চীনের শিনচিয়াংয়ে উইগুরদের ওপর চলমান দমন অভিযানে এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আটক, ধর্মীয় রীতি-নীতি পালনে বাধা এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ‘রাজনৈতিক অনুশাসন' মেনে চলতে বাধ্য করছে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার মানবাধিকার সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন শিবিরে আটক উইগুর ও অন্যান্য মুসলমিদের ইসলামী রীতিতে পরস্পরকে সম্ভাষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে মান্দারিন ভাষা শিখতে হচ্ছে এবং কর্তৃপক্ষের ঠিক করে দেওয়া গান গাইতে হচ্ছে৷
বন্দি শিবিরে কাটিয়ে আসা পাঁচজনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এইচআরডাব্লিউ৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজাখস্তান, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ার মতো ২৬টি ‘স্পর্শকাতর' দেশে আত্মীয়-স্বজন থাকা উইগুরদের ‘টার্গেট' করছে কর্তৃপক্ষ৷ তাদের আটকের পর কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই বেশ কয়েক মাস বন্দি করে রাখা হচ্ছে৷
বন্দি শিবিরে নির্দেশনা না মানলে খেতে না দেওয়া, ২৪ ঘণ্টার মতো দাঁড় করিয়ে রাখা এবং একাকী নির্জন কারাবাসের মতো শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে৷
স্বায়ত্তশাসিত উইগুর অঞ্চলে ‘ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ' ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য আনতে লাখ লাখ উইগুর মুসলিমকে ‘রাজনৈতিক শিবিরে' জোর করে আটকে রাখা হয়েছে বলে গত আগস্টে অভিযোগ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্যানেল৷
চীনে মুসলিমদের বন্দি করে ‘ব্রেনওয়াশ’
চীনে ২ কোটি মুসলিমের বাস৷ ইসলামি চরমপন্থা কমাতে মুসলমানদের ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে চীনের রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করার জন্য খোলা হয়েছে বন্দিশিবির৷ অন্তত ৯ লাখ মানুষকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
যে কারণে মুসলিমদের আটক করা হচ্ছে
গত কয়েক বছরে চীনে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বেড়ে গেছে৷ কট্টরপন্থি উইগুর মুসলমানদের হামলায় গত কয়েক বছরে মারা গেছে কয়েকশ’ মানুষ৷ এ কারণেই উইগুর ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে আটক করে তাদের মতাদর্শ পরিবর্তনের জন্য বন্দিশিবির খোলা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/T. Peter
ভয়াবহ স্মৃতি
যেসব শিবিরে মুসলমানদের রাখা হচ্ছে, সেটাকে বলা হচ্ছে ‘ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্প’ বা দীক্ষাদান শিবির, যদিও এটি মুসলমানদের কাছে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ কেন্দ্র হিসেবেই বেশি পরিচিত৷ বন্দি শিবিরের একজন ওমির বেকালি৷ তিনি নিজের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেছেন সংবাদ সংস্থা এপি’র কাছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
নির্যাতন
কয়েক বছর আগে চীন থেকে কাজাখস্তানে চলে গিয়েছিলেন বেকালি৷ ২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চীনে আসেন৷ আসার পরই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ইনডকট্রিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷ এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বেকালি সেই বন্দি শিবিরে তাঁর উপর চলা অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
আত্মহত্যার চেষ্টা
বেকালি জানান, আটকের এক সপ্তাহ পরে তাকে একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো খাবার বা পানি দেয়া হয়নি৷ যখন তিনি তাদের নির্দেশ মানতেন না, তখন দেয়ালের সামনে ৫ ঘণ্টা টানা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো৷ তখন টানা ২০ দিন ধরে তার উপর যে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়, তারপর তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ভাবনায় পরিবর্তন
বেকালি জানান, এই বন্দিশিবিরে যারা থাকেন, তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ ধর্মীয় চিন্তা পরিবর্তন করতে হয়৷ নিজেদের সম্প্রদায়কে ত্যাগের কথা ভাবতে বাধ্য করা হয়৷ মুসলমান ছাড়াও এ শিবিরে বিদেশি কয়েকজনকেও রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ইসলামের ঝুঁকি
ঐ বন্দি শিবিরে যারা নির্দেশক ছিলেন, তারা কট্টরপন্থি এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর দৃষ্টান্ত দিয়ে ‘ইসলামের খারাপ দিক’ এবং ইসলামের কী কী ঝুঁকি রয়েছে, তা বলতেন৷ বেকালির ভাষায়, এটা একটা অবর্ণনীয় যন্ত্রনা, ‘‘কেননা আমি নিজের ভাবনার সমালোচনা করছি, নিজের সম্প্রদায়কে অস্বীকার করার কথা ভাবছি৷’’ গত বছরের ডিসেম্বরে ঐ বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পান তিনি৷ কিন্তু সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
ধর্ম ছেড়ে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রশংসা
বন্দি শিবিরে সবাইকে খুব ভোরে উঠতে হতো৷ চীনের জাতীয় সংগীত গাইতে হতো৷ সকাল সাড়ে সাতটায় চীনের পতাকা উত্তোলন করতে হতো৷ এছাড়া এমন সব গান গাওয়া হতো যেগুলোতে কেবল কম্যুনিস্ট পার্টির প্রশংসা করা হয়েছে৷ এছাড়া তাঁদের চীনা ভাষা এবং চীনের ইতিহাস পড়তে হতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
রাষ্ট্রপ্রধানকে ধন্যবাদ
বেকালি জানান, খাবার হিসেবে প্রতিদিন সবজির স্যুপ আর রুটি দেয়া হতো৷ মাঝে মাঝে শুকরের মাংস এবং মদ খেতে বাধ্য করা হতো৷ তবে খাওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে কম্যুনিস্ট পার্টিকে ধন্যবাদ জানাতে হতো, পাশপাশি মাতৃভূমি এবং চীনা রাষ্ট্রপতিকেও ধন্যবাদ জানাতে হতো৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
নতুন পরিচয়
চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং এলাকায় এই বন্দিশিবিরগুলো স্থাপনের লক্ষ্য হলো মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনা৷ তাদের নিজেদের ধর্মীয় চিন্তাভাবনা পুরোপুরি দূর করা এবং তাদের নতুন রূপে পরিচয় করানো৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Wong
৯ লাখ বন্দি
জিনজিয়াং-এর থেকে নির্বাসিত মানুষদের দ্বারা পরিচালিত তুরস্ক ভিত্তিক একটি টেলিভিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে বেশ কিছু ফাঁস হওয়া সরকারি তথ্য রয়েছে, যার মাধ্যমে জানা গেছে, এসব বন্দিশিবিরে ৯ লাখ মানুষ বন্দি আছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার মতে, সংখ্যালঘুদের এত বিশাল গণ কারাগার বিশ্বে আর কোথাও নেই৷
ছবি: J. Duez
গোপন কার্যক্রম
চীনা কর্তৃপক্ষ এই বন্দিশিবিরের কথা স্বীকার করে না৷ তবে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়তে মতাদর্শ পরিবর্তন করা দরকার৷ সংবাদ সংস্থা এপি বন্দিশিবিরের বেশ কয়েকজন বন্দি এবং নির্দেশকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন৷ প্রত্যেকেই নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, কেননা, তাদের পরিবার রয়েছে চীনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. W. Young
হারানোর কিছু নেই
বেকালি কাজাখস্তান ফিরে গেছেন৷ ভেবেছিলেন কারো কাছে কিছু বলবেন না৷ কিন্তু গত মার্চে চীনা কর্তৃপক্ষ তার বাবা-মা এবং বোনকে ধরে নিয়ে যায়৷ তাই তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশ্বকে তাঁর গল্প বলার সিদ্ধান্ত নেন৷ বেকালি জানান, তিনি এসব কথা জানাতে চান, কারণ, তাঁর আর হারানোর কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. H. Guan
12 ছবি1 | 12
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে বেইজিং৷ তারা বলছে, এসব ক্যাম্পে ‘রাজনৈতিক শিক্ষা' দেওয়া হয় না, বরং, এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সোশ্যাল মোবিলিটি বৃদ্ধিতে সরকারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে তাঁদের কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে৷
শিনচিয়াংকে ইসলামপন্থি উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হুমকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে চীনের দাবি৷ তাদের ভাষ্যমতে, ওই অঞ্চলে টার্কিক ভাষাভাষী উইগুর এবং হান চীনা সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির লক্ষ্যে অনেকবার হামলা চালানো হয়েছে৷
শিনচিয়াংয়ের সাবেক বাসিন্দা এবং বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত ৫৮ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে হংকংভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গবেষক মায়া ওয়াং বলেন, শিনশিয়াংয়ে বন্দি শিবিরের বাইরে এখনো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত তল্লাশি চৌকি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে৷ এখানে ফেসিয়াল রেকগনিশন প্রযুক্তি এবং বাড়ি ধরে ধরে কিউআর কোড দিয়ে তার মাধ্যমে পুলিশের তদারকি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷
এএইচ/এসিবি (রয়টার্স)
যে মুসলিমদের পছন্দ করে চীন
চীনে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মুসলমানের বাস৷ উইগুর মুসলিমদের উপর নিপীড়নের কথা অনেকেই জানেন৷ কিন্তু আরেক মুসলিম গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের সুনজর আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Reynolds
হুই মুসলিম
বর্তমানে চীনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ৷ এর মধ্যে হুই মুসলিমদের সংখ্যা এক কোটির বেশি৷ আর যে মুসলিম গোষ্ঠী সরকারের নিপীড়নের শিকার সেই উইগুরদের সংখ্যা এক কোটির কিছু কম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Wong
উইগুরদের জন্য বিধিনিষেধ
বিভিন্নভাবে তাদের উপর নিপীড়ন চালায় চীনা সরকার৷ রোজা রাখা ও নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে উইগুরদের জন্য বিধিনিষেধ জারি করা হয়৷
ছবি: Getty Images
কিন্তু হুইদের জন্য আলাদা নিয়ম
একই দেশে থেকে উইগুররা যখন ঠিকমতো ধর্ম পালন করতে পারেন না সেখানে হুই মুসলিমদের কোনো বাধার মুখে পড়তে হয় না৷ উপরের ছবিটিই তার প্রমাণ৷ চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংকে হুই মুসলিমদের সঙ্গে একটি মসজিদে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/J. Peng
কী কারণ?
উইগুররা স্বাধীনতা চান, হুইদের সেই আগ্রহ নেই৷ উইগুররা প্রথম ভাষা হিসেবে মান্দারিন ব্যবহার করেন না, হুইরা করেন৷ সর্বোপরি হুইদের সংস্কৃতির সঙ্গে চীনা সংস্কৃতির কিছুটা মিল আছে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
সবচেয়ে বড় মসজিদ
দেখছেন চীনের সবচেয়ে বড় মসজিদ৷ নাম ‘গ্রেট মস্ক অফ চিয়ান’৷ কিন্তু দেখতে কি মসজিদের মতো লাগছে, নাকি চীনের কোনো ভবন মনে হচ্ছে? তাহলেই বুঝুন হুইদের মসজিদেও কেমন চীনা সংস্কৃতির ছাপ আছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Far
আছে বাণিজ্যিক কারণও
মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী চীন৷ আর তার জন্য আরবি জানা মানুষ প্রয়োজন৷ আরব ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে নিংচিয়া রাজ্যের ইনচুয়ান শহরে একটি ইসলামিক থিম পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে৷ ঐ শহরের রাস্তায় আরবিতে দিকনির্দেশনার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ নিংচিয়া রাজ্যে অনেক হুই বাস করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Weiken
হুই কারা?
প্রায় ১,২০০ বছর আগে আরব, পারস্য আর মঙ্গোলিয়া থেকে মুসলিম ব্যবসায়ীরা চীনে গিয়েছিলেন৷ সেখানে তাঁদের অনেকে হান চাইনিজদের বিয়ে করেন৷ সেভাবেই হুই গোষ্ঠীর সৃষ্টি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Reynolds
যেখানে বাস তাঁদের
আগে নিংচিয়া রাজ্যের কথা বলা হয়েছে৷ এছাড়া উত্তরাঞ্চলীয় আরও কয়েকটি রাজ্যেও হুইরা বাস করেন৷ এছাড়া বেইজিং, সাংহাই সহ বড় বড় শহরেও অনেক হুই থাকেন৷