ইসলামকে চীনের সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে নতুন আইন করতে যাচ্ছে দেশটির প্রশাসন৷ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ইসলাম ধর্মের ‘চাইনিজ ভার্সন' বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার চীনের আট প্রদেশের ইসলামিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর নতুন আইনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়৷ চীনের ইংরেজি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বৈঠকে দুই পক্ষই ইসলামের নীতিকে চীনা রীতিনীতি অনুযায়ী পরিবর্তন, পরিবর্ধনে সম্মত হয়েছে৷
গত সপ্তাহে চীনের তিন প্রদেশে নিবন্ধন ছাড়া মসজিদে তল্লাশি চালিয়ে ৪০ জনকে গ্রেপ্তারের পরপর ইসলাম ধর্মের চীনা রূপের ঘোষণা এলো৷
চীন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওকলোহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডেভিড স্ট্রোপ বলেন, চীনের এই ধরনের সিদ্ধান্তের পেছনে বড় কারণ ইসলামিক দলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া৷ এছাড়া চীন কখনোই অধিক বিদেশি বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ধর্ম প্রসার হতে দেবে না৷ এক কথায় বলতে গেলে ইসলাম ধর্মের হাত ধরে যে আরব সংস্কৃতির প্রসার ও আরব ঘরানার মসজিদ গড়ে উঠছে চীনে, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করাই চীনা প্রশাসনের মূল লক্ষ্য৷ এর মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন৷
চীনে মুসলিমদের বন্দি করে ‘ব্রেনওয়াশ’
চীনে ২ কোটি মুসলিমের বাস৷ ইসলামি চরমপন্থা কমাতে মুসলমানদের ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে চীনের রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করার জন্য খোলা হয়েছে বন্দিশিবির৷ অন্তত ৯ লাখ মানুষকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
যে কারণে মুসলিমদের আটক করা হচ্ছে
গত কয়েক বছরে চীনে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বেড়ে গেছে৷ কট্টরপন্থি উইগুর মুসলমানদের হামলায় গত কয়েক বছরে মারা গেছে কয়েকশ’ মানুষ৷ এ কারণেই উইগুর ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে আটক করে তাদের মতাদর্শ পরিবর্তনের জন্য বন্দিশিবির খোলা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/T. Peter
ভয়াবহ স্মৃতি
যেসব শিবিরে মুসলমানদের রাখা হচ্ছে, সেটাকে বলা হচ্ছে ‘ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্প’ বা দীক্ষাদান শিবির, যদিও এটি মুসলমানদের কাছে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ কেন্দ্র হিসেবেই বেশি পরিচিত৷ বন্দি শিবিরের একজন ওমির বেকালি৷ তিনি নিজের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেছেন সংবাদ সংস্থা এপি’র কাছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
নির্যাতন
কয়েক বছর আগে চীন থেকে কাজাখস্তানে চলে গিয়েছিলেন বেকালি৷ ২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চীনে আসেন৷ আসার পরই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷ এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেকালি সেই বন্দি শিবিরে তাঁর উপর চলা অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
আত্মহত্যার চেষ্টা
বেকালি জানান, আটকের এক সপ্তাহ পরে তাকে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো খাবার বা পানি দেয়া হয়নি৷ যখন তিনি তাদের নির্দেশ মানতেন না, তখন দেয়ালের সামনে ৫ ঘণ্টা টানা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো৷ তখন টানা ২০ দিন ধরে তার উপর যে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তারপর তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ভাবনায় পরিবর্তন
বেকালি জানান, এই বন্দিশিবিরে যারা থাকেন, তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ ধর্মীয় চিন্তা পরিবর্তন করতে হয়৷ নিজেদের সম্প্রদায়কে ত্যাগের কথা ভাবতে বাধ্য করা হয়৷ মুসলমান ছাড়াও এ শিবিরে বিদেশি কয়েকজনকেও রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ইসলামের ঝুঁকি
ঐ বন্দি শিবিরে যারা নির্দেশক ছিলেন, তারা কট্টরপন্থি এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর দৃষ্টান্ত দিয়ে ‘ইসলামের খারাপ দিক’ এবং ইসলামের কী কী ঝুঁকি রয়েছে, তা বলতেন৷ বেকালির ভাষায়, এটা একটা অবর্ণনীয় যন্ত্রনা, ‘‘কেননা আমি নিজের ভাবনার সমালোচনা করছি, নিজের সম্প্রদায়কে অস্বীকার করার কথা ভাবছি৷’’ গত বছরের ডিসেম্বরে ঐ বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পান তিনি৷ কিন্তু সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ধর্ম ছেড়ে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রশংসা
বন্দি শিবিরে সবাইকে খুব ভোরে উঠতে হতো৷ চীনের জাতীয় সংগীত গাইতে হতো৷ সকাল সাড়ে সাতটায় চীনের পতাকা উত্তোলন করতে হতো৷ এছাড়া এমন সব গান গাওয়া হতো যেগুলোতে কেবল কম্যুনিস্ট পার্টির প্রশংসা করা হয়েছে৷ এছাড়া তাঁদের চীনা ভাষা এবং চীনের ইতিহাস পড়তে হতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
রাষ্ট্রপ্রধানকে ধন্যবাদ
বেকালি জানান, খাবার হিসেবে প্রতিদিন সবজির স্যুপ আর রুটি দেয়া হতো৷ মাঝে মাঝে শুকরের মাংস এবং মদ খেতে বাধ্য করা হতো৷ তবে খাওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে কম্যুনিস্ট পার্টিকে ধন্যবাদ জানাতে হতো, পাশপাশি মাতৃভূমি এবং চীনা রাষ্ট্রপতিকেও ধন্যবাদ জানাতে হতো৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
নতুন পরিচয়
চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং এলাকায় এই বন্দিশিবিরগুলো স্থাপনের লক্ষ্য হলো মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনা৷ তাদের নিজেদের ধর্মীয় চিন্তাভাবনা পুরোপুরি দূর করা এবং তাদের নতুন রূপে পরিচয় করানো৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Wong
৯ লাখ বন্দি
জিনজিয়াং-এর থেকে নির্বাসিত মানুষদের দ্বারা পরিচালিত তুরস্ক ভিত্তিক একটি টেলিভিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে বেশ কিছু ফাঁস হওয়া সরকারি তথ্য রয়েছে, যার মাধ্যমে জানা গেছে, এসব বন্দিশিবিরে ৯ লাখ মানুষ বন্দি আছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার মতে, সংখ্যালঘুদের এত বিশাল গণ কারাগার বিশ্বে আর কোথাও নেই৷
ছবি: J. Duez
গোপন কার্যক্রম
চীনা কর্তৃপক্ষ এই বন্দিশিবিরের কথা স্বীকার করে না৷ তবে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়তে মতাদর্শ পরিবর্তন করা দরকার৷ সংবাদ সংস্থা এপি বন্দিশিবিরের বেশ কয়েকজন বন্দি এবং নির্দেশকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন৷ প্রত্যেকেই নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, কেননা, তাদের পরিবার রয়েছে চীনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. W. Young
হারানোর কিছু নেই
বেকালি কাজাখস্তান ফিরে গেছেন৷ ভেবেছিলেন কারো কাছে কিছু বলবেন না৷ কিন্তু গত মার্চে চীনা কর্তৃপক্ষ তার বাবা-মা এবং বোনকে ধরে নিয়ে যায়৷ তাই তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশ্বকে তাঁর গল্প বলার সিদ্ধান্ত নেন৷ বেকালি জানান, তিনি এসব কথা জানাতে চান, কারণ, তাঁর আর হারানোর কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
12 ছবি1 | 12
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রস্টবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা অধ্যাপক হাইয়ুন মা বলেন, ‘‘ধর্মীয় আচারে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে চীনাদের অতি জাতীয়তাবাদের লক্ষণ বলেই মনে হয়৷ এখানে কয়েকটি বিষয়ে নজর দেওয়া যায়, এর মধ্যে নাস্তিকতার অনুসারী প্রশাসক দল একটি ধর্মকে পরিমার্জন করছে, এটি অযৌক্তিক৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘চীনারা মনে করে, আরব সংস্কৃতি মানেই ভয়ানক কিছু৷ তাই চীনা মুসলমানদের জীবন থেকে তাবৎ আরব আচার মুছে ফেলাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত৷ এটিকে চীনা জাতীয়তাবাদের চরম পর্যায় বলা যায়, যার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন৷''
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ধর্ম পরিমার্জনের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে চীনা মুসলমানরা বিশ্ব মুসলিম ঐক্য থেকে আলাদা হয়ে একঘরে হয়ে পড়বে৷ এটাই চীনা প্রশাসনের মূল চাওয়া বলে মনে করা হচ্ছে৷
এদিকে দেশটির ১০ লাখেরও বেশি মুসলিমকে বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে আটক রেখে ধর্ম পালনে বাধা এবং জোর করে কমিউনিস্ট মতাদর্শে আস্থাশীল করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও ধারণা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার৷ ইতোমধ্যে চীনের বিভিন্ন মসজিদ থেকে গম্বুজ ও চাঁদ-তারার প্রতিকৃতি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ সেখানে মাদ্রাসার পাশাপাশি আরবি ভাষা শেখানোও নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
এদিকে চীনা প্রশাসন দাবি করছে, দেশে মুসলমান বাড়ছে৷ এ অবস্থায় দেশের একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মুসলিম দেশগুলোর চলমান সন্ত্রাসবাদ ও উগ্র ধর্মান্ধতা থেকে দূরে রাখতেই পরিবর্তন আনা হচ্ছে৷ এটিকে চীনা জাতীয়তাবাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সম্মানজনক সিদ্ধান্ত বলেই মনে করছেন তারা৷