চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে বিশাল লজ্জা দিল সাউথ আফ্রিকা
২১ অক্টোবর ২০২৩ইনিংস বিরতিতে প্রোটিয়াদের দেয়া ৪০০ রানের লক্ষ্যকেও অসম্ভব মনে হয়নি ইংলিশদের জন্য৷ অথচ দলটির ব্যাটিং পারফরম্যান্সে হতাশার সাগর তৈরি হল৷ পাহাড় চড়তে গিয়ে গোড়াতেই থামল তারা৷ সাউথ আফ্রিকার ৭ উইকেটে ৩৯৯ রানের জবাবে মাত্র ২২ ওভারে ১৭০ রানে গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড৷ থ্রি লায়নদের এই সংগ্রহের জন্য অভিষিক্ত গাস অ্যাটকিনসন (৩৫) ও মার্ক উডকে (৪৩) মাথায় তুলে রাখতে হবে৷ নবম উইকেটে দুজনের ৭০ রানের জুটি না থাকলে হারের ব্যাবধান ২২৯ রানের চেয়ে আরও অনেক বেশি হতো৷
১৯৭৫ বিশ্বকাপের ম্যাচটি ফিরে এল এদিন, মাত্র ১১.৩ ওভারের সময়৷ দলীয় ৬৮ রানে হ্যারি ব্রুক যখন ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে আউট হলেন ইতিহাস খুঁজতেই হলো - বিশ্বকাপে শেষবার কবে কত কম রানে অলআউট হয়েছিল ইংলিশরা৷ পরিসংখ্যান জানাল প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৯৩ রানে অলআউট হয় তারা৷ ৬৮ রানে ব্রুকের ফেরা সেই দুরত্ব অতিক্রমে ব্যর্থ হওয়ার ভয় ধরিয়ে দেয় ইংলিশদের মনে৷ অবশ্য দিন শেষে এই লজ্জায় পড়তে হয়নি৷ বোলারদের ব্যাটে ইংলিশদের মুখরক্ষা হয়৷ ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বনিন্ম ৮৬, বিশ্বকাপে নিজেদের সর্বনিন্ম ৯৩ আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিশ্বকাপে সর্বনিন্ম ১০৩ রানে অলআউট হওয়া থেকে বেঁচেছে তারা৷
অথচ টপঅর্ডারদের ব্যর্থতায় কি করুণ অবস্থা ছিল দলটির৷ গুচ্ছ আকারে উইকেট হারিয়েছে ইংল্যান্ড৷ জনি বেয়ারস্টোকে (১০) দিয়ে দলীয় ১৮ রানে শুরু হয় পতন৷ ২৩ রানে জো রুট (৬), ২৪ রানে ডাভিড মালান (২)৷ ঠিক ওই সময় বেন স্টোকসের ক্রিজে আসা ইংল্যান্ডকে বুক ভরা আশা দেয়৷
তার ব্যাটেই তো ২০১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল দলটি৷ আবার হেডিংলিতে অ্যাশেজের সেই রূপকথার নায়কও তিনি৷ অথচ আশার বেলুন ফুটিয়ে স্টোকস (৫) দলীয় ৩৮ রানে ফেরেন৷ তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়া ব্যাটিং লাইনের ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে ওঠার প্রত্যয় নিয়েছিলেন অধিনায়ক জস বাটলার (১৫) ও হ্যারি ব্রুক (১৭)৷ কিন্তু দলীয় ৬৭ ও ৬৮ রানে দুজনের বিদায় ইংল্যান্ডের সব আশাই শেষ করে দেয়৷
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ইংলিশরা তখন হারের ব্যাবধান কমাতে মগ্ন৷ বোলাররা তাই বিধ্বংসী রূপ নিলেন৷ যে যেভাবে পারেন ব্যাট চালিয়ে রান তুলেছেন৷ ডেভিড উইলি ১২ বলে ১২, আদিল রশিদ ১৪ বলে ১০৷ তাদেরও ছাড়িয়ে গেছেন উড ও অ্যাটকিনসন৷ ৫ ছক্কায় মাত্র ১৭ বলে ৪৩ রানে অপরাজিত ছিলেন উড৷ আর ২১ বলে ৭ চারে ৩৫ রান করে শেষ ব্যাটার হিসেবে বোল্ড হন অ্যাটকিনসন৷ মাত্র ৩২ বলে এ দুজনের ৭০ রানের জুটিটিও ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ৷ প্রোটিয়াদের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন জেরাল্ড কোয়েতজে৷ ২টি করে উইকেট নেন লুঙ্গি এনগিডি ও মার্কো ইয়ানসেন৷
দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে এর আগে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে মাত্র ১০৩ রানে অলআউট হয়ে ১২২ রানে হেরেছিল ইংল্যান্ড৷ এই হার একই প্রতিপক্ষের কাছে সবচেয়ে বড়৷ এছাড়া ওয়ানডেতে রানের দিক থেকে নিজেদের সর্বোচ্চ ব্যাবধানে হারের লজ্জাতেও পড়েছে ইংল্যান্ড৷ ওয়ানডেতে রানের দিক থেকে দলটির সবচেয়ে বড় হার আসে গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২২১ রানে৷ এই ফরম্যাটে ইংল্যান্ডের সর্বনিন্ম রান ২০০১ এ ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সর্বনিন্ম ৮৬৷
এর আগে ম্যাচটি ছিল দক্ষিন আফ্রিকানদের৷ মুম্বাইতে মাঠে পরে ব্যাট করে ৭০ ভাগ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড আছে দলগুলোর৷ এই পরিসংখ্যানে চোখ রেখেই টস জিতে বোলিং নিয়েছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক জস বাটলার৷ চোখ রাখা সেই পরিসংখ্যানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল ৭ উইকেটে ৩৯৯ রান বোর্ডে তুলে৷ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যা সর্বোচ্চ৷ এক বিশ্বকাপে দুইবার চারশো ছাড়ানো স্কোরের চেয়ে মাত্র এক রান দূরে থেমেছে প্রোটিয়ারা৷ ওয়াংখেড়ের সর্বোচ্চ ৪ উইকেটে ৪৩৮ রানের রেকর্ডটিও তাদের৷
দক্ষিণ আফ্রিকার এই রান উৎসবের নায়ক হেনরিখ ক্লাসেন ও মার্কো ইয়ানসেন৷ বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮৩ বলে ১৭৪ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংস খেলেছিলেন ক্লাসেন৷ সেই রূপে আবারও ফিরে ক্যারিয়ারে চতুর্থ সেঞ্চুরি তুলেছেন এ ব্যাটার৷ ১২ চার ও ৪ ছক্কায় করেছেন ৬৭ বলে ১০৯৷ তীব্র গরমের সঙ্গে লড়াই করে দলকে স্বস্তির স্কোর এনে দিতে তার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছেন মার্কো ইয়ানসেন৷ ক্যারিয়ারে প্রথম ওয়ানডে ফিফটি তুলে এই বোলিং অলরাউন্ডার অপরাজিত ছিলেন ৪২ বলে ৬ ছক্কা ও ৩ চারে ৭৫ রানে৷ ষষ্ঠ উইকেটে মাত্র ৭৭ বলে ১৫১ রানের জুটি তাদের৷
বোলিং ইনিংসের শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকার খুশি হওয়ার কারণ ছিল৷ প্রথম বলে চার মেরে মুডে থাকার ঘোষনা দিয়েছিলেন কুইন্টন ডি কক৷ কোন মুড? এই আসরের প্রথম দুই ম্যাচে নিজের দুই সেঞ্চুরি করার মুড৷ অথচ রিসি টপলির পরের বলটিতেই ছন্দপতন! অফস্ট্যাম্পের একটু বাইরের বলে ড্রাইভের ফাঁদে পরে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন ডি কক৷ আম্পায়ার শুরুতে আউট না দিলেও ইংল্যান্ড রিভিউ নিয়ে সফল৷ মাত্র দুই বলে ১ চারে এই বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের দুই ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ানকে ফেরানোর আনন্দ তাদের৷
এ আনন্দ বেশিক্ষণ টেকেনি৷ ব্রেক থ্রু এনে দেয়া টপলি বোলিং হাতের (বাম হাত) আঙ্গুলের ইনজুরিতে মাঠ ত্যাগ করার সঙ্গে ইংল্যান্ডের শুরুর ভাগ্যটাও নিয়ে যান৷ প্রোটিয়াদের নিয়মিত অধিনায়ক টেম্বা বাভুমার অসুস্থতায় একাদশে সুযোগ পাওয়া রেজা হেনড্রিকসের সঙ্গে যোগ দেন রাসি ফন ডার ডুসেন৷ তাদের চোখ জুড়ানো ব্যাটিংয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে যেতে থাকে ইংল্যান্ড৷ খুব দ্রুত ডুসেন নিজের ১৪তম ও রেজা তুলে নেন সপ্তম আন্তর্জাতিক ফিফটি৷ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকা এই জুটি থামান আদিল রশিদ৷ তার বলে স্পিনের বিপরীতে স্লগ সুইপ খেলতে গিয়ে আকাশে বল তুলে দেন ডুসেন৷ ৬১ বলে ৬০ রানের ইনিংস থামে তার৷ সঙ্গে থামে ১১৬ বলে ১২১ রানের জুটি৷
জুটি ভাঙ্গার পর প্রোটিয়াদের রানের গতিও পড়ে যায়৷ তবুও ম্যাচের মাত্র ঘন্টা খানেক আগে একাদশে ডাক পাওয়া রেজা নিজের মতো খেলছিলেন৷ রুটকে ওভারে দুই ছক্কা মেরে দ্রুত পৌছে যান ৮০তে৷ কিন্তু রশিদের গুগলি বুঝতে ভুল করলেন৷ পয়েন্টে সিঙ্গেল নেয়ার চেষ্টা করা রেজার ব্যাটে লেগেই বল গিয়ে আঘাত করে স্ট্যাম্পে৷ ৭৫ বলে ৯ চার ও ৩ ছক্কার দারুন ইনিংসটি থামে ৮৫তে৷
রেজাকে ফিরিয়ে ম্যাচেও ফেরে ইংল্যান্ড৷ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ৪৯ বলে সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপে দ্রুততম শতকের রেকর্ড গড়া এইডেন মার্করাম তখন ক্রিজে৷ তবুও পরের ১০ ওভারে আসে মাত্র ৬৯৷ সেই সঙ্গে ৩৫ তম ওভারে প্রাথমিক সুশ্রুষা শেষে মাঠে ফেরা টপলির সঙ্গে ভাগ্যও ফিরে পায় ইংল্যান্ড৷ ফের বল হাতে নিয়ে প্রথম ওভারেই মার্করামকে ফেরান ৪৪ বলে ৪২ রান ডিপ মিডউইকেটে বেয়ারস্টোর ক্যাচ বানিয়ে৷ নিজের পরের ওভারেই মিডঅফে স্টোকসের ক্যাচে অপর ভয়ঙ্কর ব্যাটার ডেভিড মিলারকে ফেরান মাত্র ৫ রানে৷ দুই ওভারে দুই উইকেট টপলির৷ তার কাঁধে চড়ে ইংল্যান্ডের ভাগ্য ফেরাই বলতে হয়৷
অবশ্য আরেকপ্রস্থ বাঁকবদল তখনও বাকি৷ বোলিং অলরাউন্ডার ইয়ানসেনকে নিয়ে সেই বাঁকবদল উপহার দেন ক্লাসেন৷ ক্রিজে সেট হতে শুরুর কয়েক ওভার কাজে লাগান তারা৷ এরপর ৪০ ওভারের পর থেকে হাত খুলে দলকে বিশাল স্কোর এনে দেন দুজন৷ ইংলিশ বোলারদের হতাশার দিনে টপলি ৮৮ রানে ৩ ও রশিদ ৬১ রানে ২ উইকেট নেন৷
আগের ম্যাচেই দুই দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গে নিজ নিজ ম্যাচ হারের ধাক্কা জুটেছিল দুই দলের৷ওই অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের৷ দক্ষিণ আফ্রিকা সেই চ্যালেঞ্জ দুর্দান্ত ভাবে জিতলেও ইংল্যান্ড আত্মবিশ্বাসের দিক থেকেও আরও বিপদে পড়েছে৷ বিশাল এই হারে দক্ষিণ আফ্রিকার পয়েন্ট ৬ হওয়ার সঙ্গে রান রেটও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.২১৷ ৪ ম্যাচে ৩ জয়ে তিনে আছে প্রোটিয়ারা৷ এদিকে ইংল্যান্ড -১.২৪ রান রেট নিয়ে ৪ ম্যাচে ৩ হারে নেমে গেছে ১০ দলের মধ্যে নয়ে৷