চলতি সপ্তাহে প্রথমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তারপর ব্রিটেন দুই পক্ষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা তুলে ধরেছে৷ ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় শেষ হবার পর ২০২১ সাল থেকে ব্রিটেন ও ইইউ-র মধ্যে বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্পর্ক কী হবে, আগামী সপ্তাহ থেকে সে বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হবে৷ বৃহস্পতিবার লন্ডনে ব্রিটেনের সরকার আলোচনার যে ম্যানডেট প্রকাশ করেছে, তার ফলে সংঘাতের আশঙ্কা আরো জোরালো হলো৷
ব্রেক্সিট পুরোপুরি কার্যকর হবার পরও ব্রিটেন ইইউ-র বিধিনিয়ম মেনে চললে সেই রাষ্ট্রজোটের অভ্যন্তরীণ বাজারে অবাধ প্রবেশের প্রস্তাব দিয়েছে ইইউ৷ ব্রিটেন শুরুতেই সেই প্রস্তাব পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে৷ অর্থাৎ, এমন শর্ত নিয়ে আলোচনা করতেই নারাজ বরিস জনসনের সরকার৷ ইইউ-র সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করতে আগ্রহ দেখালেও তার মৌলিক শর্ত মানতে নারাজ লন্ডন৷ ব্রেক্সিটের পর প্রধানমন্ত্রী জনসন ব্রিটেনের ‘সার্বভৌমত্ব' পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর৷ এমনকি নিজস্ব জলসীমানার মধ্যে মাছ ধরার অধিকার নিয়েও কড়া অবস্থান নিচ্ছে ব্রিটেন৷
ব্রিটেনের এই কড়া অবস্থানের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে৷ এমনকি কোনো চুক্তি ছাড়াই ২০২১ সালে ব্রেক্সিট পুরোপুরি কার্যকর হতে পারে, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছে না ব্রাসেলস৷ সে ক্ষেত্রে ব্রিটেনকে অন্য যে কোনো দেশের মতো শুল্ক দিয়ে ও অন্যান্য নিয়ম মেনে ইইউ-র সঙ্গে বাণিজ্য করতে হবে৷ ইইউ-র বহির্সীমানায় ব্রিটেনের ট্রাক, জাহাজ ইত্যাদি থামিয়ে নথিপত্র পরীক্ষা করা হবে৷ ব্রিটেনে রপ্তানির ক্ষেত্রে ইইউ-কেও সেই একই বাধার সম্মুখীন হতে হবে৷ ক্যানাডা ও ইইউ-র মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তির আদলে ব্রিটেনের সঙ্গে বোঝাপড়া চায় না ব্রাসেলস৷ ভৌগোলিক দূরত্ব ও নিবিড় অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে ইইউ সেই পথে যেতে চায় না৷
ব্রিটেন এরই মধ্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ শুরু করে দিয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইটহাইজার বৃহস্পতিবার লন্ডন সফর করেছেন৷ ব্রিটেনের সরকার তাঁকে জানিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিকে চূড়ান্ত অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে৷
জনসন সরকারের এমন বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে ব্রিটেনের মধ্যেও দুশ্চিন্তা দেখা দিচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এতকাল রপ্তানিবাণিজ্য ও আর্থিক পরিষেবার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর অনেকটা নির্ভরশীল থাকার পর কোনো বোঝাপড়া ছাড়াই আচমকা বিচ্ছেদের পরিণতি মোটেই সুখকর হবে না৷ বিরোধী পক্ষ এ কারণে সরকারের কড়া সমালোচনা করছে৷ বাণিজ্য ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন করলেও ব্রিটেনের মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে তাঁরা সতর্ক করে দিয়েছেন৷ ব্রিটেন ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কাঠামো ত্যাগ করায় এমন আশঙ্কা আরো জোরালো হচ্ছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (এএফপি, এপি)