লাদাখে ভারত-চীন সংঘাত ঘিরে চরম উত্তেজনা। তারই মধ্যে চীনের পণ্য বয়কট করার দাবি উঠেছে ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে। সূত্র জানিয়েছে, রেলে চীনা সংস্থার টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। টেলিকম বিভাগকে বলা হয়েছে চীনা কোম্পানির সাহায্য় না নিতে। এই পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই)। সংস্থার কোষাধ্যক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, চীনের স্পনসর ছাড়া আইপিএল হওয়া অসম্ভব।
করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছরের আইপিএল এখনও বিশ বাঁও জলে। কোনও কোনও মহলের ধারণা, এ বছরের শেষ দিকে ছোট করে হলেও আইপিএল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে, ফাঁকা মাঠে আইপিএল-এর ব্যবস্থা করা হবে কি না, তা নিয়েও নানা জল্পনা চলছে। সূত্র জানাচ্ছে, শুধু এ বছর নয়, আগামী বছরের আইপিএল নিয়েও ভাবনা চিন্তা শুরু করে দিয়েছে বিসিসিআই।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW আইপিএলের অন্যতম স্পনসর চীনের মোবাইল কোম্পানি ভিভো। ২০২২ সাল পর্যন্ত বিসিসিআই তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি বছর আইপিএল খাতে ভিভো বিসিসিআইকে ৪৪০ কোটি টাকা দেয়। বিসিসিআই কোষাধ্যক্ষ অরুণ ধুমালের বক্তব্য, ''চীনের পণ্য বয়কট করা একটি আবেগতাড়িত ভাবনা। ভাবনাটিকে আমি সম্মান করি। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ভাবতে হবে। যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ভিভোর সঙ্গে যে ভাবে আমরা চুক্তিবদ্ধ, তাতে এই মুহূর্তে তা বাতিল করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া চীনের কোম্পানি থেকে সাহায্য নিলে তা চীনের জন্য যতটা লাভের, তার চেয়ে ভারতের লাভ অনেক বেশি।'' ধুমালের যুক্তি, ভিভো ভারতে মোবাইল বিক্রির জন্য আইপিএলের বিজ্ঞাপনে টাকা ঢালছে। বিসিসিআই তার জন্য ভারত সরকারকে কর দিচ্ছে। যার থেকে ভারতের অর্থনীতিই লাভবান হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ওই মোবাইল কোম্পানি ভারতে মোবাইল বিক্রি করেও ভারত সরকারের কোষাগারে কর দিচ্ছে। ফলে শেষ পর্যন্ত ভারতই এর থেকে লাভবান হচ্ছে।
ভারত ও চীনের মধ্যে একবারই যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬২ সালে। কিন্তু তার আগে ও পরে অনেকবারই সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে এই দুই দেশ। সেই সংঘাতের কাহিনি দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত।
ছবি: Getty Images/Three Lions/Radloffচীন তিব্বতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো ১৯৫১ সালে। তার আট বছর পরে চতুর্দশ দলই লামা পালিয়ে ভারতে আসেন। ভারত তাঁকে আশ্রয় দেয়। চীন তার বিরোধিতা করে। তারপর শুরু হয় সীমান্তে দুই সেনার সংঘর্ষ।
ছবি: APসীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে প্রচুর। কিন্তু যুদ্ধ একবারই। ১৯৬২ সালে এক মাস এক দিনের লড়াইয়ে ভারতীয় ভূখন্ডে ঢুকে পড়ে চীন। অরুণাচল প্রদেশে ও লাদাখের ভিতরে। ভারত ছিলো অপ্রস্তুত। চীন সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো।
ছবি: Getty Imagesভারত ও চীনের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে। সহজভাবে বললে, যুদ্ধের পর দুই দেশের সেনা যেখানে অবস্থান করছে, সেটাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা।
ছবি: Getty Imagesপাঁচ বছরের মধ্যে অবস্থা বদলে গেলো। ১৯৬৭-র ১১ সেপ্টেম্বর চীনা সেনা নাথু লা-য় ভারতীয় পোস্ট আক্রমণ করে। পাঁচ দিন ধরে সংঘর্ষ চলে। এ বার ভারত ছিলো সুবিধাজনক অবস্থায়। তারা চীনা সেনাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। সংঘর্ষ হয় চো লা-তেও।
ছবি: Diptendu Dutta/AFP/Getty Imagesআবার উত্তেজনা ২০ বছর পরে, সামডরং উপত্যকায়। ভারত তখন অপারেশন চেকারবোর্ড চালাচ্ছিলো। কত তাড়াতাড়ি আসাম থেকে সীমান্তে সেনা পৌঁছনো যায় তা নিয়ে। সেখান থেকেই উত্তেজনা। দুই দেশের সেনা সামনাসামনি। তবে সংঘর্ষ হয়নি।
ছবি: picture-alliance/AP Photoএ বার বিরোধ ২০১৭-তে, ডোকলামে। ভারত, ভূটান ও চীনের সীমান্তে। চীনের সেনা একটা রাস্তা বানাতে থাকে। ভারতীয় সেনাও বুলডোজার নিয়ে চলে যায় তা থামাবার জন্য। সেই সংঘাত ৭৩ দিন চলে। অবশেষে কূটনৈতিক আলোচনার পর বিরোধ মেটে।
ছবি: APএ বার ২০২০-তে। আবার লাদাখ। প্রথমে দুই সেনার হাতাহাতি লড়াই। সিকিমেও একই ঘটনা ঘটলো। চীনের প্রেসিডেন্ট বললেন, তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তারপর ভারত ও চীন দুই পক্ষই সীমান্তে প্রচুর সেনা মোতায়েন করেছে। দুই দেশই প্রচুর কামান ও গোলাবারুদ নিয়ে গিয়েছে।
ছবি: Eesha Khenyচীন দাবি করে অরুণাচল প্রদেশ তাঁদের এলাকা। বিশেষ করে তাওয়াং শহর। অরুণাচলের লোকের চীনে যেতে ভিসা লাগবে না। ভারত জানায়, অরুণাচল তাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ছবি: picture-alliance/dpa/dinodiaভারতের দাবি, আকসাই চীন তাদের এলাকা। চীন জবরদখল করে রেখেছে। ১৯৬২ থেকেই এ নিয়ে বিরোধ চলছে। এখানে কোনও মানুষের বসতি নেই। কিন্তু সামরিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
ভারত ও চীনের সম্পর্ককে বলা হয় ব্লো হট, ব্লো কোল্ড রিলেশন বা নরমে-গরমের সম্পর্ক। মাঝে মাঝেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর উত্তেজনা হয়। আবার শান্তি আসে। দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর। দুই দেশের সেনা শক্তিশালী। তাই তা আর যুদ্ধের দিকে যায় না।
ছবি: Reuters/Handout বস্তুত, টেলিকম সেক্টরে ভারতের বাজারের বড় অংশ এখন চীনের দখলে। রাতারাতি চীনের পণ্য বয়কট করা হলে টেলিকম সেক্টর বিপুল ক্ষতির মুখোমুখি হবে। ফলে মুখে যে যাই বলুক, সার্বিক ভাবে চীনের পণ্য বয়কট করা অসম্ভব বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমান মুক্ত অর্থনীতির বাজারে এ ভাবে কোনও দেশকে বয়কট করাও যায় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকার সরাসরি বয়কটের ডাক দিচ্ছে না। কারণ তারা জানে, এটা সম্ভব নয়। কিন্তু, মানুষের ভাবাবেগকেও শাসক দল ব্যবহার করতে চায়। এই মুহূর্তে দেশের ভিতর চীন বিরোধী ভাবাবেগ খুবই শক্তিশালী। তাই বিভিন্ন মন্ত্রী এবং দলীয় কর্মীরা ব্যক্তিগত ভাবে চীনা জিনিস বয়কটের ডাক দিচ্ছেন। সরকারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, তারা বলছে, সরকারি ভাবে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এতে সাপও মরছে, আবার লাঠিও ভাঙছে না।
ধুমালও একই কথা ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, যতদিন পর্যন্ত ভিভো ভারতে ব্যবসা করতে পারবে, সরকার তাদের কোনও বাধা দেবে না, তত দিন পর্যন্ত তাদের বিজ্ঞাপন নেওয়াতেও কোনও সমস্যা থাকতে পারে না। উল্লেখ্য, এর আগে আরেকটি চীনা মোবাইল সংস্থা ওপো ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সির স্পনসর ছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে সেই চুক্তি শেষ হয়েছে। এখন ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি স্পনসর দক্ষিণ ভারতের একটি শিক্ষা সংস্থা।
এসজি/জিএইচ (পিটিআই)