চীনে অন্তত ১০ লাখ উইগুর মুসলমানকে আটকে রাখা হয়েছে৷ আধুনিক বৃত্তিমূলক শিক্ষার নামে চলছে নির্যাতন৷ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়া তাদের অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করার তথ্যও উঠে এসেছে ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে৷
বিজ্ঞাপন
চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে ঠিক কতজন উইগুর মুসলমানকে আটকে রাখা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই৷ তবে নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও খবর অনুযায়ী সংখ্যাটা দশ লাখের কম হবে না৷
২০০৯ সালে ভয়াবহ এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল শিনজিয়াং-এর রাজধানী উরুমকুই শহরে৷ তাতে কমপক্ষে ১৪০ জন নিহত এবং কয়েকশ' মানুষ আহত হয়েছিল৷অসংখ্য ঘর-বাড়ি জ্বালানো হয়েছিল সেই সংঘর্ষে, ধংস হয়েছিল অনেক রাষ্ট্রীয় সম্পদ৷
এর পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ. ২০১৪ সালে এক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয় ৩১ জন৷ উইগুর মুসলমানদের ওপর সরকারের কঠোর নজরদারি এবং দমন-পীড়ন-নির্যাতনের শুরু তখন থেকেই৷
চীন সরকারের দাবি, সব করা হচ্ছে ইসলামি জঙ্গি এবং উইগুরদের মনোজগত থেকে জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন করতে৷ সেই লক্ষ্যে শিনজিয়াং প্রদেশে খোলা হয় উইগুর মুসলমানদের ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষাদান ক্যাম্প'৷ চীন সরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের কথা বললেও উইগুর, বিশ্বের বিভি্ন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম মনে করে ওই ক্যাম্পে উইগুরদের আটকে রেখে আসলে একটি সম্প্রদায়কে অস্তিত্বের সংকটে ফেলা হচ্ছে৷
ডয়চে ভেলের বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এমন দাবি৷ প্রতিবেদনটি তৈরি করতে শিনজিয়াং-এ দীর্ঘদিন আটক থাকা চারজন উইগুরের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ চারজনই কাজাখ বংশোদ্ভূত৷ শিনজিয়াং থেকে মুক্তি পেয়ে এই মুহূর্তে চীনের প্রতিবেশী মুসলিম প্রধান দেশ কাজাখস্তানেই রয়েছেন তারা৷
অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়
কাজাখস্তানে ফিরে যাওয়া ওই চার উইগুর মুসলমানের দুজন পুরুষ, দুজন নারী৷ টানা কয়েক সপ্তাহ তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিনজিয়াংয়ে আটকদের কোনো-না-কোনোভাবে অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷
৭৫টি ছোট-বড় অপরাধের তালিকা ধরিয়ে তার অন্তত একটি বা একাধিক অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নির্দিষ্ট কাগজে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দেয় কর্তৃপক্ষ৷ চারজনই দাবি করেন, বিদেশে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা, বিদেশে যাওয়া থেকে শুরু করে জঙ্গিবাদে জড়িত সন্দেহ করার মতো ‘অপরাধ' হিসেবে নিয়মিত নামাজ পড়া, মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করার মতো বিষয়গুলোরও উল্লেখ আছে ওই তালিকায়৷
খেলায় প্রতিবাদের রাজনীতি
চীনের উইগুর জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মানির জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মেসুত ও্যজিল৷ অন্যদিকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এ বিষয়ে একেবারে চুপ৷ খেলোয়াড়দের এমন কিছু প্রতিবাদের গল্প থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Stansall
মেসুত ও্যজিল
আর্সেনালের হয়ে খেলা জার্মানির জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মেসুত ও্যজিল সম্প্রতি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠছেন৷ গতবছর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ানের সঙ্গে ছবি তুলে বিতর্কের মুখে জার্মান জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন ও্যজিল৷ এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় উইগুরদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করে চীনের সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Stansall
এমিলি ডেভিসন
খেলার মধ্যে প্রতিবাদ জানানোর শুরুর দিককার উদাহরণগুলির একটি ছিল ১৯১৩ সালে৷ নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে এমিলি ডেভিসনের ভয়াবহ প্রতিবাদ এ আন্দোলনকে অন্য আক মাত্রা দেয়৷ ব্রিটেনের ইপসোমে ঘোড়ার দৌড় ডার্বি চলার সময় ট্র্যাকে ঢুকে পড়েন ডেভিসন৷ রাজার ঘোড়া আনমারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লে মাথায় আঘাত পান তিনি৷ এই আন্দোলনের ফলেই পাঁচ বছর পর নারীর অধিকার আদায় হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/empics/S&G
মুহাম্মদ আলী
১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অ্যামেরিকার হয়ে লড়াইয়ে নাম লেখাতে অস্বীকার করেছিলেন মোহাম্মদ আলী৷ বক্সিংয়ের এই সুপারস্টার, যুদ্ধের বিরোধীতা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ বাধ্যতামূলক সেনাঅন্তর্ভূক্তি ফাঁকি দেয়ার শাস্তি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, পদবি ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং বক্সিংয়ের লাইসেন্সও স্থগিত করা হয়৷ ১৯৭১ সালে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আলী তিন বছরের জন্য বক্সিং রিং থেকে বাইরে ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press
ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট
খেলোয়াড়দের প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় ঘটনা সম্ভবত ১৯৬৮ সালে৷ মেক্সিকো অলিম্পিকে পুরুষদের ২০০-মিটার স্প্রিন্টের ফাইনাল শেষে টেমি স্মিথ এবং জন কার্লোস ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট দেন৷ মার্কিন জাতীয় সংগীত বাজানোর সময় দুজনই মাথা নীচু করে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে রাখেন৷ অ্যামেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের দাবিতে তাদের এ প্রতিবাদ অনেককে ক্ষুব্ধও করেছিল৷
ছবি: AP
আবদুল-রউফ
১৯৯৬ সালে অ্যামেরিকার বাস্কেটবল খেলোয়াড় মাহমুদ আবদুল-রউফ খেলা শুরুর আগে জাতীয় সংগীতে বাজানোর সময় দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানান৷ তিনি বলেন, মার্কিন পতাকা নিপীড়নের প্রতীক৷ ইসলামিক বিশ্বাসের দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো বিরোধপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷ এ ঘটনায় এনবিএ তাকে বরখাস্ত করে এবং প্রতি ম্যাচে ৩১ হাজার ডলারেরও বেশি জরিমানা করে৷ কয়েক দিন পরই অবশ্য লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ফিরে আসেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Spencer Green
ক্যাথি ফ্রিম্যান
১৯৯৪ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট জয়ের পর দুটি পতাকা হাতে দৌড়ান ক্যাথি ফ্রিম্যান৷ তার এক হাতে ছিল অস্ট্রেলিয়ান, অন্যহাতে আদিবাসী পতাকা৷ এজন্য গেমসের আয়োজকদের তিরষ্কার শুনতে হয়েছিল তাকে৷ কিন্তু ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের পর আবার একইভাবে উদযাপন করেন ফ্রিম্যান৷
ছবি: picture-alliance/EMPICS
কেভিন-প্রিন্স বোয়াটেং
গ্যালারিতে থাকা সমর্থকদের বর্ণবাদী স্লোগানের প্রতিবাদ জানিয়ে ২০১৩ সালে মাঠেই প্রতিবাদ জানান জার্মান বংশোদ্ভূত ঘানাইয়ান ফুটবলার কেভিন-প্রিন্স বোয়াটেং৷ ইটালির চতুর্থ স্তরের দল প্রো প্যাট্রিয়ার বিপক্ষে ছিল সে ম্যাচ৷ প্রো প্যাট্রিয়া সমর্থকদের একটি অংশ তৎকালীন এই এসি মিলান মিডফিল্ডারকে লক্ষ্য করে বর্ণবাদী আক্রমণ করে৷ বোয়াটেংবল তুলে ভিড়ের দিকে লাথি দেন৷ ২৬ মিনিট বন্ধ থাকে খেলা৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoli
লেব্রন জেমস
২০১৪ সালে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ যুবক এরিক গার্নারকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ মৃত্যুর আগে তার বলা শেষ কথা ’শ্বাস নিতে পারছি না’ লেখা টিশার্ট পরে বাস্কেটবল ম্যাচ খেলতে নামেন তারকা খেলোয়াড় লেব্রন জেমস এবং তার সহযোগী কিরি ইরভিং, জারেট জ্যাক এবং কেভিন গারনেট৷ ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এই প্রতিবাদ৷
ছবি: imago/UPI Photo
ফেয়িসা লাইলেসা
অলিম্পিকে ম্যারাথনে রৌপ্যজয়ী অ্যাথলিট ফেয়িসা লাইলেসা ২০১৬ সালের রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকে অন্য একটি কারণে সংবাদের শিরোনাম হন৷ ফিনিশিং লাইন পেরোনোর সময় মাথার ওপর হাত তুলেন লেইলেসা৷ ইথিওপিয়ায় আশ্রয়প্রার্থী অরোমো গোষ্ঠীর সঙ্গে সংহতি জানিয়েই এই ভঙ্গি করেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/O. Morin
কলিন কেপার্নিক
জাতিগত বৈষম্য এবং বন্দুক সহিংসতার প্রতিবাদে ২০১৬ সালে এক ম্যাচে মার্কিন জাতীয় সঙ্গীত চলার সময় হাঁটু গেড়ে বসে প্রতিবাদ জানান ফুটবলার কলিন কেপার্নিক৷ এরপর প্রতিবাদের এই স্টাইল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়৷ প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এ ঘটনায় কেপার্নিকের তীব্র সমালোচনা করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. J. Sanchez
গোয়েন বেরি এবং রেস ইম্বোডেন
মার্কিন সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আবারও জাতীয় সঙ্গীতের সময় হাঁটু গেড়ে বসে প্রতিবাদ জানিয়ে সবশেষ আলোচনায় এসেছেন অ্যাথলিট গোয়েন বেরি এবং রেস ইম্বোডেন৷ ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী এই অ্যাথলিটরা প্রতিবাদ জানান ডনাল্ড ট্রাম্পের নানা বিতর্কিত নীতির৷
তালিকা থেকে কিছু অপরাধে টিক চিহ্ন দিয়ে তাতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করা ব্যক্তিকে অনেক ক্ষেত্রে অল্প সাজা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়৷ ডয়েচে ভেলেকে সাক্ষাৎকার দেয়া চার উইগুরের তিনজনই সেভাবে কাজাখস্তানে ফিরে যাবার সুযোগ পেয়েছেন৷
এক সাহসী উইগুর
তবে চারজনের মধ্যে একজন ভীষণ সাহসী৷ তিনি জানান, বারবার চাপ দেয়া সত্ত্বেও তিনি সেই তালিকার কোনো অপরাধেই জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি৷যতবার চাপ এসেছে ততবারই বলেছেন, ‘‘আমি নির্দোষ৷'' অনেকেই বলেছিলেন, তাতে বিপদ হতে পারে,আসতে পারে দীর্ঘ কারাবাসের রায়৷কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি৷ একদিন হঠাৎই আসে মুক্তির খবর৷
অল্প শাস্তি সৌভাগ্যের
কাজাখস্তানের জনগণ চীনে আটক স্বজনদের মুক্তির দাবি তোলায় এবং কাজাখ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণেই মূলত কাজাখ উইগুরদের ছেড়ে দিতে শুরু করে চীন সরকার৷
ডয়চে ভেলেকে এক উইগুর নারী বলেন, তালিকায় দু-একটা টিক চিহ্ন দিয়ে তিনি যখন স্বল্প মেয়াদের কারাবাস শেষে মুক্তির রায় পান, অন্যদের জন্য খারাপ লাগছিল তার৷ তিনি বলেন, যাদের দীর্ঘ কারাবাসের আদেশ হয়েছিল তাদের ‘‘চোখের জল মুছতে দেখে, কাঁদতে দেখে
মন খুব খারাপ হয়েছিল৷'' তবে তিনি এ-ও জানান, নিজের স্বল্পমেয়াদি কারাদণ্ড হওয়ায় খুশি হয়েছিলেন, কারণ, ‘‘আমি তো সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল আর দু বছর সেখানে থাকতে হলে আমি মারা যাবো৷''