সম্প্রতি হাইকোর্ট চেকের মামলায় কারাগারে পাঠানো সংবিধান পরিপন্থী বলেছেন৷ আইনটি পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদকে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন৷

মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছেন চেম্বার জজ৷ ১৪ নভেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে মামলাটি পাঠানোর আদেশ দেয়া হয়েছে৷ মামলাটি তাই এখনো চলমান৷ কিন্তু হাইকোর্টের এই রায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে৷ এই নিয়ে আইনজীবীরা পক্ষে বিপক্ষে কথা বলছেন৷

সাধারণভাবে চেক দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করার একটি চক্র বাংলাদেশে সক্রিয় আছে৷ বিভিন্ন খাতে পাওনা টাকা, বেতন, পেমেন্ট, সম্মানির বিপরীতে ব্যাংক চেক দেয়ার পর দেখা যায় ওই একাউন্টে টাকাই নেই৷ প্রচলিত আইনটি ওই ধরনের ঘটনার প্রতিকার পেতে বেশ কাজে দেয়৷ কিন্তু উল্টো ঘটনাও আছে৷ একজনের কাছ থেকে চেক নিয়েও তাকে প্রতারণা ও হয়রানির শিকার করা যায় এই আইনে৷ এটা ব্যবসায়িক লেনদেনে ব্যাংক চেকের ক্ষেত্রে বেশি হয়৷ কেউ একজন অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংক চেক দিলেন৷ তখন ওই ব্যক্তি যত টাকা পান তার চেয়ে বেশি চেকে লিখে নিল৷ তারপর চেক ডিজঅনার করিয়ে আদালতে মামলা করে দেয়৷ আবার দুই ব্যক্তি একটি কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন৷ একটি নির্দিষ্ট সময় কাজটি করে দেয়ার বিনিময়ে প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তিকে আগাম চেক দিলেন৷ দ্বিতীয় ব্যক্তি কাজটি করেননি বা নির্ধারিত সময়ে করেননি৷ স্বাভাবিক কারণেই প্রথম ব্যক্তি চেকটি ক্যাশ না করার জন্য ব্যাংককে অ্যাডভাইস করবেন৷ কিন্তু তারপরও ওই চেকটি তিনি ডিজঅনার করিয়ে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন৷
চেক ডিজঅনার কয়েকভাবে হতে পারে৷ ১. চেকের সমপরিমাণ টাকা একাউন্টে না থাকা বা কম থাকলে৷ ২. চেক ক্যাশ না করার জন্য চেক দাতার অ্যাডভাইস ৩. চেকের স্বাক্ষর না মেলা ৪. চেকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে৷ এখানে বলে রাখা ভালো একটি চেকের মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ ৬ মাস৷

চেক ডিজঅনার মামলায় শাস্তি হলো এক বছর মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিন গুণ পরিমাণ অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে৷ আর এই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে জরিমানার অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে আপিল করতে হবে৷ এই মামলাটি জামিন অযোগ্য৷

গত ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ একটি মামলা রায়ে চেক ডিজঅনারের মামলায় কাউকে জেলে পাঠানোকে সংবিধান পরিপন্থী বলেন৷ আদালতের অভিমত, এটা সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন৷ আদালত এনআই অ্যাক্টের (নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট ) ১৩৮ ধারা পরিবর্তনের জন্য সংসদকে পরামর্শ দেন৷ ধারাটি সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত আদালত মামলাগুলো নিস্পত্তির একটি গাউড লাইন পূর্নাঙ্গ রায়ে দেয়ার কথা বলেন৷

১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট সংশোধন করে কারাদণ্ডের বিধান করা হয়৷ চেক একটি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট৷

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক বলেন,  ‘‘এই আইনটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা করে দিয়েছে৷ তারা ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ ছাড়াও অনেকগুলো ব্যাংক চেকে স্বাক্ষর নিয়ে রাখেন৷ পরে লোন পরিশোধে ব্যর্থ হলে চেকে তাদের ইচ্ছে মত টাকার অংক বসিয়ে মামলা করে দিতে পারেন৷ আর তখন জেলের ভয়ে ঋণগ্রহীতারা দ্রুত টাকা দিয়ে দেন৷ এতে টাকা আদায় সহজ হয়েছে৷ কিন্তু ব্যাংক চেকে স্বাক্ষর নেয়াটা একটি ভয়ংকর বিষয়৷ এর মাধ্যমে প্রতারণা হতে পারে এবং হচ্ছেও৷ তবে সাধারণ মানুষ চেকের মাধ্যমে তাদের পাওনা টাকায় আদায় এই আইনের কারণে সহজে করতে পারে৷ প্রতারণার সুযোগ কম থাকে৷''

তার কথা, ‘‘ব্যাংক ছাড়াও চেকে ব্যবসায়িক লেনদেনে এই আইনটির অপব্যবহার হচ্ছে৷ তাই আমি মনে করি কারদণ্ডের বিধানটি বাদ দেয়া উচিত৷''

তিনি উদাহারণ দিয়ে বলেন, ‘‘চেকের স্বাক্ষর না মিললেও চেক ডিজঅনার হবে৷ এখন কেউ অন্যের চেক চুরি করে নিজে স্বাক্ষর দিয়ে চেক ডিজ-অনার করিয়েও মামলা করতে পারেন৷’’

তার কথা, ‘‘আমাদের কাছে অনেক মামলা আসে সেগুলো আসলে এই আইনটি ব্যবহার করে হয়রানির মামলা’’

সাবেক বিচারক এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘মূল বিষয় হলো চেকের টাকা পাওয়া নিয়ে৷ আর এটা সিভিল অপরাধ৷ কিন্তু বাংলাদেশে এটা এখন ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে৷ আমাদের দেশে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, যেকোনো অপরাধে জেলে পাঠালেই সমস্যার সমাধান হবে৷ এটা আসলে ঠিক নয়৷ ১৯৯৪ সালে এনআই অ্যাক্ট সংশোধনের আগে কি তাহলে চেক ডিজঅনার হলে প্রতিকার পাওয়া যেত না? আইনে আরো দ্রুত প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে৷ আর এখন কমপক্ষে দুই বছর লাগে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘১৮৬১ সাল থেকেই আইন আছে৷ সিপিসির অর্ডার ৩৭ রুল-২ আছে৷ তাতে ডিজঅনার হওয়া চেকের টাকা উদ্ধারে সর্বোচ্চ দুই মাস লাগে৷ কারণ সিভিল মামলা করার ১৪ দিনের মধ্যেই সমন এবং শুনানি বাধ্যতামূলক৷ আদালত বিবাদীর উত্তরে সন্তুষ্ট না হলে ওই তারিখেই ডিক্রি দেবেন৷’’

সাধারণ মানুষ তো এই চেক নিয়ে প্রতারণার শিকারও হয়৷ তারা টাকা পায় না৷ এর জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আগের আইনটি সাধারণ মানুষ তেমন জানেন না৷ তাই প্রতিকার পান না৷ এই আইনে মামলা করে আমি বার বার পক্ষে রায় পেয়েছি৷’’

এই দুই আইনজীবীর কথা, ‘‘একই সঙ্গে কারাদণ্ড এবং চেকের তিনগুণ পরিমাণ টাকা আসলে ন্যায় বলে মনে হয় না৷ এর ফলে চেক নিয়ে হয়রানি আরো বেড়েছে৷ এমনকি জোর করে চেকে সই নেয়ার প্রবণতাও বেড়েছে৷’’

আজিজুর রহমান দুলু একটি মামলার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় স্ত্রী তার স্বামীর চেক গোপনে নিয়ে তাতে টাকার অংক বসিয়ে নিজে স্বাক্ষর করে ব্যাংকে জমা দিয়েছে৷ স্বাক্ষর না মেলায় চেক ডিজঅনার হয়েছে৷ তিনি মামলা করেছেন চেক ডিজঅনারের৷’’