জার্মানির সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়ে গেছে, কিন্তু সরকার গড়তে জোট চূড়ান্ত হয়নি তখনো৷ টানা ষোল বছর ধরে চ্যান্সেলর থাকা ম্যার্কেল তখন ‘কেয়ারটেকার চ্যান্সেলর'৷ এরইমাঝে তিনি তৈরি করলেন চমৎকার এক উদাহরণ৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ'র ভরাডুবি হয়েছে৷ দলটির চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী আরমিন লাশেট জনগণের পর্যাপ্ত সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হন৷ ফলে নির্বাচন পরবর্তী জোট গড়তে ছোট দলগুলোর কাছে সিডিইউ'র চেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক গণতন্ত্রী দল এসপিডির গুরুত্ব বেড়ে যায়৷
লাশেট সহজে পরাজয় মেনে নেয়ার পক্ষে ছিলেন না৷ বরং নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও তার মাঝে ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষীণ বাসনা দেখা গিয়েছিল৷ তিনি আশা করেছিলেন, এসপিডি হয়ত মুক্ত গণতন্ত্রী দল এফডিপি আর পরিবেশবান্ধব সবুজ দলের সঙ্গে জোট গড়তে পারবে না৷ কারণ এই দলগুলোর নীতিগত কিছু অবস্থান সাংঘর্ষিক৷ বিশেষ করে এফডিপি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার দল হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে সবুজ দল চায় তরুণ প্রজন্মকে সামনে নিয়ে পরিবেশরক্ষায় গুরুত্ব দিতে৷ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
অতীতে এই দুই দল মিলতে পারেনি বলে সম্ভাব্য জোট ভেঙে যাওয়ার নজির আছে৷ ফলে এবার কী হয় সেটা নিয়েও অনেকের আগ্রহ ছিল৷
এক সম্মেলনে দুই নেতা
সামাজিক শিষ্টাচার কমছে, রোধের উপায় কী?
বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে যেন ভালো ব্যবহার করার অভ্যাস দিন দিন কমছে৷ কথায় কথায় অন্যকে ছোট করতে পারার মনোভাব দেখা যাচ্ছে৷ কেন এমন হচ্ছে, পরিবর্তন আনার উপায় কী?
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের একজন দায়িত্বশীল প্রতিমন্ত্রী নারীদের জড়িয়ে যেসব কথা বলেছেন, ওনার পদ-পদবি থেকে এ ধরণের কথা কখনোই গ্রহণযোগ্য না৷ আসলে আমাদের যে নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে, সেটার প্রতিফলন আমরা এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেখতে পাচ্ছি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনেকেই এমন, শুধু প্রমাণের অভাব
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হুমায়রা রেজওয়ানা বলেন, ‘‘মেয়েরা একা চলতে ভয় পায়৷ কিছুক্ষেত্রে মেয়েরা এমনভাবে উত্যক্তের শিকার হয়, যা সাধারণত প্রকাশ্যে আসে না৷ গণপরিবহণে শারীরিক নিগ্রহ, মানুষের বাজে চাহনি, হঠাৎ করে ইচ্ছাকৃত ধাক্কা- এসব হরহামেশা ঘটে৷ কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন, তবে অনেকেই চেপে যান৷ এসবের প্রতিবাদ করতে গেলে প্রমাণ চান সবাই৷ ব্যাপারগুলো এত দ্রুত ঘটে যে কিছু বুঝার আগেই অপরাধী ভিড়ে হারিয়ে যায়৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আগের ধর্মীয় সম্প্রীতি এখন কি আছে?’
ঢাকার মিরপুরের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘বাপ-দাদাদের আমলে আমরা সব ধর্মের মানুষ ভাইয়ের মতন এক সাথে থাকসি, পড়সি, চলাফেরা করসি৷ এখন মাঝেমাঝেই শুনি জঙ্গি হামলা, মন্দির ভাঙসে, মূর্তি ভাঙসে, মানুষ মারা গেসে- এইসব৷ এত এত মিডিয়ার কারণেই হোক আর যা-ই হোক, আমার মনে হয় ধর্ম নিয়া এখন অনেক কিছু চলে যা আমরা সাধারণ মানুষ বুঝি না৷’’
ছবি: bdnews24.com
‘আমরা গরিব, আমাগো কি সম্মানের দাম আছে?’
ঢাকার মিরপুর ১২র এক পোশাক কারখানার কর্মী সালেহা আক্তারকে দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরায় একজন নারী হিসেবে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা স্যার গরিব মানুষ৷ সবারই আমাগো উপর অধিকার আছে৷ মার্কেটে, ফুটপাথে, বাসে সব জায়গাতেই আমরা অসম্মানের শিকার হই৷ আমার মনে হয় বাংলাদেশের সব মাইয়ারাই কম-বেশি এই জিনিস সহ্য কইরাই পথেঘাটে চলাফেরা করে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানোই এ দেশে পাপ
ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন ঠিকাদার মো. আব্দুস সালাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ কিন্তু শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী৷ এই দেশে যার পরিবারে একজন প্রতিবন্ধী আছে, সে-ই শুধু বুঝে এর জ্বালা কী৷ অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে এমন সন্তানের তো পরিচয়ই দেন না৷ আত্মীয়-স্বজন-পাড়া প্রতিবেশী কেউই বাঁকা কথা শোনাতে ছাড়ে না৷ এই দেশে অসুস্থ তো দূর, সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ হয়ে জন্মানোও পাপ৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাইরে পাঠাতে ভয় পাই’
ঢাকার নাখালপাড়ায় পরিবার নিয়ে বাস করেন ফারহানা ইয়াসমিন৷ তিনি বলেন, ‘‘অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে আমরা মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাইরে পাঠাতে ভয় পাই৷ দেখা যায়, টিউশনি বা এ রকম জরুরি কিছু থাকলেও আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি কী করবো সেটা নিয়ে৷ ছেলেমেয়েরা যখন এ রকম হেনস্থার শিকার হয়, তখন তাদের সৃজনশীলতাসহ যাবতীয় কাজকর্মে এসবের বাজে প্রভাব পড়ে, যা কখনোই কাম্য না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমার নিজের হেল্পারই বেয়াদবি করসে’
ঢাকার আব্দুল্লাহপুর-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী বিআরটিসি বাসের চালক সোহেল রানা বলেন, ‘‘রাস্তাঘাটে চলাফেরা করি, অনেক ন্যায়-অন্যায়ই চোখে পড়ে৷ আমগো সামর্থ্য কম, তাই ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারি না৷ বাইরের কথা কী কমু, আমারই এক হেল্পার মেয়ের লগে অসম্মানি আচরণ করতো৷ কী আর কমু কন?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিবর্তন কবে আসবে জানা নেই
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট উম্মে কুলসুম বলেন, ‘‘নারীর প্রতি হেনস্থা বা কটু মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া খুবই নীচু মন-মানসিকতার লক্ষণ৷ অধিকাংশ পুরুষ মানুষ নারীদের ভোগ্য পণ্যই মনে করে৷ শিক্ষা-অশিক্ষা এ ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ তৈরি করতে পারে না৷ বডি শেমিং বলেন আর ইভটিজিং বলেন, সব সূত্র একই সুতোয় গাঁথা৷ এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে আমরা কবে বের হয়ে আসতে পারবো কেউ জানে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পারিবারিক শিক্ষা
সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী মো. সাকিবুল হাসান বলেন, ‘‘আমাদের যে আচরণগত বৈশিষ্ট্য, এগুলো মূলত তৈরি হয় পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে৷ নারীদের প্রতি মনোভাব, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, ভদ্রতাবোধ আপনি যা-ই বলেন না কেন, পারিবারিক শিক্ষাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে৷ তাই আমার মনে হয়, আমাদের অভিভাবকদের এই ক্ষেত্রে আরো বেশি সচেতন হতে হবে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষায় নম্বর থাকা উচিত
রাজনৈতিক কর্মী আফজাল হোসেন খান বলেন, ‘‘আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল অর্থনৈতিক উপার্জন করার দিকে ধাবিত হচ্ছে, কিন্তু নৈতিকতা বা মূল্যবোধের মূল্যায়ন এখানে তেমনভাবে করা হয় না৷ আমার মনে হয়, অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা শিক্ষাও আমাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তরুণ প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলেন, ‘‘নারীর প্রতি যৌন হয়রানি সমাজের হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে৷ বিষয়টি আরো হতাশাজনক হয় যখন দেখি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এমন মন্তব্য করেন৷ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার এখনই সময়৷ তা না হলে নারীর প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে, সেক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম তার রোল মডেল নির্বাচনে দিশেহারা হয়ে পড়তে পারে৷’’
ছবি: privat
পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, বর্তমানে বাবা-মা দুজনই কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ছে৷ ফলে পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে৷ ছেলে-মেয়েরা পরিবারের বদলে নিজেদের মতো করে যে-কোনো উৎস থেকে শিখছে, যা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভুল পথে পরিচালিত করে৷ এ থেকে পরিত্রাণের জন্য পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বাচ্চারা যেন মোবাইল, ইন্টারনেটে অবাধে প্রবেশাধিকার না পায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷
ছবি: MD Mehedi Hasan/Zuma/picture alliance
12 ছবি1 | 12
এদিকে, টানা ষোল বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ম্যার্কেল সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর হয়ে যান ‘কেয়ারটেকার চ্যান্সেলর’৷ অর্থাৎ, পরবর্তী চ্যান্সেলর ক্ষমতা গ্রহণ না করা অবধি দায়িত্বে থাকবেন তিনি৷ চলতি মাসে জোট সরকার চূড়ান্ত করতে সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় এসপিডি, এফডিপি ও সবুজ দল৷ ফলে গত বুধবার এসপিডি দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী ওলাফ শলৎস চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নেন৷ শেষ হয় ম্যার্কেলের কার্যকাল৷
তো এই ম্যার্কেল গত অক্টোবরে ইটালির রাজধানী রোমে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে গেলেন শলৎসকে৷ তখনো শলৎসের জোট চূড়ান্ত হয়নি৷ ম্যার্কেলের নিজের দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী লাশেটও আশা ছাড়েননি৷
তারপরও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের চমৎকার উদাহরণ তৈরি করে ম্যার্কেল নিজের সঙ্গে শলৎসকে নিয়ে যান জি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে৷ তিনি সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে শলৎসই হতে যাচ্ছেন তার উত্তরসূরী৷ তাই বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন সম্মেলনে৷
অতীতের শিক্ষা, গণতন্ত্রই শক্তি
জার্মানির নির্মম অতীত ইতিহাস রয়েছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখ লাখ ইহুদি হত্যা করেছে নাৎসিরা৷ সেসময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধে মারা গেছেন কোটি কোটি মানুষ৷
জার্মানি সেই যুদ্ধের দায় স্বীকার করেছে অকপটে৷ তবে ক্ষমা চেয়ে, ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজেদের ভুল শুধরে আবার সঠিক পথে ফিরে যেতে দেশটি খুব বেশি সময় নেয়নি৷ বিশ্বের বুকে গত কয়েক দশকে দেশটি আবারো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে গণতন্ত্র৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানি গণতন্ত্রকে এতটাই শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে যে রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থার সর্বত্র জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে৷
এই দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত মূলধারার দলগুলো মধ্যে চিরশত্রুতা বলে কিছু নেই৷ দেশটির সবচেয়ে বড় দুটি দল হচ্ছে মধ্য ডানপন্থি সিডিইউ এবং মধ্য বামপন্থি এসপিডি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই দল দুটি কখনো সরকারে এবং বিরোধী দলে থেকে যেমন সংসদে থেকেছে, তেমনি একটি বড় সময় দুটো দল মিলে জোট গড়েও জার্মানি পরিচালনা করেছে৷
আবার ছোট দলগুলোর কথা যদি ধরেন - যে এফডিপি ও গ্রিন চার বছর আগেও জোট গড়তে ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের দূরত্ব ঘোচাতে না পেরে তারাই আবার চার বছর পর নিজেদের মধ্যকার বিভেদ মিটিয়ে এসপিডির সঙ্গে জোট গড়ে জার্মানি শাসনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে৷
ইউরোপের দেশটির রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে চিরশত্রুতা বলে আসলে দলগুলোর মধ্যে কোনো ব্যাপার নেই৷ তাই তাদের নেতাদের বা সমর্থকদের সারাক্ষণ প্রতিপক্ষের কুৎসা রটনা করে কিংবা নোংরা, কুরুচিপূর্ণ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্য করে শত্রুতা জিইয়ে রাখার দরকার হয় না৷
উগ্র ডানপন্থিদের সঙ্গে জোট নয়
জাতীয় স্বার্থে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য বেশ মজবুত৷ জার্মানিতে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা উগ্র ডানপন্থি ‘অল্টারনেটিভ ফর ডয়চেল্যান্ড (এএফডি)’ দলের কথাই ধরুন৷ গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এই দলটি কোনো নিষিদ্ধ ঘোষিত দল নয়৷ কিন্তু সেটির নীতিগত অবস্থান কিছু ক্ষেত্রে জার্মানি যে অতীতের জন্য অনুতপ্ত সেই অতীতের রাজনৈতিক নীতির সঙ্গে মিলে যায়৷
তাই এই দলটির সঙ্গে জোট না গড়ার বিষয়ে শুরু থেকেই একমত সিডিইউ, এসপিডি, এফডিপি বা সবুজ দল৷ ফলে দশ শতাংশের বেশি মানুষের ভোট পাওয়া এএফডি সংসদে থাকলেও তাদের কোনো ক্ষমতা নেই৷
কেননা, কেউই তাদেরকে নিয়ে জোট গড়ে রাষ্ট্রীয় নীতি বদলানোর ক্ষমতা তাদের দেবে না৷ বরং কেন মানুষ এএফডিকে ভোট দিচ্ছে সেটা অনুধাবন করে সুযোগ থাকলে তাদের নিজেদের দলে ফিরিয়ে আনা বা কঠোর হস্তে উগ্র ডানপন্থাকে দমনের দিকেই যাচ্ছে অন্য দলগুলোর জোট৷
রাজনীতি যখন প্রকৃত অর্থে দেশ ও জনগণের স্বার্থে হয় তখন এসব বিষয় সহজেই সম্ভব হয়৷ তাই, এখনো যারা রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষের প্রতি চির শত্রুতা লালন করেন কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে যে-কোনো দলের সঙ্গেই জোট গড়তে চান, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত৷ নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির স্বার্থ দেখুন৷ সবাই মিলে এমন এক গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলুন যেখানে জনগণের রায়ই শেষ কথা৷
জার্মানির নতুন মন্ত্রিপরিষদে যারা আছেন
শলৎস সরকারের মন্ত্রিসভায় নারী রয়েছেন পঞ্চাশ শতাংশ৷ শুধু তাই নয়, দেশটিতে প্রথম কোনো নারী হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ চলুন জেনে নেয়া যাক, কারা কারা রয়েছেন নতুন সরকারে৷
জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল এসপিডির রাজনীতিবিদ ওলাফ শলৎস দেশটির নবম চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন৷ তিনি এসপিডির চতুর্থ রাজনীতিবিদ যিনি এই পদ পেলেন৷ শলৎস এর আগে ম্যার্কেলের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী এবং ডেপুটি চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ হামবুর্গের সাবেক এই মেয়রের মধ্যডানপস্থি দল গত সেপ্টেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে বিস্ময়করভাবে জিতে যায়, যদিও গত কয়েক বছর ধরে দলটির জনপ্রিয়তা কম ছিল৷
ছবি: Michael Kappeler/picture alliance/dpa
অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার (এফডিপি)
মিডিয়াস্যাভি ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার ২০১৩ সাল থেকে জার্মানির মুক্ত গণতন্ত্রী দল এফডিপির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন৷ তিনি এমন এক সময় দলটির দায়িত্ব নেন, যখন সেটি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মতো অবস্থাতেও ছিল না৷ লিন্ডনারের নেতৃত্বে সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দলটি এবং শলৎস সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন দলটির প্রধান৷
অর্থনীতি ও জলবায়ু সুরক্ষামন্ত্রী এবং ভাইস চ্যান্সেলর ব়্যোবার্ট হ্যাবেক (সবুজ দল)
জার্মানির সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতি মন্ত্রণালয়ে জলবায়ু সুরক্ষাকে অন্তর্ভূক্ত করতে সক্ষম হয়েছে সবুজ দল৷ আর সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন সবুজ দলের সহ-প্রধান ৫২ বছর বয়সি ব়্যোবার্ট হ্যাবেক৷ তিনি দলটির অপেক্ষাকৃত উদারপন্থি ‘বাস্তববাদী’ অংশের সদস্য৷ শিশুদের জন্য বই লেখা এই রাজনীতিবিদ তার নিজের রাজ্য স্লেশভিশ-হল্সটাইনে পরিবেশ এবং কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷
ছবি: Reuhl/Fotostand/picture alliance
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক (সবুজ দল)
সবুজ দলের চল্লিশ বছর বয়সি চ্যান্সেলর প্রার্থী আনালেনা বেয়ারবক চ্যান্সেলর হতে না পারলেও শলৎসের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পেরেছেন৷ তিনি ইতোমধ্যে জার্মানির চীন নীতি কঠোর করার ইঙ্গিত দিয়েছেন৷
ছবি: Bernd Settnik/picture alliance/dpa
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফায়েজার (এসপিডি)
শলৎসের মন্ত্রিপরিষদের সবচেয়ে বড় বিস্ময় সম্ভবত ন্যান্সি ফায়েজার৷ এসপিডি দলের এই নারী রাজনীতিবিদকে জার্মানির বড় মন্ত্রণালয়গুলোর একটি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন উগ্র ডানপন্থিদের প্রতি সরকার আরো কড়া হতে সম্ভবত তাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ তিনি হচ্ছেন জার্মানির প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
ছবি: Hannibal Hanschke/REUTERS
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্ল লাউটারবাখ্ (এসপিডি)
টেলিভিশন টকশো-তে স্পষ্টভাষী হিসেবে জার্মানদের কাছে জনপ্রিয় লাউটারবাখ্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ তিনি করোনা সংক্রমণ রোধে সবার জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করার মতো কড়া পদক্ষেপ নিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa
বিচারমন্ত্রী মার্কো ব্যুশমান (এফডিপি)
এফডিপির ৪৪ বছর বয়সি রাজনীতিবিদ মার্কো ব্যুশমান ২০০৯ সালে প্রথম কেন্দ্রীয় সংসদের সাংসদ নির্বাচিত হন৷ পরবর্তীতে দলটির চরম দুর্দিনেও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ছিলেন তিনি৷ মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় তৎপর হিসেবে সুনাম রয়েছে তার৷
ছবি: Torsten Sukrow/SULUPRESS.DE/picture alliance
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রিষ্টিন লাম্বব্রেশট্ (এসপিডি)
ম্যার্কেল সরকারের সর্বশেষ বিচারমন্ত্রীকে এবার দেশটির সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবশ্য ধারণা করেছিলেন ৫৬ বছর বয়সি এই রাজনীতিবিদকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হবে, কেননা সামরিক বিষয়ে তার জ্ঞান সীমিত৷
ছবি: Hannibal Hanschke/REUTERS
খাদ্য এবং কৃষিমন্ত্রী চেম ও্যজডেমির (সবুজ দল)
সবুজ দলের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ চেম ও্যজডেমির অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকারে জায়গা পেলেন৷ জার্মান মন্ত্রি পরিষদে এই প্রথম একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবদ জায়গা পেলেন৷ তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত চেম প্রায় এক দশক ধরে সবুজ দলের সহ-চেয়ারম্যান৷
১৯৮৯ সালে পূর্ব জার্মানিতে সবুজ দলের প্রথম শাখা চালু করা স্টেফি ল্যামকেকে জার্মানির সবচেয়ে বড় নামের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ ১৯৯৪ থেকে ২০০২ সাল অবধি জার্মান সংসদে থাকাকালে আফগান যুদ্ধে জার্মানির অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি৷
ছবি: Hendrik Schmidt/picture alliance/dpa
পরিবহণ ও ডিজিটাল অবকাঠামোমন্ত্রী ফল্কার ভিসিং (এফডিপি)
সঙ্গে গড়া জোট সরকারে তাই তিনি অপরিচিত কোনো মুখ নন৷ এর আগে পাঁচ বছর রাইনল্যান্ড-পালাটিনাট রাজ্যের রাজ্য সংসদে অর্থনীতি মন্ত্রণালয় সামলেছেন তিনি৷
ছবি: Michael Kappeler/picture alliance/dpa
নির্মাণ এবং গৃহায়ণমন্ত্রী ক্লারা গেভিৎস (এসপিডি)
শলৎসের মন্ত্রিপরিষদে জায়গা পাওয়া প্রাক্তন পূর্ব জার্মানির দুই রাজনীতিবিদের একজন ক্লারা গেভিৎস৷ জার্মানিতে বেড়ে ওঠা গৃহায়ণ সমস্যার সমাধানে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Imago Images/M. Müller
শ্রম এবং সমাজ বিষয়ক মন্ত্রী হুবার্টাস হাইল (এসপিডি)
ম্যার্কেলের সর্বশেষ সরকারে থাকা পদটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন এসপিডির হাইল৷ তার দল যে তার উপর সন্তুষ্ট - এটা তারই ইঙ্গিত৷ জার্মানিতে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর পাশাপাশি ‘হোম ওয়ার্কার’-এর ঘাটতি মোকাবিলা ও তাদের মজুরি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেবেন তিনি৷
ছবি: Uwe Koch/Eibner-Pressefoto/picture alliance
অর্থনীতি সহায়তা এবং উন্নয়নমন্ত্রী স্যোয়েনিয়া শুলৎসে (এসপিডি)
ম্যার্কেল সরকারের পরিবেশমন্ত্রী স্যোয়েনিয়া শুলৎসে হচ্ছেন শলৎসের প্রথম উন্নয়নমন্ত্রী৷ ৫৩ বছর বয়সি এই রাজনীতিবিদ পরমাণু বিদ্যুতের ঘোরবিরোধী এবং বিভিন্ন পরিবেশ বিষয়ক সংস্থার সদস্য৷
ছবি: Birgit Maass/DW
শিক্ষা এবং গবেষণামন্ত্রী বেটিনা স্টার্ক-ভাটসিঙ্গার (এফডিপি)
হাসে এফডিপির প্রধান ৫৩ বছর বয়সি বেটিনা স্টার্ক-ভাটসিঙ্গার নতুন জোট সরকারের অন্যতম সমঝোতাকারী ছিলেন৷ অর্থ এবং শিক্ষাবিষয়ক নীতির বিশেষজ্ঞ তিনি৷
ছবি: Michael Kappeler/picture alliance/dpa
পরিবার, জ্যেষ্ঠ নাগরিক, নারী, এবং যুবমন্ত্রী আনে স্পিগেল (সবুজ দল)
৪১ বছর বয়সি আনে স্পিগেল ইতোমধ্যে রাজনীতিতে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন৷ রাজ্য পর্যায়ে পরিবার, এবং জলবায়ু সুরক্ষা মন্ত্রণালয় সামলানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তার৷ এবার কেন্দ্র সরকারে তার অবস্থান নিশ্চিত হলো৷
ছবি: Armando Babani/AFP
‘চিফ অব স্থাফ’ এবং স্পেশাল অ্যাফেয়ার্সমন্ত্রী ভল্ফগাং স্মিডট (এসপিডি)
মন্ত্রিপরিষদে শলৎসের ডানহাত হবেন ভল্ফগাং স্মিডট৷ শলৎস যখন হামবুর্গের মেয়র ছিলেন, তখন তিনি তার সঙ্গে কাজ করেছেন৷ তিন দলের মধ্যকার মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কাজে মূলত সমন্বয় করবেন স্মিডট৷
ছবি: Kay Nietfeld/picture alliance/dpa
সংস্কৃতি এবং গণমাধ্যম বিষয়ক কমিশনার ক্লাউডিয়া ব়্যুথ (সবুজ)
জার্মানির সংস্কৃতি নীতি নিয়ে কাজ করবেন ক্লাউডিয়া ব়্যুথ৷ চ্যান্সেলরের দপ্তরে ডয়চে ভেলের দায়িত্বেও থাকবেন ৬৬ বছর বয়সি এই রাজনীতিবিদ৷ লেখক: বেন নাইট, লিসা হ্যানেল / এআই