চোপড়ায় যুগল নিগ্রহে গ্রেপ্তারি বেড়ে চার
৪ জুলাই ২০২৪উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় এক যুগলকে হেনস্থার ছবি ভাইরাল হয়। সেখানে তাদের ব্যাপক মারধর করতে দেখা যায় তাজিমুল ইসলাম ওরফে জেসিবিকে। এবার জালে তারই এক ঘনিষ্ঠ।
জেসিবি সঙ্গী ধৃত
চোপড়ার বিধায়ক হামিদুল রহমানের ঘনিষ্ঠ তাজিমুল এলাকায় সমান্তরাল প্রশাসন চালায়। নানা কারণে গ্রামে সালিশি সভা বসায় সে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার বিভিন্ন কাণ্ডকারখানা সামনে আসছে।
জেসিবির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলির মধ্যে অন্যতম, জমি দখল করা, বিভিন্ন অজুহাতে টাকা আদায় ও শারীরিক নিগ্রহ। এসব কাজে জেসিবির একটি দল সিদ্ধহস্ত বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। সেই দলের অন্যতম সদস্য আমিরুল ইসলাম ওরফে বুধাকে মারধরের ঘটনায় পুলিশ পাকড়াও করেছে।
মঙ্গলবার গভীর রাতে বুধাকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চোপড়ার লক্ষীপুর এলাকার নাককাটা গ্রামে তার বাড়ি। রাত প্রায় তিনটের সময় পুলিশ অভিযান চালায় এই গ্রামে।
পুলিশি হেফাজতে রয়েছে জেসিবি। তাকে জেরা করে আমিরুলের নাম উঠে আসে।
ধৃতকে বুধবার ইসলামপুরের দায়রা আদালতে পেশ করা হলে বিচারক তাকে পাঁচ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছেন। যদিও ধৃতের স্ত্রী অস্বীকার করেছেন, কোনা অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে তার স্বামীর যোগ আছে।
বুধার স্ত্রী বেলি বেগম বলেন, "আমার স্বামী জমিতে চাষ করে, চা পাতা তোলে। কোনোরকমে সংসার চলে আমাদের। ও কাউকে মারধর করেনি।" জমি গ্রাস থেকে লুটপাট, এসব কাজে আমিরুলের যোগ থাকার কথা খারিজ করেছেন তার স্ত্রী।
বৃহস্পতিবার পুলিশ আরো দু'জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এই ঘটনায় এ নিয়ে মোট গ্রেপ্তারির সংখ্যা চার।
আতঙ্কিত যুগল
চোপড়া এলাকায় জেসিবি ও তার দলবলের কতটা দাপট তা বোঝা যাচ্ছে যুগলের প্রতিক্রিয়ায়। তারা এখনো মারধরের ঘটনা নিয়ে কিছু বলতে তৈরি নন। দিগলগাঁও গ্রামের বাসিন্দা তরুণ তরুণী এমনও বলছেন, এ বিষয়ে তাদের অভিযোগ নেই!
সালিশি সভার নামে এমন নির্যাতনের আরও একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। এই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, জেসিবি তার বাড়িতে এক যুগলকে মারধর করছে। এই যুগলের বাড়ি ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় বলে সূত্রের খবর।
অভিযোগ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের খবর পেলে নীতিপুলিশি চালায় জেসিবির সঙ্গীরা। জরিমানা ধার্য করে বিপুল টাকা। সেই টাকা দিতে না পারলে জোটে মারধর। এই অনাচারের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জানানোর সাহস নেই গ্রামবাসীর।
তবে দ্বিতীয় ভিডিওর ক্ষেত্রে আক্রান্ত তরুণ অভিযোগ জানিয়েছেন। পুলিশের কাছে ভিডিওসহ অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও কোন ভিডিওর সত্যাসত্য ডিডব্লিউ খতিয়ে দেখেনি।
বৃহস্পতিবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল চোপড়া পরিদর্শন করেছে। সেখানে তারা আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলে।
হামিদুলের ভূমিকা
চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমান এই এলাকার দাপুটে নেতা। বছরের পর বছর হামিদুল এখানকার শেষ কথা। তাজিমুল ওরফে জেসিবি এই বিধায়কের ঘনিষ্ঠ বলে সূত্রের খবর।
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব হামিদুলের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ। তাকে শোকজ করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে হামিদুলকে তিরস্কার করেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন, এমন সালিশি সভা যেন আর না বসে। কোনো সমস্যা হলে পুলিশ প্রশাসন সেটা দেখবে।
বুধবার বিধানসভায় এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নবানের মুখে পড়েন হামিদুল। সেখানেও তাকে বলতে শোনা যায়, আক্রান্ত নারী দোষ করেছিলেন। প্রশ্নের মুখে মেজাজ হারান বিধায়ক। চলে যান বিধানসভা চত্বর ছেড়ে।
তাজিমুলকে তৃণমূল কর্মী হিসেবে স্বীকারও করে নিয়েছেন বিধায়ক। যদিও তিনি যুগলকে মারধরের ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেননি। বরং তার মতে, গ্রামবাসীরা মারধর করে 'একটু ভুল' করে ফেলেছে। হামিদুলের এই মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
হামিদুলের মন্তব্যের পর প্রশ্ন উঠেছে, বিধায়কের প্রচ্ছন্ন মদতেই কি সেখানে সালিশি সভা বসে? সেখানে জেসিবির মতো বিধায়ক ঘনিষ্ঠরা জরিমানা ধার্য করা থেকে মারধর, সব ধরনের কুকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল বছরের পর বছর?
কোথায় পুলিশ প্রশাসন
চোপড়ার ঘটনার সঙ্গে অনেকে সন্দেশখালিকে একই বন্ধনীতে রাখতে চাইছেন। সুন্দরবন লাগোয়া ওই এলাকায় দাপটে তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখ ও তার দলবলের বিরুদ্ধে জমি দখল, তোলাবাজি, শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছে।
কার্যত বিরোধীশূন্য এলাকায় শাসকের একচেটিয়া রাজত্ব পুলিশ প্রশাসনকে কব্জা করে ফেলে বলে পর্যবেক্ষকদের মত। এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফল দেখলেই বোঝা যাবে, চোপড়ায় তৃণমূলের দাপট কতটা প্রশ্নাতীত। চোপড়া বিধানসভা দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের অধীন। এই বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী ৯২ হাজারের বেশি ভোটে বিজেপির থেকে এগিয়েছিলেন।
প্রায় বিরোধীশূন্য চোপড়ায় প্রতিবাদের পরিসর নেই বলেই বিরোধীদের দাবি। বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "কোনো কোনো এলাকায় বাংলার জনবিন্যাস পরিবর্তন করার চক্রান্ত চলছে। সন্দেশখালি বা চোপড়া, সেই মানচিত্রের মধ্যে পড়ে। এখানে পুলিশ-প্রশাসন নেই, শুধু তৃণমূলের তোষণের রাজনীতি চলে।"
তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেনের বক্তব্য, "ভিডিও সামনে আসার পরপরই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্থানীয় বিধায়ককে শোকজ করা হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন কাজ না করলে এটা হত না।"
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ-প্রশাসন তৎপর হলে এভাবে সালিশি সভা বসে কী করে? ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগে কেন পুলিশ এই নির্যাতনের কথা জানতে পারল না? হামিদুলের কাজকর্ম সম্পর্কে কি তৃণমূল নেতৃত্বের কাছেও খবর ছিল না?
জনমানসে প্রতিক্রিয়া
চোপড়ায় গোপনে কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রকাশ্য সালিশি সভায় তরুণ-তরুণীকে মারধর করা হয়েছে। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, চেয়ার পেতে কয়েকজন বসে রয়েছেন। তাদের ঘিরে বৃত্তাকারে বহু গ্রামবাসী। তারা পুরো ঘটনার নীরব দর্শক।
এমন একচেটিয়া রাজত্বে জনতার নির্বিকার থাকার পিছনে ভয় কাজ করেছে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। বছরের পর বছর সালিশি সভাকে সাধারণ আইন বলে মেনে নেয়ার অভ্যেস তৈরি হয়েছে।
চিত্রশিল্পী সমীর আইচ বলেন, "সাধারণ মানুষ কোণঠাসা হয়ে গিয়েছে। প্রতিক্রিয়া দেয়া দূরের কথা, তারা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। গোটা দেশেই একই অবস্থা, পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই। চোপড়ায় বিধায়ক ঘনিষ্ঠ যখন দুজনকে মারছে, তখন সাধারণ মানুষের কিছু বলার থাকে না। এ কাজের প্রশংসা না করলে তাদের উপর কোপ আসতে পারে। এসবের পর বুদ্ধিজীবীরা নীরব থাকেন দেখে আমার অবাক লাগে। বাঙালি নিজেকে অবক্ষয়ের শেষ মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। "
সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ডিডব্লিউকে বলেন, "এখন আমাদের দেশ যেমনটা হয়েছে, তেমন দেশের কথা আমরা ভাবিনি। যেখানে কুসংস্কার রয়েছে, রয়েছে প্রগতিশীলতার অভাব। স্কুলে ডিম খেতে দেয় বলে নিরামিষাশীরা বাচ্চাদের পড়তে পাঠাচ্ছে না। বাবার আশীর্বাদ নিতে গিয়ে কত মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু চুরি নয়, সব ধরনের অনৈতিক কাজকে মানুষ পাত্তা দিচ্ছে, মেনেও নিচ্ছে। এখান থেকে কীভাবে পরিত্রাণ হবে, আমরা সেই পরিত্রাণ দেখে যেতে পারব কি না, বলতে পারব না।"