বৃহস্পতিবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দু-দুটি সাফল্যের স্বাদ পেলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ প্রথমে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ব্রেক্সিট নিয়ে বোঝাপড়া চূড়ান্ত হলো৷ তারপর ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত নেতারা একযোগে সেই চুক্তির প্রতি সমর্থন জানালেন৷ দুই পক্ষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়ে রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রও অনুমোদন করেন তাঁরা৷ জনসন সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অংশ না নিয়ে দেশে ফিরে সংসদে তাঁর ‘নতুন' ব্রেক্সিট চুক্তির পক্ষে সমর্থন আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷ তবে সেই কাজ যে মোটেই সহজ হবে না, বৃহস্পতিবারই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে৷
এই ‘নতুন' ব্রেক্সিট চুক্তির রূপরেখা স্পষ্ট হলেও এর অনেক খুঁটিনাটী বিষয় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে ব্রিটেনের রাজনৈতিক মহল৷ নতুন চুক্তি অনুযায়ী আইরিশ সীমান্তে ‘ব্যাকস্টপ' ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ পড়লেও তার বদলে অত্যন্ত জটিল এক ব্যবস্থা চালু হবে৷ বরিস জনসনের দাবি মেনে উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশকে যুক্তরাজ্যের শুল্ক কাঠামোয় রাখা হলেও সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু নিয়মকানুন বজায় থাকবে৷ বিশেষ করে সেখানে পণ্যের আগমন নিয়ন্ত্রণ করা হবে৷ যে পণ্য শেষ পর্যন্ত ইইউ-তে প্রবেশ করবে, তার উপর শুল্ক বসানো হবে৷ ভ্যাট সংক্রান্ত জটিলতাও দূর করা হয়েছে৷ উত্তর আয়ারল্যান্ডের আঞ্চলিক পার্লামেন্ট প্রতি চার বছর অন্তর এই নিয়ম চালু রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে৷
শুক্র ও শনিবার বরিস জনসনকে নিজের টোরি দল, জোটসঙ্গী উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডিইউপি দল এবং সংসদে বিরোধী পক্ষের কাছ থেকে এই চুক্তির প্রতি সমর্থনের চেষ্টা চালাতে হবে৷ তিনি এখনো ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর৷ সেই লক্ষ্যে শনিবারই সংসদে এই চুক্তি অনুমোদন করাতে চান তিনি৷ কিন্তু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং দলের মধ্যে আবার বিদ্রোহের আশঙ্কার ফলে তাঁকে বিরোধী ও বিদ্রোহী পক্ষের সমর্থনের প্রয়োজন হবে৷ এখনো পর্যন্ত জোটসঙ্গী ডিইউপি, বিরোধী লেবার পার্টি ও উদারপন্থি দল এই চুক্তির বিরোধিতা করছে৷ বরিস জনসন সংসদে যথেষ্ট সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হলে আবার নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে৷ সংসদের বিতর্কে আগাম নির্বাচন বা গণভোটের দাবি যুক্ত হলে ব্রেক্সিটে বিলম্ব বা ব্রেক্সিট বাতিল হয়ে যাবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
এই চুক্তির আরেকটি দিকও ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷ পূর্বসূরি টেরেসা মে-র প্রথম ব্রেক্সিট চুক্তির খসড়ায় ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের উল্লেখ ছিল৷ জনসনের চুক্তি কার্যকর হলে দুই পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যের পথে অনেক বেশি বাধা থাকবে৷ ফলে ব্রিটিশ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, ডিপিএ)