আমদানির ক্ষেত্রে চীনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে চীনও পালটা পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত৷ আপাতত রেহাই পেলো ইইউ৷
বিজ্ঞাপন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণার পর বাণিজ্য যুদ্ধ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছে চীন৷ অ্যামেরিকার ৬,০০০ কোটি ডলার মূল্যের শুল্কের জবাব হিসেবে চীনও সে দেশের বিরুদ্ধে ৩,০০০ কোটি ডলার মূল্যের পালটা পদক্ষেপ প্রস্তুত করেছে৷ শুকরের মাংস, ইস্পাতের পাইপ ও ওয়াইনসহ মোট ১২০টি পণ্য আমদানির উপর এই শুল্ক চাপাতে প্রস্তুত চীন৷ তবে এখনো শেষরক্ষা সম্ভব হতে পারে৷ দুই পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে নিতে পারে৷ ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত অবশ্য শুক্রবারই কার্যকর হতে চলেছে৷
অ্যামেরিকা ও চীনের মধ্যে সত্যি বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে তার পরিণাম কী হতে পারে, তার পূর্বাভাষ পাওয়া গেল পুঁজিবাজারে৷ বাজারের আশঙ্কা, একবার এমন যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য, যার ফলে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ ওয়াশিংটনের চাপের মুখে বেইজিং নতি স্বীকার করবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ট্রাম্প এখনো নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবিচল রয়েছেন৷ মার্কিন মেধাসত্ত্ব লঙ্ঘনের দায়ে তিনি চীনকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর৷ চীনের বিরুদ্ধে জোর করে প্রযুক্তি হস্তান্তরের অভিযোগও রয়েছে৷ বৃহস্পতিবার তিনি এই মর্মে এক নির্বাহী আদেশ স্বাক্ষর করেছেন৷ তবে এখনই সেই আদেশ কার্যকর হচ্ছে না৷ চীনা পণ্যের তালিকা প্রস্তুত হবার পর ৩০ দিনের আলোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে৷ ট্রাম্প এখনো চীনকে ‘বন্ধু' হিসেবেই গণ্য করছেন৷ এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প জানিয়েছেন, যে তিনি তাঁর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালন করছেন মাত্র৷
বাণিজ্য যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে বলে চীন আশা প্রকাশ করেছে৷ তবে সে দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চীন মোটেই ভয় পায় না৷ প্রাথমিকভাবে ৩,০০০ কোটি ডলার মূল্যের শুল্কের ঘোষণা করলেও ট্রাম্প অবিচল থাকলে চীন অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে আরও বড় আকারের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবার ইঙ্গিত দিয়েছে৷
শুধু চীন নয়, বিশ্বের বাকি দেশগুলিও ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত আপাতত ক্যানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর কার্যকর হচ্ছে না৷ জাপানের নামও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে৷ তবে সাময়িকভাবে রেহাই পেলেও দুশ্চিন্তা কাটছে না৷
এমন প্রেক্ষাপটে ইইউ নেতারাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন৷ ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, ইইউ নেতারা ট্রাম্পের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছেন৷ তাঁর মতে, বাড়তি শুল্ক মোটেই ন্যায্য পদক্ষেপ নয়৷ এমন পরিস্থিতি দেখা দিলে ইইউ-কেও পালটা পদক্ষেপ নিতে হবে৷ ইইউ বাণিজ্য কমিশনর সম্প্রতি ওয়াশিংটন থেকে ফিরে জানিয়েছেন, সংকট এড়াতে ট্রাম্প প্রশাসন আলোচনা করতে আগ্রহী৷
বাণিজ্য যুদ্ধ হলে কী ক্ষতি হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ নীতি রূপায়ন করতে আমদানির পথে বাধা সৃষ্টি করছেন৷ সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তারই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
বাণিজ্য যুদ্ধের অর্থ কী?
কোনো দেশ কোনো এক বা একাধিক পণ্য আমদানির উপর কর, শুল্ক বা অন্য কোনো আর্থিক বোঝা চাপালে বাকি দেশগুলিও পালটা পদক্ষেপ নিতে পারে৷ বিশেষ করে অ্যামেরিকা ও চীনের মতো বিশাল দেশের সংঘাতের জের ধরে গোটা বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্য যুদ্ধের আকার নিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণে আনা মোটেই সহজ হবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Peter
অতীত দৃষ্টান্ত
১৯৩০-এর দশকে শেষ বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা বিশাল মন্দা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার সে বছর শুল্ক সংক্রান্ত নতুন আইন কার্যকর করার ফলে ২০ হাজারেরও বেশি পণ্যের উপর শুল্ক চাপানো হয়েছিল৷ ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে যে, এ ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ও দেশের জন্য শুল্ক চাপানো হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
ট্রাম্প কেন বাণিজ্য যুদ্ধের পথে এগোচ্ছেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রতিকূল বাণিজ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তোপ দেগে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তবে সমালোচকদের মতে, এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তিনি অ্যামেরিকার সার্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছেন না৷ কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কাঠামো তোলপাড় হয়ে গেলে আখেরে অ্যামেরিকারই ক্ষতি হবে৷ ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাবে, রপ্তানি কমে যাবে এবং প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
ছবি: picture-alliance/K. Ohlenschläger
পালটা পদক্ষেপ
ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলে বাকি দেশগুলিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না৷ ক্যানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যামেরিকার বিরুদ্ধেও পালটা পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এমন বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার চেয়ে বহুপাক্ষিক সমাধানসূত্রের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
অ্যামেরিকার ক্ষতি
সব সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ট্রাম্প যদি সত্যি আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপান, তার পরিণতি অ্যামেরিকার জন্যও ইতিবাচক হবে না৷ যেমন, ইস্পাত আমদানির উপর শুল্ক চাপালে অ্যামেরিকার বাজারেও তার মূল্য বেড়ে যাবে৷ তার ফলে মার্কিন ইস্পাত কোম্পানিগুলির লাভ হলেও ক্রেতাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হবে৷ যে কোম্পানিগুলি ইস্পাত ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Weihrauch
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অ্যামেরিকায় ইস্পাত রপ্তানি করতে না পারলে চীন ইউরোপের বাজারে তা আরও সস্তায় বিক্রি করার চেষ্টা করতে পারে৷ স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে এমন আরও দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে৷ সামগ্রিকভাবে এমন অস্বাভাবিক প্রবণতা নানাভাবে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ সাম্প্রতিক নানা সংকট কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন সবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তখন নতুন করে এমন বিপদ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/XinHua
আইনি লড়াই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন ডাব্লিইউটিও সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব বাণিজ্যের বিধিনিয়ম স্থির করে এসেছে এবং বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছে৷ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে৷ সব পক্ষ ডাব্লিইউটিও-র রায় না মানলে এই সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে৷ এমন কাঠামো তার কার্যকারিতা হারালে ভবিষ্যতে সেই ক্ষতি পূরণ করা সহজ হবে না৷