পাঁচ সপ্তাহের জন্য সংসদ মুলতুবি করে আপাতত ‘পথের কাঁটা' দূর করেছেন বরিস জনসন৷ সব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তিনি যে কোনো মূল্যে ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বার করে আনতে বদ্ধপরিকর৷ তাঁর মতে, একমাত্র এভাবেই মানুষের আস্থার ভিত্তিতে গণভোটের রায় কার্যকর করা যাবে৷ কিন্তু তাঁর সেই লক্ষ্যের পথে এখনো অনেক বাধা রয়েছে৷
মাত্র পাঁচ দিনের অধিবেশনে ব্রিটিশ সংসদ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে আইন প্রণয়ন করেছে৷ বরিস জনসন সংসদের সেই আইন মানবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় দূর হচ্ছে না৷ মঙ্গলবার তিনি নতুন ব্রেক্সিট চুক্তির লক্ষ্যে উদ্যোগ আরও জোরদার করার কথা ঘোষণা করেন৷ জনসন সোমবারও আলোচনায় অগ্রগতির দাবি করলেও ইইউ জানিয়েছে, যে ব্রিটিশ সরকার এখনো কোনো স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প পেশ করে নি৷
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার জোটসঙ্গী উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশের ডিইউপি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন৷ আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনের সীমান্তে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার বিকল্প নিয়ে তাঁদের কথা হয়েছে৷ জনসনের পূর্বসূরী টেরেসা মে ও ইইউ-র মধ্যে প্রাথমিক আলোচনায় শুধু উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশকে ইইউ-র সাধারণ বাজারে রেখে দেবার যে প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছিল, তার ভিত্তিতে ইইউ-র সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা অবশ্য দুই পক্ষই উড়িয়ে দিয়েছে৷ ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের মধ্যে কোনো রকম বিভাজন মানতে তারা প্রস্তুত নয়৷
মঙ্গলবার সরকার ও বিরোধী পক্ষের কয়েকজন সংসদ সদস্য মিলে চুক্তির মাধ্যমে ব্রেক্সিট কার্যকর করার এক উদ্যোগ শুরু করেছেন৷ ইইউ-র সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা ব্যর্থ হলে বর্তমান ব্রেক্সিট চুক্তি সংসদে অনুমোদন করা যায় কিনা, সেই বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখছেন৷
প্রশ্ন উঠছে, এই প্রেক্ষাপটে সরকার ও বিরোধী পক্ষের সামনে কোন কোন পথ খোলা রয়েছে? চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে বিরোধীরা আইন প্রণয়ন করলেও সরকার নানাভাবে সেই আইন উপেক্ষা করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ বোঝাপড়া সম্ভব না হলে আগামী ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসন ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করতে বাধ্য হবেন৷ কিন্তু তার পূর্বশর্ত হিসেবে ইইউ নির্দিষ্ট কারণ জানতে চাইবে৷ তা না হলে ইইউ সেই আবেদন নাকচ করতে পারে৷ ব্রিটিশ সরকার এভাবেও ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করার চেষ্টা করতে পারে৷ এছাড়া অন্যান্য পথেও এই আইন উপেক্ষা করার বিষয়ে সরকার ভাবনাচিন্তা করছে৷
সংসদে দু-দুবার আগাম নির্বাচনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও বরিস জনসন হাল ছাড়তে প্রস্তুত নন৷ তিনি ভোটারদের কাছে গিয়ে প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ আচমকা পদত্যাগ করে সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকে নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করতে পারেন তিনি৷ তবে সে ক্ষেত্রে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক জাতীয় ঐক্য সরকার গড়ার চেষ্টা চালাতে পারে৷ ফলে জনসন সেই ঝুঁকি নাও নিতে পারেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, এএফপি, রয়টার্স)