দুনিয়া জুড়ে আবর্জনা রপ্তানি ও রিসাইক্লিং-এর ব্যবসা চলেছে, যেমন চীনে৷ চীনে গোটা পরিবারবর্গ ঐ আবর্জনার মধ্যেই থাকেন, কেননা সেটাই তাঁদের জীবিকা৷ বিষয়টি নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ওয়াং জিউলিয়াং৷
বিজ্ঞাপন
ভারত-বাংলাদেশে যা, চীনেও তাই: আবর্জনা আর প্লাস্টিকের স্তূপের উপর ‘শিশুরা করে খেলা’৷ আবর্জনা বেছে দিন গুজরান করেন এই মানুষেরা৷ ‘প্লাস্টিক চীন’ নামের একটি তথ্যচিত্র থেকে তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে৷
তথ্যচিত্র নির্মাতা ওয়াং জিউলিয়াং চার বছর ধরে চীনের ছোট ছোট ‘ল্যান্ডফিল’ – অর্থাৎ আবর্জনা ফেলার জায়গায় ক্যামেরা নিয়ে ঘোরেন এবং যা দেখেন, তা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়৷
নিজের মেয়ের যদি এ অবস্থা হত
ওয়াং বললেন, ‘‘আমার নিজের একটি মেয়ে আছে৷ সে যে এ ধরনের পরিবেশে মানুষ হচ্ছে, তা আমি সহ্য করতে পারতাম না৷ কিন্তু এই সব বাচ্চাদের মধ্যে কয়েকজন আজন্ম এই আবর্জনার মধ্যে রয়েছে৷ বাচ্চাদের যে এই আবর্জনার মধ্যে বাঁচতে হচ্ছে, তা আমি চাই না৷’’
কিন্তু রিসাইক্লিং ব্যবসার অন্ধকার দিকটা হল তাই; যারা আবর্জনা বাছে, তাদের নানা ধরনের ঝুঁকি: বিষাক্ত গ্যাস বা অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়৷ ওয়াং যে সব বাচ্চাদের দেখেন, তাদের কয়েকজন ইস্কুল-পাঠশালার দুয়ার পর্যন্ত মাড়ায় না৷
যা রিসাইক্লিং করা যায় না, তা প্রায়ই মাঠেঘাটে গিয়ে পড়ে, ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করে৷ জীবজন্তুরা অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ কোথাও কোথাও আবর্জনার স্তূপে আগুন লেগে জ্বলতে থাকে৷ দুর্গন্ধে এখানে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না, মানুষ অসহায় বোধ করে: বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ৷ একমাত্র ভালো দিকটা হল রোজগার৷
ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নজর দিচ্ছে চীন
বিশ্বের আবর্জনা ফেলার স্তূপ হতে চায় না চীন৷ তাই বিদেশ থেকে বর্জ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে৷ পাশাপাশি স্থানীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Aly Song
বিশ্বের সবচেয়ে বড়
চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় গুইয়ু শহর একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইলেক্ট্রনিক পণ্য রিসাইক্লিংয়ের জায়গা ছিল৷ পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার-পরিচালিত কোম্পানি মনিটর থেকে শুরু করে মাদারবোর্ড– সবকিছুই রিসাইকেল করতো৷
ছবি: Reuters/Aly Song
খালি হাতে
এসব কোম্পানিতে নিয়োজিত গরিব শ্রমিকরা খালি হাতে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি খুলতো, বাছাই করতো আর তারপর প্রক্রিয়াজাত করতো৷ অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যবস্থা খুব কমই ছিল৷
ছবি: Reuters/Aly Song
খাবার পানির অভাব
ইলেক্ট্রনিক পণ্য থেকে মূল্যবান ধাতু পৃথক করতে বিভিন্ন অংশ পোড়ানো হতো৷ এ কাজে ব্যবহার করা হতো বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান৷ এসব কারণে গুইয়ু শহরের বাতাস আর ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়ে উঠেছিল৷ ফলে সেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছিল৷
ছবি: Reuters/Aly Song
আধুনিক ব্যবস্থা
পরিবেশ বাঁচাতে ২০১৩ সালে রাজ্য সরকার শহরের পাশে একটি শিল্প পার্ক গড়ে তোলে৷ সেখানে বাতাস ও পানি পরিশোধনের আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়৷
ছবি: Reuters/Aly Song
লাভ কম
গুইয়ু শহরের ব্যবসায়ীদের ঐ পার্কে একটি জায়গা ভাড়া নিতে বাধ্য করা হয়৷ এতে ব্যবসায়ীদের লাভের পরিমাণ কমে যায় ঠিকই, কিন্তু শহরের বাতাস নাটকীয়ভাবে বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে৷ রাস্তাঘাটও আগের চেয়ে পরিষ্কার হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Aly Song
বিদেশি বর্জ্য আমদানি বন্ধ
চলতি বছর চীন দেশের বাইরে থেকে ২৪ ধরণের ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে৷ ফলে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো বর্জ্য আর চীনে ঢুকতে পারছে না, অন্তত বৈধ উপায়ে নয়৷
ছবি: Reuters/Aly Song
অবৈধ পথ
স্থানীয় ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যের চেয়ে দেশের বাইরের বর্জ্যের প্রতি বেশি ঝোঁক ব্যবসায়ীদের৷ কারণ, সেগুলো নাকি ভালো অবস্থায় থাকে৷ ফলে সেগুলো রিসাইকেল করা বেশি লাভজনক৷ তাই তো এখনও বিদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে বর্জ্য আমদানির প্রতি অনেক ব্যবসায়ীর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Aly Song
নতুন উদ্যোগ
চীনারা যেন এখন থেকে সঠিক উপায়ে ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য সংরক্ষণ শুরু করেন সেজন্য বিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প শুরুর পরিকল্পনা করেছে চীন৷ সেটি বাস্তবায়িত হলে ব্যবসায়ীরা স্থানীয় বর্জ্য রিসাইক্লিং থেকেও লাভবান হতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Aly Song
8 ছবি1 | 8
আবর্জনা আসে কোথা থেকে?
ছবি তুলতে গিয়ে ওয়াং আরেকটি মহাসত্য আবিষ্কার করেন: এই প্লাস্টিক আবর্জনার একটি বড় অংশ আসে বিদেশ থেকে৷
ওয়াং শোনালেন, ‘‘একদিন আমি হেবেই প্রদেশে একটি ময়লা ফেলার জায়গা দেখতে গিয়েছিলাম – সুবিশাল একটি ‘ল্যান্ডফিল’, চতুর্দিকে আবর্জনা৷ তারপর দেখলাম বহু প্যাকেট বা বোতলের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের ছাপ৷ তখন বুঝলাম যে, সারা দুনিয়ার আবর্জনা আমার সামনে পড়ে রয়েছে৷’’
চীন এযাবৎ বিশ্বের অর্ধেক আবর্জনা কিনে নিয়েছে৷ ওয়াং অ্যামেরিকাতেও ছবি তুলেছেন৷ চীনে মার্কিন রপ্তানির তালিকায় আবর্জনা রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে৷ শুধুমাত্র জার্মানি থেকেই প্রতি বছর এক লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক আবর্জনা চীনে পাঠানো হয়৷
কিন্তু এ বছরের শুরু থেকে চীন তথাকথিত বিদেশি আবর্জনা কেনা বন্ধ করেছে – সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার কল্যাণে৷
বিশিষ্ট পরিবেশ আন্দোলনকারী মা জুন-এর মতে, ‘‘রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে চীনে দূষিত আবর্জনার পরিমাণ হ্রাস পাবে – যা পরিবেশের পক্ষে শুভ৷ অপরদিকে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে কাগজ বা প্লাস্টিকের মতো কাঁচামালের অভাব দেখা দিতে পারে৷’’
ইতিমধ্যে চীন নিজেই বড় বেশি আবর্জনা সৃষ্টি করছে – এছাড়া দেশে পরিবেশ সচেতনতাও বাড়ছে, সর্বত্র অত্যাধুনিক রিসাইক্লিং ও ময়লা পোড়ানোর ‘ইনসিনারেটর' তৈরি হচ্ছে৷ অপরদিকে যে ২৪ ধরনের আবর্জনা আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তার ফলে বহু দেশ এখন তাদের আবর্জনা নিয়ে বিপদে পড়েছে৷
মা জুন বললেন, ‘‘জার্মানি, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভেবে দেখতে হবে, বিশ্বের বাজারের উপর নির্ভর করে আবর্জনা শুধু রপ্তানি না করে কীভাবে নিজে থেকে এই আবর্জনা সমস্যার সমাধান করা যায়৷’’
চীনে ইন্টারনেটের ওপর কড়া সরকারি নিয়ন্ত্রণের দরুন ওয়াং জিউলিয়াং তাঁর তথ্যচিত্রে এর বেশি দেখাতে পারেননি৷ তবুও তাঁর তোলা ছবি চীনে মানসিকতা পরিবর্তনে অবদান রেখেছে বলে তাঁর বিশ্বাস – অন্তত মানুষজন বুঝতে পেরেছেন যে, এভাবে চলতে পারে না৷
মারিও স্মিট/এসি
প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব
গত ১ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে৷ প্লাস্টিক বিক্রি, ব্যবহার এবং তৈরির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে৷ আগামী বছর আরও দেশ এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবে বলেই বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
প্লাস্টিকহীন সুপারমার্কেট
২০১৮ সালের গোড়াতেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে জানিয়েছেন, ২০৪২ সালের মধ্যে ব্রিটেনকে সম্পূর্ণ প্লাস্টিকমুক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য৷ একটি স্লোগানও দিয়েছেন তিনি, ‘‘ক্লিনার, গ্রিনার ব্রিটেন৷’’ সুপারমার্কেটগুলির কাছে তাঁর আবেদন, ‘‘প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করুন৷’’
ছবি: picture-alliance/Photoshot
প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশ কমছে৷ লুক্সেমবুর্গ, ডেনমার্কের মতো বহু দেশ প্লাস্টিক ব্যাগের উপর বিপুল পরিমাণ কর বসিয়েছে৷ জার্মানির সুপারমার্কেটগুলি প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে বার বার ব্যবহার করা যায় এমন অন্য ব্যাগের ব্যবহার চালু করেছে৷
ছবি: Getty Images
কেনিয়ার অবদান
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সুদূরপ্রসারী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেনিয়া৷ দেশের কোথাও প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন করা যাবে না৷ ব্যবহারও করা যাবে না৷ পরিসংখ্যান বলছে, মাসে কেনিয়ায় প্রায় ২৪ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হতো৷ সরকার জানিয়েছে, কেউ নতুন নিয়ম না মানলে তার চার বছর পর্যন্ত জেল এবং ৩৮হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে৷
ছবি: Reuters/T. Mukoya
জিম্বাবোয়ের পদক্ষেপ
জিম্বাবোয়েও তাদের প্যাকেজিং নীতি বদলে দিচ্ছে৷ প্লাস্টিকের তৈরি স্টাইরোফোম বাক্স বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ সাধারণত, যে ধরনের বাক্সে খাবার প্যাক করে দেওয়া হয়৷ কাগজের তৈরি নতুন বাক্স তৈরি করার চেষ্টা করছে তারা৷ বিভিন্ন ফাস্টফুড সেন্টারে প্যাক করে খাবার না দিয়ে ক্রেতাদের রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়াদাওয়া করতে উৎসাহ দেওয়া আহ্বান জানানো হয়েছে৷
ছবি: Environment Management Agency of Zimbabwe
প্লাস্টিকের ইয়ারবাড নয়
স্কটিশ সরকার জানিয়েছে, প্লাস্টিকের তৈরি ইয়ারবাড বা কানখোঁচানি আর সে দেশে ব্যবহার করা যাবে না৷ সাধারণত এগুলি ব্যবহার করে কমোডে ফেলে দেওয়াই অভ্যাস স্কটিশদের৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমোড থেকে পিটে গিয়ে সেই বাডগুলি চলে যাচ্ছে সমুদ্রে৷ সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত৷ বায়োডিগ্রেডেবল বাড অবশ্য ব্যবহার করা যাবে৷