সোমবার চীনের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলনে ইইউ নেতারা হংকং, বাণিজ্য, করোনা ভাইরাস ইত্যাদি বিষয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছেন৷ চীন রক্ষণাত্মক মনোভাব নিয়ে যাবতীয় অভিযোগ সামলানোর চেষ্টা করেছে৷
বিজ্ঞাপন
এই মুহূর্তে বিশ্বের একাধিক প্রান্তে চীনের ভাবমূর্তি মোটেই ভাল যাচ্ছে না৷ করোনা ভাইরাস থেকে শুরু করে হংকং-এ দমন নীতি, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে উত্তেজনা, বাণিজ্য নীতিকে ঘিরে ক্ষোভ ইত্যাদি কারণে চীনের সঙ্গে অনেক দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে৷ সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনের শীর্ষ সম্মেলনেও এমন সব অপ্রিয় বিষয় উঠে এসেছে৷ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই প্রান্তের শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় শিষ্টাচার বজায় থাকলেও জোরালো মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ চীনের পক্ষে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেশিয়াং এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন ও ইইউ সরকার পরিষদের প্রধান শার্ল মিশেল আলোচনায় অংশ নেন৷
ইইউ নেতারা চীনের উদ্দেশ্যে সে দেশের অর্থনীতি আরও উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেন৷ গোটা বিশ্বে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনের প্রবল উৎসাহ সত্ত্বেও নিজস্ব বাজারে বিদেশি পণ্য আমদানির পথে এখনো নানা বাধা রয়েছে৷ বিদেশি কোম্পানিগুলির আইনি রক্ষাকবচও বেশ দুর্বল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প একা নন, অনেক দেশেই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে৷ মিশেল বলেন, চীনের কোম্পানিগুলি ইউরোপে যে সুবিধা ভোগ করছে, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে চীন মোটেই সেইরকম সুবিধা দিচ্ছে না৷ বিশেষ করে গাড়ি, বায়োটেক ও মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলির জন্য ভরতুকি সীমিত রাখার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ চীনের এক প্রতিনিধি এ বিষয়ে আরও ধৈর্য্য ধরার ডাক দিয়েছেন৷ উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় ভরতুকিতে চলা বিদেশি কোম্পানিগুলির কার্যকলাপ সীমিত রাখতে ইইউ যে আইন প্রণয়ন করতে চলেছে, সে বিষয়ে চীন অস্বস্তিতে রয়েছে৷
হংকং-এ বেইজিং-এর দমন নীতিরও সমালোচনা করেছে ইইউ৷ বিশেষ করে সেখানে বিতর্কিত নিরাপত্তা আইন কার্যকর করলে তার পরিণাম ‘অত্যন্ত নেতিবাচক' হবে বলে ইইউ সতর্ক করে দিয়েছে৷ ইইউ এ প্রসঙ্গে হংকং-এর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার সম্পর্কে চীনের অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে৷ চীনের সংসদ অবশ্য শনিবার এ বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক প্রস্তাবের সমালোচনা করেছে৷ হংকং-কে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়' হিসেবে বিবেচনা করে চীন বাইরে থেকে কোনো হস্তক্ষেপ চায় না৷
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে চীন থেকে প্রথমদিকে ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল বলেও ইইউ অভিযোগ করেছে৷ এমন আচরণ মোটেই বরদাস্ত করা হবে না, বলেন ফন ডেয়ার লাইয়েন৷ শীর্ষ সম্মেলনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেন, ইইউ ও চীনের কৌশলগত সম্পর্ক একইসঙ্গে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জে ভরা৷ চীনকে একই সঙ্গে সহযোগী ও প্রতিপক্ষ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি৷
চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে যথেষ্ট আশাবাদী৷ তাঁর মতে, চীন ও ইইউ প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সহযোগিতার মাত্রা অনেক বেশি৷
এসবি/জেডএইচ (রয়টার্স, এএফপি)
বাণিজ্য যুদ্ধ হলে কী ক্ষতি হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ নীতি রূপায়ন করতে আমদানির পথে বাধা সৃষ্টি করছেন৷ সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তারই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
বাণিজ্য যুদ্ধের অর্থ কী?
কোনো দেশ কোনো এক বা একাধিক পণ্য আমদানির উপর কর, শুল্ক বা অন্য কোনো আর্থিক বোঝা চাপালে বাকি দেশগুলিও পালটা পদক্ষেপ নিতে পারে৷ বিশেষ করে অ্যামেরিকা ও চীনের মতো বিশাল দেশের সংঘাতের জের ধরে গোটা বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্য যুদ্ধের আকার নিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণে আনা মোটেই সহজ হবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Peter
অতীত দৃষ্টান্ত
১৯৩০-এর দশকে শেষ বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা বিশাল মন্দা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার সে বছর শুল্ক সংক্রান্ত নতুন আইন কার্যকর করার ফলে ২০ হাজারেরও বেশি পণ্যের উপর শুল্ক চাপানো হয়েছিল৷ ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে যে, এ ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ও দেশের জন্য শুল্ক চাপানো হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
ট্রাম্প কেন বাণিজ্য যুদ্ধের পথে এগোচ্ছেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রতিকূল বাণিজ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তোপ দেগে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তবে সমালোচকদের মতে, এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তিনি অ্যামেরিকার সার্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছেন না৷ কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কাঠামো তোলপাড় হয়ে গেলে আখেরে অ্যামেরিকারই ক্ষতি হবে৷ ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাবে, রপ্তানি কমে যাবে এবং প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
ছবি: picture-alliance/K. Ohlenschläger
পালটা পদক্ষেপ
ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলে বাকি দেশগুলিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না৷ ক্যানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যামেরিকার বিরুদ্ধেও পালটা পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এমন বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার চেয়ে বহুপাক্ষিক সমাধানসূত্রের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
অ্যামেরিকার ক্ষতি
সব সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ট্রাম্প যদি সত্যি আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপান, তার পরিণতি অ্যামেরিকার জন্যও ইতিবাচক হবে না৷ যেমন, ইস্পাত আমদানির উপর শুল্ক চাপালে অ্যামেরিকার বাজারেও তার মূল্য বেড়ে যাবে৷ তার ফলে মার্কিন ইস্পাত কোম্পানিগুলির লাভ হলেও ক্রেতাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হবে৷ যে কোম্পানিগুলি ইস্পাত ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Weihrauch
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অ্যামেরিকায় ইস্পাত রপ্তানি করতে না পারলে চীন ইউরোপের বাজারে তা আরও সস্তায় বিক্রি করার চেষ্টা করতে পারে৷ স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে এমন আরও দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে৷ সামগ্রিকভাবে এমন অস্বাভাবিক প্রবণতা নানাভাবে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ সাম্প্রতিক নানা সংকট কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন সবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তখন নতুন করে এমন বিপদ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/XinHua
আইনি লড়াই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন ডাব্লিইউটিও সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব বাণিজ্যের বিধিনিয়ম স্থির করে এসেছে এবং বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছে৷ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে৷ সব পক্ষ ডাব্লিইউটিও-র রায় না মানলে এই সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে৷ এমন কাঠামো তার কার্যকারিতা হারালে ভবিষ্যতে সেই ক্ষতি পূরণ করা সহজ হবে না৷