ব্রেক্সিটকে ঘিরে অচলাবস্থা কাটার কোনো আশার আলো দেখছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এক ভাষণে ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ-ক্লোদ ইয়ুংকার এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন৷ সোমবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, বোঝাপড়ার জন্য হাতে বেশি সময় নেই৷ তাই চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের ঝুঁকি অত্যন্ত বাস্তব৷ তবে ব্রাসেলস এমন পরিস্থিতি এড়াতে যাবতীয় চেষ্টা করবে, বলেন ইয়ুংকার৷ তবে সাফল্যের আশা কম বলে তিনি মনে করেন৷ জনসনের সঙ্গে সংলাপের প্রসঙ্গে ইয়ুংকার বলেন, আইরিশ সীমান্তে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার সঙ্গে তাঁর কোনো আবেগের সম্পর্ক নেই৷ কিন্তু সেই ব্যবস্থার আসল লক্ষ্য পূরণের প্রশ্নে তিনি গভীরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছেন৷ তিনি আবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্পষ্ট, কার্যকর ও লিখিত বিকল্প প্রস্তাব পেশ করার ডাক দেন৷
ব্যাকস্টপ বা তার গ্রহণযোগ্য বিকল্প ছাড়া কোনো ব্রেক্সিট চুক্তি যাতে সম্ভব না হয়, সেই লক্ষ্যে বুধবার ইইউ পার্লামেন্ট এক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে৷ ইইউ-র প্রধান ব্রেক্সিট মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন৷ ইইউ পার্লামেন্টে ব্রিটেনের ব্রেক্সিটপন্থি সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা বলতে চান না বটে, কিন্তু এর পরিণতি আরও অনেক বেশি গুরুতর ও সংখ্যায় আরও হতে চলেছে৷'' সেইসঙ্গে আলোচনার ভান না করে দৃঢ়তার সঙ্গে আন্তরিকভাবে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবার ডাক দেন বার্নিয়ে৷
জনসন বার বার বিকল্পের ক্ষেত্রে অগ্রগতির কথা বললেও এখনো পর্যন্ত ব্রাসেলসে কোনো প্রস্তাব পেশ করেন নি৷ তবে জার্মানির ‘স্যুডডয়চে সাইটুং' সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার গোপনে এক সমাধানসূত্র প্রস্তুত করেছে৷ এর আওতায় ব্রেক্সিটের পরেও শুধু উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশে ইইউ-র অনেক নিয়ম কার্যকর থাকবে৷ গোটা আয়ারল্যান্ড দ্বীপের জন্য এক অর্থনৈতিক এলাকার ব্যবস্থা করে আইরিশ সীমান্তে অচলাবস্থা এড়ানো সম্ভব হবে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে কৌশলগত কারণে জনসনের পক্ষে সেই প্রস্তাব প্রকাশ্যে পেশ করা সম্ভব নয়, কারণ সে ক্ষেত্রে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিরা প্রবল বিরোধিতা শুরু করতে পারে৷ ১০ দিন পর টোরি দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে৷ তার আগে এই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না প্রধানমন্ত্রী৷ সরকারের জোটসঙ্গী উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডিইউপি দলও প্রবল আপত্তি জানাতে পারে৷
ডিইউপি দলের নেতা আর্লেন ফস্টার বুধবার আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন সফর করেন৷ তিনি বলেন, সমাধানসূত্র পেতে হলে দুই পক্ষকেই নমনীয় হতে হবে৷ উত্তর আয়ারল্যান্ডে শান্তি ফেরাতে ১৯৯৮ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটির মধ্যেও প্রয়োজনীয় রদবদল করতে হবে৷ ইউরোপীয় একক বাজার অটুট রাখতে ফস্টার এমনকি শুধু উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশের জন্য আলাদা সমাধানসূত্রের প্রস্তাব উড়িয়ে দেন নি৷ তবে ব্রিটেনের নিজস্ব একক বাজার অটুট রাখার অঙ্গীকার করেন তিনি৷ ফস্টার আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকারের সঙ্গেও আলোচনা করেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স, এএফপি)