চীনে সংখ্যালঘুদের হত্যা করে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল৷ এ ঘটনাকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার সঙ্গেও তুলনা করেছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
চীনের জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল৷
ওই ট্রাইব্যুনালের কাউন্সেল হামিদ সাবি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে (ইউএনএইচআরসি) জানিয়েছেন, বহু বছর চীনজুড়ে জোর করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং আজও তা অব্যাহত আছে৷ নিষিদ্ধ ঘোষিত ফালুন গং-এর বন্দি এবং উইগুর সংখ্যালঘুদের এই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, এতে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
‘‘শিকারের জন্য শিকার, মৃত্যুর জন্য মৃত্যু, হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গ জীবিত অবস্থায় কেটে ফেলা... নির্দোষ, নিরীহ মানুষ এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ গণ-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন৷’’
সাবি বলেন, ‘‘জীবন বাঁচাতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন একটি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক বিজয়, কিন্তু দাতাকে হত্যা করা অপরাধ৷'' নির্দোষ ও নিরীহ মানুষদের ধরে তাঁদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করাকে এ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ গণনৃশংসতা বলে মত দেন তিনি৷
মুসলমানরা বন্দিশিবিরে, পর্যটকরা শিনচিয়াংয়ে
চীনের শিনচিয়াং প্রদেশে মুসলমানদের নতুন করে শিক্ষিত করে তোলার নামে বন্দি করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ৷ রাজ্যের এমন ভাবমূর্তি দূর করতে সেখানে পর্যটক আকর্ষণের চেষ্টা চলছে৷
ছবি: AFP/G. Baker
মুসলিমদের বাস
চীনের শিনচিয়াং রাজ্যে মূলত উইগুরসহ তার্কিক ভাষা বলা অন্য মুসলিমদের বসবাস ছিল৷ গত শতকের ৫০ থেকে ৭০ দশকের মধ্যে সেখানে সরকারিভাবে হান চীনাদের সংখ্যা বাড়ানো হয়৷ তখন থেকে মুসলমান ও হানদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
মুসলমানেরা বন্দিশিবিরে
মুসলমানদের নতুন করে শিক্ষা দেয়ার নামে চীন সরকার কয়েক বছর আগে মুসলিমদের বিভিন্ন ক্যাম্পে (ছবি) নিয়ে যাওয়া শুরু করে৷ সেখানে তাঁদের মান্দারিন ভাষা শেখানো ও কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয় বলে চীনের দাবি৷ তবে জাতিসংঘের অভিযোগ, ‘ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ’ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য আনতে উইগুরদের ‘রাজনৈতিক শিবিরে’ জোর করে আটকে রাখা হয়েছে৷
ছবি: AFP/G. Baker
নজরে রাখতে অ্যাপ
তথাকথিত এসব বন্দিশিবিরের বাইরে যে উইগুররা আছেন তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের উপর নজর রাখতে সম্প্রতি একটি অ্যাপ চালু করেছে চীন৷ এই অ্যাপের সাহায্যে উইগুরদের ৩৬ ধরনের আচরণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়৷ যেমন, প্রতিবেশীর সঙ্গে বেশি না মেশা, স্মার্টফোন ব্যবহার না করা, ‘উৎসাহী হয়ে’ মসজিদে দান করা ইত্যাদি৷
এছাড়া ফেসিয়াল-রিকগনিশন ক্যামেরা, ওয়াইফাই স্নিফার্স (এর মাধ্যমে চেকপয়েন্ট দিয়ে পার হওয়ার সময় মানুষের কাছে থাকা মোবাইলের সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়), পুলিশি চেকপয়েন্ট ইত্যাদির মাধ্যমেও উইগুরদের তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Azubel
পর্যটক বাড়ছে
তাকলামাকান মরুভূমি, বরফে ঢাকা তিয়ানশান, দেখার এমন অনেক কিছুই আছে শিনচিয়াংয়ে৷ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরকারের আচরণ নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে শিনচিয়াং সম্পর্কে নেতিবাচক খবর এলেও সেখানে পর্যটক যাওয়া কমেনি, বরং বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে আগের বছরের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে বলে সরকারি তথ্য বলছে৷ অবশ্য বেশিরভাগই দেশি পর্যটক৷
ছবি: AFP/G. Baker
পর্যটকদের ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে
২০১৪ সালে শিনচিয়াং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ছুরি হামলায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটার পর সেখানে পর্যটকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল৷ এই অবস্থায় প্রাদেশিক সরকার পর্যটক প্রতি ৭৩ ডলার বা ছয় হাজার টাকা ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ এখনও সেটা আছে৷
ছবি: AFP/G. Baker
সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি নেই
শিনচিয়াংয়ের সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি নেই পর্যটকদের৷ মুসলমানদের যে শিবিরগুলোতে বন্দি করে রাখা হয়েছে তার আশেপাশে যাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন এএফপির দুই সাংবাদিক৷ এছাড়া শিনচিয়াংয়ে চেকপয়েন্ট ও সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তাঁরা৷ অবশ্য এতসব নিরাপত্তা তল্লাশিকে সমস্যা মনে করছেন না চীনা পর্যটকরা৷
ছবি: Reuters/T. Peter
কোথায় ভয়!
শিনচিয়াংয়ের কাশগর শহরে উইলিয়াম লি নামের এক পর্যটকের সঙ্গে এএফপির প্রতিবেদকদের দেখা হয়েছিল৷ তিনি জানান, ঘুরতে গিয়ে তাঁর মনে হয়নি যে উইগুররা কোনো ভয়ের মধ্যে (যদি না আপনাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়) আছেন৷ ‘‘এটা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি,’’ বলেন লি৷
ছবি: AFP/G. Baker
8 ছবি1 | 8
ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের বন্দি এবং ফালুন গং ও উইগুর সংখ্যালঘুদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে তারা৷ দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চীন সরকার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লোকদের হত্যা করে তাঁদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে বিক্রি করছে৷
বন্দি ও সংখ্যালঘু ছাড়াও জীবিত বা মৃত ব্যক্তির কিডনি, লিভার, হার্ট, ফুসফুস, কর্নিয়া এবং ত্বকের চামড়া বিক্রির জন্য অপসারণ করা হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷
বেইজিং এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে৷ তারা বলছে, ২০১৫ সাল থেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের অঙ্গও তারা আর ব্যবহার করে না৷
আধ্যাত্মিক গোষ্ঠী ফালুং গংকে ২০ বছর আগে নিষিদ্ধ করা হলে এর ১০ হাজার সদস্য বেইজিংয়ে নীরব প্রতিবাদ করতে আসেন৷ এরপর এদের বেশিরভাগকে জেলে পাঠানো হয়৷
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জেফ্রি নিস বলেন, সরকার, জাতিসংঘ এবং এর সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা এটি প্রমাণের জন্য আর অন্ধ দৃষ্টি রাখতে পারবে না৷
সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি স্লোবোডান মিলোসেভিকের বিচারের নেতৃত্ব দেওয়া প্রসিকিউটর নিস বলেন, ট্রাইব্যুনালের অনুসন্ধানের পর এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার৷
চীনা নাগরিকদের পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি চীনে গিয়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেন৷ লন্ডনে চীনা দূতাবাসের এক মুখপাত্র থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, সরকারি বিধিবিধানে শর্ত রাখা হয়েছে মানব অঙ্গ দান স্বেচ্ছাসেবায় এবং বিনা অর্থে হতে হবে৷