জার্মানি তথা ইউরোপে চীন সম্পর্কে সংশয় বেড়ে চললেও খোদ জার্মান চ্যান্সেলরের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে৷ শলৎসের চীন সফরের আগে জার্মানির শাসক জোট ও শিল্পবাণিজ্য মহলে কড়া পদক্ষেপের ডাক শোনা যাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
রাশিয়ার উপর লাগামহীন নির্ভরতার পরিণাম কী হতে পারে, ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে জার্মানি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷ বিশেষ করে সে দেশ থেকে গ্যাসসহ জ্বালানি আমদানি কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জার্মানিকে মরিয়া হয়ে দ্রুত বিকল্পের সন্ধান করতে হচ্ছে৷ সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে চীনের মতো একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জার্মানির রাজনৈতিক ও শিল্পবাণিজ্য মহলে চরম সতর্কতার মনোভাব দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু বার্লিনের ক্ষমতাসীন জোট সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে এমন বোধোদয় ঘটলেও খোদ জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে৷
চ্যান্সেলর শলৎস বর্তমান পরিস্থিতি ও যাবতীয় সংশয় সত্ত্বেও চীনের প্রতি অত্যন্ত নরম মনোভাব দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে৷ প্রথমে নিজের শহর হামবুর্গে একটি বন্দর প্রকল্পে চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি ‘কসকো'-র অংশগ্রহণ নিয়ে মন্ত্রিসভার জোরালো বিরোধিতা উপেক্ষা করে তিনি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা সেই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন৷ অংশীদারিত্বের মাত্রা কমানোর বদলে তিনি সেই কোম্পানিকে পুরোপুরি প্রকল্প থেকে বাইরে রাখার পক্ষে সওয়াল করেন৷
এবার চ্যান্সেলর হিসেবে শলৎস প্রথমবার চীন সফরে যাবার আগেও তার ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীনের প্রতি জার্মানি তথা ইইউ-র নীতি কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কোনো ঐকমত্য স্থির করার আগেই শুক্রবার বেইজিং-য়ে যাচ্ছেন শলৎস৷ এই প্রশ্নে নিজের সরকার ও ব্রাসেলসের সঙ্গে সমন্বয়ের তেমন কোনো উদ্যোগেরও লক্ষণ দেখছেন না সমালোচকরা৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দুজনেরই বেইজিং সফর পরিকল্পনার কোনো তাগিদও শলৎসের মধ্যে দেখছেন না তাঁরা৷
এমন প্রেক্ষাপটে জার্মানিতে চীনের ভূমিকা খর্ব করার নানা বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে৷ জার্মান অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে আইনি পদক্ষেপের ঘোষণা করেছেন৷ তাঁর মতে, বেইজিং জার্মানিতেও নির্ভরতা সৃষ্টি ও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে৷ সরকারের আর এক শরিক সবুজ দলের সভাপতি ওমিদ নুরিপুর বলেন, দেশের জরুরি অবকাঠামো রক্ষায় বর্তমান আইনে অসংখ্য ফাঁকফোকর রয়েছে৷ তিনি অবিলম্বে আইন করে সেই দুর্বলতা দূর করার ডাক দিয়েছেন৷ এমনকি শলৎসের নিজের দল এসপিডি-র সহ সভাপতি লার্স ক্লিংবাইল বলেন, জার্মানি তথা ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য প্রাসঙ্গিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে চীনকে দূরে রাখা উচিত৷ তার মতে, ইউরোপে ডিজিটালাইজেশন, জরুরি অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য সংরক্ষণ ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো ক্ষেত্রে চীনের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না৷ তাছাড়া চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কেও এসপিডি দলের স্পষ্ট অবস্থান থাকা উচিত৷
জার্মানির শিল্পজগতের কেন্দ্রীয় সংগঠন শলৎসের উদ্দেশ্যে চীনের উপর জার্মানির একতরফা নির্ভরতা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে৷ বিশেষ করে খনিজ পদার্থের ক্ষেত্রে নির্ভরতা কমাতে দুর্দিনের জন্য এমন খনিজের ভাণ্ডার রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই বলে সংগঠনের প্রধান মনে করিয়ে দিয়েছেন৷ জার্মানির শিল্প ও বাণিজ্য চেম্বারও দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ন্যায্য ভারসাম্যের ডাক দিয়েছে৷ বিশেষ করে চীনের আমলাতন্ত্রের দীর্ঘ বাধার কারণে জার্মান কোম্পানিগুলি সে দেশে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না বলে সংঘের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে৷
এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স)
জার্মানি : ধনী দেশের গরিবেরা যেমন
করোনা মহামারির সময় ধনী আর গরিবের ব্যবধান বাড়তে না দেয়ার উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও জার্মানিতে এ ব্যবধান বেড়েছে৷ এ দেশের মানদণ্ডে গরিবদের আরো গরিব হওয়ার নমুনা দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Markus C. Hurek/dpa/picture alliance
ধনী দেশে পথের পাশে দরিদ্র মানুষ
বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ জার্মানি৷ এ দেশেও আছে গৃহহীন মানুষ৷ করোনা মহামারির সময় গৃহহীনের সংখ্যা বেড়েছে৷
ছবি: Rupert Oberhäuser/picture alliance
ব্যয় কমিয়ে বাঁচার চেষ্টা
করোনার পর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় জ্বালানি এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে৷ সন্তানের মুখে আহার তুলে দিতে জার্মানির অনেক মা এখন নিজে একবেলা না খেয়ে থাকেন বা খেলেও কম খান৷ অবসর ভাতায় চলতে পারেন না বলে অনেক প্রবীণ বোতল কুড়ান৷ তা বিক্রি করে সামান্য কিছু অর্থ আসে, তাতেই তারা খুশি!
ছবি: Rupert Oberhäuser/picture alliance
দারিদ্র্য বাড়ছে জার্মানিতে
জার্মানিতে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে- এ শুধু বিশ্লেষকদের অনুমান নয়, পারিট্যাটিশে ভলফারট্সফারবান্ড নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও বলছে এ কথা৷ তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এ মুহূর্তে জার্মানির এক কোটি ৩৮ লাখের মতো মানুষ হয় দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করছেন, নয়তো দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন৷
ছবি: imago images/epd
২০তম ধনী দেশ জার্মানি
২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপির হিসেবে বিশ্বের ২০ তম ধনী দেশ হয়েছিল জার্মানি৷সে বছর জার্মানির মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি ছিল ৫২ হাজার ২০০ ইউরো (৫০ হাজার ৭০০ ডলার)৷ এক লাখ ৩৬ হাজার ৭০০ ইউরো মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি নিয়ে সবচেয়ে ধনী দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল লুক্সেমবুর্গ৷ সবচেয়ে কম মাত্র ২৭০ ইউরো বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি ছিল বুরুন্ডির৷ সে কারণে ২০২১ সালে আফ্রিকার এই দেশটিই ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম৷
ছবি: Markus C. Hurek/dpa/picture alliance
জার্মানিতে দরিদ্র কারা
কোনো ব্যক্তির মাসিক আয় এক হাজার ১৪৮ ইউরোর চেয়ে কম হলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নীচে আছেন বলে ধরে নেয়া হয়৷তবে এক সন্তান আছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে মাসিক আয় কমপক্ষে এক হাজার ৪৯২ ইউরো হতে হয়, না হলে তাকেও দারিদ্র্যসীমাধীন বলে ধরে নেয়া হয়৷ দুই সন্তানের বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে আয়সীমাটা দু হাজার ৪১০ ইউরো, অর্থাৎ আয় তার চেয়ে কম হলে জার্মানির মানদণ্ডে তারাও দারিদ্র্যসীমার নীচে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Skolimowska
দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট মানুষ
জার্মানিতে কেউ চাকরি না পেলে বা কাজ করতে না পারলে সরকার তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয়৷ সেই প্রণোদনার অংশ হিসেবে ৪৪৯ ইউরো দেয়া হয় সারা মাসের খাদ্য, বস্ত্র, গৃহস্থালী নানা পণ্য কেনা এবং ঘরের যাবতীয় বিল পরিশোধের জন্য৷এছাড়া প্রতিটি শিশুর জন্য দেয়া হয় (বয়সভেদে) ২৮৫ থেকে ৩৭৬ ইউরো৷ কিন্তু দ্রব্যমূল্য এত বেড়েছে যে, ওলাফ শলৎস সরকার এ ভাতা ৪৪৯ থেকে বাড়িয়ে ৫০৩ ইউরো করার কথা ভাবছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Steinberg
অপ্রতুল সরকারি উদ্যোগ
সমাজ বিজ্ঞানী এবং দারিদ্র্য গবেষক ক্রিস্টোফ বুটারভেগে মনে করেন, মাসিক সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা কমপক্ষে ৬৫০ ইউরো না করলে দুর্মূল্যের এ বাজারে অনেক মানুষের জন্য তিনবেলা পর্যাপ্ত খাওয়া কঠিন হবে৷প্রসঙ্গত, জার্মানিতে রুটি, দুধ, ফল এবং শাকসবজির দাম ২০২০ সালের তুলনায় এ বছর শতকরা ১২ ভাগেরও বেশি বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/imageBROKER
বার্ধক্যে দারিদ্র্যের জ্বালা
বের্টেলসমান ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জার্মানিতে প্রবীণদের মধ্যেও দারিদ্র্য বাড়ছে৷ কয়েক দশক কাজ করে যারা মাসিক অবসর ভাতায় আয়েশে জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের কেউ কেউ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে খণ্ডকালীন কাজে যোগ দিচ্ছেন৷ কাজ করেও নারীরা কুলাতে পারছেন না৷ পুরুষদের চেয়ে পারিশ্রমিক কম বলে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হচ্ছে তাদের৷
ফুলটাইম জব, অর্থাৎ দিনে আট ঘণ্টা কাজ করেও সেই আয়ে সংসার চালাতে পারছেন না- এমন মানুষের সংখ্যাও জার্মানিতে বাড়ছে৷এতদিন সন্তানহীন কোনো মানুষ ঘণ্টায় ১২ ইউরো হিসেবে দিনে আট ঘণ্টা করে সপ্তাহে মোট ৪০ ঘণ্টা কাজ করতেন৷ বিনিময়ে প্রতি মাসে পেতেন এক হাজার ৪৮০ ইউরোর মতো৷ দিব্যি চলে যেতো তাতে৷এখন তাতে চলছে না বলে অনেকেই আরেকটা খণ্ডকালীন কাজ করছেন৷