্তু মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি ‘জায়ান্টরা' এতে একমত হতে পারেনি৷
সেবিটের আয়োজক ডয়চে মেসের প্রধান নির্বাহী ইয়োশেন ক্যোকলার জানিয়েছেন, হানোফার বাণিজ্য মেলা শিল্পসংশ্লিষ্ট সব ধরনের প্রযুক্তির মেলায় পরিণত হয়েছে৷ ফলে এককভাবে আর কখনো আয়োজন না হলেও, বৃহত্তর এক মেলার অংশ হিসেবে কোনো-না-কোনোভাবে কাজ করে যাবে সেবিট৷
সেবিট চিরতরে বন্ধের ঘোষণার ফলে তথ্যপ্রযুক্তির একটি সুবর্ণ যুগের অবসান হলো বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা৷ পাশাপাশি, এই খাতে জার্মানির ক্রমশ কমতে থাকা প্রভাব একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকার আশংকাও করছেন তাঁরা৷
সেবিট-এ এক টুকরো বাংলাদেশ
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র উদ্যোগে ১৯৯৯ সাল থেকে সেবিট-এ অংশ নিতে শুরু করে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান৷ এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি৷ সফটওয়্যার নির্মাতারা নানা পণ্য নিয়ে হাজির এবার৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
সেবিট-এ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সেবিট যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র উদ্যোগে৷ সেই যাত্রায় এবার হানোফারের মেলায় হাজির দশটির বেশি প্রতিষ্ঠান৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই মেলায় বাংলাদেশি সফটওয়্যার নির্মাতা নিয়ে এসেছে গাড়ির জন্য অ্যাপস থেকে শুরু করে নিরাপদ ই-মেল ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন পণ্য এবং সেবা৷
ছবি: DW/A. Islam
গাড়ির জন্য অ্যাপস
গাড়ির কোথাও সমস্যা হলে সহজেই তা জানার এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের এক অভিনব মুঠোফোন অ্যাপস তৈরি করেছে ডাটাসফট৷ সেবিট-এ এই অ্যাপসের কর্মকাণ্ড দর্শনার্থীদের প্রদর্শন করেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এম. মনজুর মাহমুদ৷ ১৯৯৯ সাল থেকে নিয়মিত হানোফারের মেলায় অংশ নিচ্ছে ডাটাসফট৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
ওয়েবনির্ভর ই-গভর্নেন্স সফটওয়্যার
সেই ১৯৯৯ সাল থেকে নিয়মিত সেবিট-এ অংশ নিচ্ছে লিডসফট৷ মেলায় হাজির প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তার একজন রমিজুর রহমান খান জানান, এবার তারা ওয়েবনির্ভর ই-গভর্নেন্স সফটওয়্যারের দিকে বেশি মনযোগ দিচ্ছেন৷ পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস৷ ডেনমার্কের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে লিডসফট৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
ই-মেলের নিরাপত্তায় বিশেষ সিস্টেম
গুগল কিংবা ইয়াহুর মতো ই-মেল সেবায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি নিয়ে গোটা বিশ্ব সোচ্চার এখন৷ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ই-মেল যোগাযোগকে গোয়েন্দাদের নজর থেকে বাইরে রাখার নতুন এক পদ্ধতি সেবিট-এ প্রদর্শন করছে বিয়ন্ড টেকনোলজিস৷ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সালাউদ্দিন পাশা জানান, তাদের ই-মেল সেবার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ব্যবহারকারীর কাছে৷ তৃতীয় কোনো পক্ষ এই ব্যবস্থা থেকে তথ্য চুরির সুযোগ পাবে না৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি
সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এসডিএসএল পণ্য কিংবা সেবা তৈরি করে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী৷ ক্রেতা সেই পণ্য চাইলে বিক্রি করতে পারেন নিজের নামে৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, মূলত জিআইএস নির্ভর ম্যাপ, নেভিগেশন অ্যাপস এবং সফটওয়্যার তৈরি করি আমরা৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
বছরে আয় এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার
ব্রেইন স্টেশনের বয়স এখনো চার বছর হয়নি৷ তবে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক আয় মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে৷ ব্রেইন স্টেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাইসুল কবির জানান, পার্টনার দেশের সন্ধানে সেবিট-এ এসেছেন তাঁরা৷ নিজের কর্মকাণ্ডে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশীদার করতেও আগ্রহী তাঁরা৷ ছবিতে সেবিটে অংশ নেয়া ব্রেইন স্টেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
সিসটেক ডিজিটাল
ই-লার্নিংকে এখনো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে সিসটেক ডিজিটাল৷ তবে বিশ্বব্যাপী মোবাইল অ্যাপসের চাহিদার দিকেও নজর রয়েছে তাদের৷ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা এম. রাশেদুল হাসান সস্ত্রীক মেলায় অংশ নিয়েছেন৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
সেবিট-এ হাইটেক পার্ক অথরিটি
বাংলাদেশে বহুল প্রত্যাশিত তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র হাইটেক পার্ক এখনো নির্মাণাধীন পর্যায়ে রয়েছে৷ তবে সেবিট-এ প্রদর্শনরত হাইটেক পার্ক অথোরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম জানিয়েছেন, চলতি বছরের মধ্যেই কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কের কার্যক্রম শুরু হবে৷ এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগে এরকম পার্ক তৈরির উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি৷