দেশের চলমান সংকট নিরসনে সংলাপের সময় শেষ হয়ে যায়নি, বলে মনে করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার৷ আর সুশীল সমাজ মনে করে দেরি হলেও যেন সংলাপ হয়, হয় রাজনৈতিক সমঝোতা৷
বিজ্ঞাপন
তাঁদের মতে দেশকে চরম সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র সংলাপ৷ তাতে হয়তো রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারে৷ নয়তো দেশ চরম ক্ষতির মুখে পড়বে৷ গণতন্ত্র পথ হারাতে পারে৷
বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি এখন যেন চূড়ান্ত সংঘাতের অপেক্ষায়৷ একদল নির্বাচন এবং আরেকদল নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য যেন এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ একদিকে দেশ অচল করার হুমকি৷ আর আরেক দিকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি৷ এতে সাধারণ মানুষ এখন চরম উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন৷
চলতি মাসের গত সপ্তাহটি বাদ দিলে বাকি সপ্তাহগুলো কেটেছে বিরোধী দলের হরতালের মধ্যে৷ আগুনে যানবাহন পুড়েছে, পুড়েছে মানুষ৷ এর মধ্যেই গঠিত হয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার৷ কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ হরতাল অবরোধ যেমন চায় না তেমনি চায় না একতরফা নির্বাচন৷ তারা চায় সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন৷ আর সেখানে তারা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনি উৎসব নেই আছে সংঘাতের আশঙ্কা৷ আছে আরো গভীর সংকটের অশুভ ইঙ্গিত৷ যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষের ওপর৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আলি আহমেদ যেমন তার ব্যবসা আর আয় রোজগার নিয়ে শঙ্কিত৷ তেমনি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন উৎপাদন এবং রপ্তানি নিয়ে শঙ্কিত৷ আর এই দু'জনই আশা করেন সংঘাতের পথে না গিয়ে দেশের বড় দু'টি রাজনৈতিক দল যেন সমঝোতার পথে যায়৷ তাঁরা যেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে৷ কোনো দলই যেন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ না খোঁজে৷
এই শঙ্কার বাইরে নেই জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরীও৷ তাই তিনি শনিবার বিকেলে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তাঁর আশা শেষ পর্যন্ত সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ তিনি বলেন সংলাপের সম্ভাবনা এখনো আছে, শেষ হয়ে যায়নি৷ একটি সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারে৷ তবে তিনি মনে করেন সংলাপ শর্তহীন এবং উন্মুক্ত হওয়া প্রয়োজন৷
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, শুধু তাঁর নয় পুরো জাতির প্রত্যাশা এখন সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতা৷ কারণ সমঝোতা না হলে দেশ ও দেশের মানুষ চরম ক্ষতির মুখে পড়বে৷ আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পথ হারাতে পারে৷ তিনি মনে করেন দেরি হয়েছে, তবে সময় চলে যায়নি৷ তাই সংলাপের মাধ্যমেই সমাধান খোঁজা উচিত৷ সমঝোতা হলে আর কোনো সমস্যাই সমস্যা থাকবে না৷ গণতন্ত্র রক্ষা পাবে, রক্ষা পাবে দেশ৷ নয়তো এখন যে সংকট আমরা দেখছি তার আরো নানা ধরণের প্রকাশ ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷