চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠছে৷ একের পর এক পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে দুই দেশ৷ ট্রাম্প প্রশাসন সেইসঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থারও দ্বারস্থ হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না ট্রাম্প৷ অ্যামেরিকা থেকে আমদানির উপর চীন বাড়তি শুল্ক চাপানোর পর মঙ্গলবারই সে দেশের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দফার শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ঘোষণা করলো মার্কিন প্রশাসন৷ এ যাত্রায় তালিকায় প্রায় ৫,০০০ কোটি ডলার মূল্যের ১,৩০০ পণ্য ও পরিষেবা রয়েছে, যেমন শিল্পক্ষেত্রে কিছু প্রযুক্তি, পরিবহণ ও চিকিৎসার পণ্য৷ ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপালে এ সবের আমদানির মূল্য এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যাবে৷ মেধাসত্ত্ব নিয়ে চীনের আচরণ বদলাতে বাধ্য করতেই ওয়াশিংটন এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে৷
এই পদক্ষেপ কার্যকর হলে শুধু চীন নয়, অ্যামেরিকার শিল্পজগতেরও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ কারণ অ্যামেরিকায় বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ সব কাচামাল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়৷ অনেক মার্কিন কোম্পানি মেধাসত্ত্ব নিয়ে চীনের আচরণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন করলেও তারা চীনা পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক চাপানোর বিরোধী৷ কারণ সেক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সাধারণ ক্রেতাদেরই ক্ষতি হবে৷
বলা বাহুল্য, চীন অ্যামেরিকার এই সর্বশেষ পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করে অবিলম্বে পালটা পদক্ষেপের ঘোষণা করেছে৷ চীনের মতে, অ্যামেরিকার একতরফা পদক্ষেপগুলির ফলে চীনা ও মার্কিন স্বার্থ এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে৷ পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত না জানালেও বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যামেরিকা থেকে সয়াবিন, বিমান ও যন্ত্রপাতি আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপাতে পারে বেইজিং৷
ট্রাম্প প্রশাসন ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতি কার্যকর করতে এতকাল দ্বিপাক্ষিক স্তরেই পদক্ষেপ নিয়ে এসেছে৷ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডাব্লিউটিও-র বিধিনিয়মের পরোয়া না করেই ওয়াশিংটন একতরফা শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ঘোষণা করে এসেছে৷ এবার চীনকে শায়েস্তা করতে সেই ডাব্লিউটিও-রই দ্বারস্থ হয়েছে অ্যামেরিকা৷ চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন মেধাসত্ত্ব চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ তাতে বলা হয়েছে, ডাব্লিউটিও-র নিয়ম ভেঙে চীন অ্যামেরিকাসহ বিদেশি সংস্থাগুলির মৌলিক পেটেন্ট বা সত্ত্বের অধিকার অস্বীকার করছে৷ ফলে লাইসেন্স চুক্তি শেষ হলে চীনা কোম্পানিগুলি অবাধে সেই সত্ত্ব অমান্য করে৷ তাছাড়া বিদেশি প্রযুক্তি আমদানির ক্ষেত্রেও চীনের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ এনেছে অ্যামেরিকা৷
চীন ও অ্যামেরিকার এই বেড়ে চলা সংঘাতের ফলে বিশ্বের পুঁজিবাজারেও অস্থিরতার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে৷ ডাব্লিইউটিও-র কাঠামোর বাইরে এমন বাণিজ্য যুদ্ধের পরিণাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে৷
বাণিজ্য যুদ্ধ হলে কী ক্ষতি হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ নীতি রূপায়ন করতে আমদানির পথে বাধা সৃষ্টি করছেন৷ সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তারই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
বাণিজ্য যুদ্ধের অর্থ কী?
কোনো দেশ কোনো এক বা একাধিক পণ্য আমদানির উপর কর, শুল্ক বা অন্য কোনো আর্থিক বোঝা চাপালে বাকি দেশগুলিও পালটা পদক্ষেপ নিতে পারে৷ বিশেষ করে অ্যামেরিকা ও চীনের মতো বিশাল দেশের সংঘাতের জের ধরে গোটা বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্য যুদ্ধের আকার নিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণে আনা মোটেই সহজ হবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Peter
অতীত দৃষ্টান্ত
১৯৩০-এর দশকে শেষ বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা বিশাল মন্দা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার সে বছর শুল্ক সংক্রান্ত নতুন আইন কার্যকর করার ফলে ২০ হাজারেরও বেশি পণ্যের উপর শুল্ক চাপানো হয়েছিল৷ ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে যে, এ ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ও দেশের জন্য শুল্ক চাপানো হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
ট্রাম্প কেন বাণিজ্য যুদ্ধের পথে এগোচ্ছেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রতিকূল বাণিজ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তোপ দেগে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তবে সমালোচকদের মতে, এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তিনি অ্যামেরিকার সার্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছেন না৷ কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কাঠামো তোলপাড় হয়ে গেলে আখেরে অ্যামেরিকারই ক্ষতি হবে৷ ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাবে, রপ্তানি কমে যাবে এবং প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
ছবি: picture-alliance/K. Ohlenschläger
পালটা পদক্ষেপ
ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলে বাকি দেশগুলিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না৷ ক্যানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যামেরিকার বিরুদ্ধেও পালটা পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এমন বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার চেয়ে বহুপাক্ষিক সমাধানসূত্রের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
অ্যামেরিকার ক্ষতি
সব সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ট্রাম্প যদি সত্যি আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপান, তার পরিণতি অ্যামেরিকার জন্যও ইতিবাচক হবে না৷ যেমন, ইস্পাত আমদানির উপর শুল্ক চাপালে অ্যামেরিকার বাজারেও তার মূল্য বেড়ে যাবে৷ তার ফলে মার্কিন ইস্পাত কোম্পানিগুলির লাভ হলেও ক্রেতাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হবে৷ যে কোম্পানিগুলি ইস্পাত ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Weihrauch
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অ্যামেরিকায় ইস্পাত রপ্তানি করতে না পারলে চীন ইউরোপের বাজারে তা আরও সস্তায় বিক্রি করার চেষ্টা করতে পারে৷ স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে এমন আরও দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে৷ সামগ্রিকভাবে এমন অস্বাভাবিক প্রবণতা নানাভাবে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ সাম্প্রতিক নানা সংকট কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন সবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তখন নতুন করে এমন বিপদ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/XinHua
আইনি লড়াই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন ডাব্লিইউটিও সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব বাণিজ্যের বিধিনিয়ম স্থির করে এসেছে এবং বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছে৷ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে৷ সব পক্ষ ডাব্লিইউটিও-র রায় না মানলে এই সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে৷ এমন কাঠামো তার কার্যকারিতা হারালে ভবিষ্যতে সেই ক্ষতি পূরণ করা সহজ হবে না৷