প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসনিজেই বলেছেন, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী ও মিডিয়াতে সংস্কার করার পরেই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে৷ ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে এই সরকার সংস্কার করতে চায় সেটা পরিস্কার হয়ে গেছে৷ এখন তাদের কাজ শুরু করার পালা৷ এখনো কি কোন সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে? যে কাজগুলো হচ্ছে, তাকে কি সংস্কার বলা যাবে?
একজন উপদেষ্টা বলেছেন, এখন ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর করছেন তারা৷ প্রথমেই আসি, প্রধান উপদেষ্টা যে সংস্কারগুলো করতে চেয়েছেন সেই বিষয়ে৷ তিনি নির্বাচন কমিশন সংস্কারের কথা বলেছেন৷ কিন্তু কিভাবে হবে এই সংস্কার? কোনো কাঠামো দাঁড় করাতে হলে সেটা সংসদে পাশ করাতে হবে৷ এখন এই সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো যদি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার অনুমোদন না করে বা সংশোধন করে, তাহলে সংস্কার টিকবে কিভাবে? সংসদে পাশ না হলে তো বৈধতাও মিলবে না৷ দ্বিতীয়ত, তিনি প্রশাসনের সংস্কারের কথা বলেছেন৷ এখন আমরা যেটা দেখছি, আগের সরকারের সময় যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সরিয়ে অপেক্ষাকৃত বঞ্চিতদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে৷ ফলে প্রশাসনে আওয়ামী লীগ সরকারের সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেছে৷ আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে যারা একটু সোচ্চার ছিলেন, তাদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে৷ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বাতিল করা হচ্ছে৷ আবার নতুন কিছু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হচ্ছে৷ সকালে নিয়োগ দিয়ে আবার বিকেলে বাদও দেওয়া হচ্ছে৷
এমন পরিস্থিতিতে কোনো নীতিতে অটল থাকতে পারছে না সরকার৷ যারা যে দাবি নিয়ে আসছে, সরকার সেটাই করছে৷ স্থপতি ও তথ্যচিত্র, নির্মাতা শাকুর মজিদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘একদল ছাত্র এসে বলল এইচএসসি পরীক্ষা দেবো না, আপনি বাতিল করে দিলেন৷ কিছুদিন পর যদি আবার কিছু ছাত্র এসে বলে এখন আর আপনাদের থাকার দরকার নেই, তখন কী করবেন?'' প্রেসক্লাব, সচিবালয়কেন্দ্রিক এলাকা এখন দাবি-দাওয়ার মঞ্চে পরিনত হয়েছে৷ প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত সংগঠন নানা ধরনের দাবি নিয়ে সমাবেশ করছে৷ এবার আসা যাক প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া তৃতীয় বিষয়ে৷ তিনি বিচার বিভাগ সংস্কারের কথা বলেছেন৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ জন বিচারপতির একসঙ্গে পদত্যাগের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি৷ বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থায় যে ‘চিড়' ধরেছিল, সেখানে কিভাবে মানুষের আস্থা ফিরবে? এখনো বিচার অঙ্গনে যা হচ্ছে, তাতে আস্থা ফেরার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ তবে নতুন দায়িত্ব পাওয়া প্রধান বিচারপতি তার সুদক্ষ নেতৃত্বে বিচার অঙ্গন পূর্ণগঠন করবেন বলে সবার আশা৷
বাংলাদেশে এই মুহুর্তে প্রথম যে কাজে হাত দেওয়া দরকার সেটা আইন -শৃঙ্খলা৷ যেটা প্রধান উপদেষ্টা তার সংস্কারের তালিকায় চার নম্বরে রেখেছেন৷ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতেই হবে৷ থানাগুলোতে কার্যক্রম শুরু হলেও রাস্তায় আইন-শৃঙ্খলার কাজে, অর্থাৎ, অপারেশনাল কাজে পুলিশকে এখনও দেখা যাচ্ছে না৷ পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন৷ উর্ধ্বতন পর্যায়ে কয়েকজনকে অবসর দেওয়া হলেও সাধারণ পুলিশ সদস্যরা কাজে উদ্যম পাচ্ছেন না৷ তাদের মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে৷ আবার সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ছাত্রদের আন্দোলনে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে৷ এখন অধিকাংশই তো পুলিশের গুলিতে আহত বা নিহত হয়েছেন৷ তাহলে যারা মাঠে থেকে গুলি করেছেন, তারা তো চরম আতঙ্কের মধ্যে আছেন- কবে না তারা গ্রেপ্তার হন৷ একজন কনস্টেবল আলাপকালে বলছিলেন, ‘‘ওই আন্দোলনের সময় এমন একজন কনস্টেবলও পাওয়া যাবে না, তিনি গুলি করেননি৷ যারা মাঠে ডিউটিতে ছিলেন, তারা সবাই গুলি করেছেন৷ তাহলে কি সবাইকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠাবেন? আমাদের দোষ কী? অফিসারের নির্দেশ পালন করা আমাদের কর্তৃব্য, না হলে চাকরি থাকবে না৷ এখন নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তো আমরা খুনের আসামি! অথচ বিগত সরকারের সময়ে তো আমরা কোনো সুবিধাভোগী না৷ দিন-রাত আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে৷ কিভাবে এখন আমরা মানুষের সামনে যাবো?’’
আবার আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব মন্ত্রী, এমপি বা অন্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের সবাইকেই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ সাংবাদিক দম্পতি শাকিল-রুপাকেও হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে৷ ফলে পুলিশ এখনো সেই পুরনো ফরম্যাটেই আছে৷ এই বাহিনীকে কিভাবে সংস্কার করা হবে- সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ যারা দায়িত্বে আসছেন, তারাই বা কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন সেটাও দেখার বিষয়৷
প্রধান উপদেষ্টা মিডিয়া সংস্কারের কথা বলেছেন৷ আমরা যেটা দেখছি, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী সাংবাদিকদের হাত থেকে বিএনপিপন্থি সাংবাদিকরা মিডিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিচ্ছেন৷ সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা৷ অনেক মিডিয়া ভোল পাল্টে বিএনপি ও বর্তমান সরকারের তোষামোদিতে নেমেছে৷ বিগত সরকার যেমন আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অনেকগুলো পত্রিকা ও টেলিভিশন বন্ধ করেছিল, বর্তমান সরকারের আমলে ইতিমধ্যে আদালতের নির্দেশে একটি টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে৷ তাহলে কিভাবে হবে মিডিয়ার সংস্কার? অথচ আপনি যত সংস্কারই করেন না কেন, মিডিয়ার সংস্কার ছাড়া কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত টিকবে না৷ সব সাংবাদিক তো বিগত সরকারের তোষামোদি করেনি, তেলবাজি করেনি, সুবিধাও নেয়নি৷ নিয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক৷ তাদের দায় পড়েছে পুরো কমিউনিটির উপর৷ এখান থেকে তোষামদি ছাড়া কি সাংবাদিকতা বাংলাদেশে সম্ভব হবে? ইতিমধ্যে বিএনপির কয়েকজন নেতা ও ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক তো শাসিয়েই দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট গেলে তারা ছাড় দেবে না৷ তাহলে কিভাবে বদলাবে গণমাধ্যম!
বর্তমানে বিভিন্ন শীর্ষ পদগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আমরা দেখছি, এই পরিবর্তনের সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার কাজ যে শুরু হয়েছে, তা কিন্তু নয়৷ ফলে দীর্ঘ আকাঙ্খিত রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর সংস্কারের দাবির সাথে এসব পদত্যাগের সংযোগ কতটা রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়৷ কিন্তু বহু বছর ধরে যেভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কাজ করে আসছে তার বিপরীতে সংস্কারের ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের বাধা আসতে পারে? আর কিভাবেই বা রাষ্ট্র ও প্রশাসন সংস্কারের চ্যালেঞ্জ সামলাবে নতুন সরকার? সেটা বুঝতে হলে আরো অপেক্ষা করতে হবে৷ গত কয়েকদিন বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, নতুন সরকারের সামনে রাষ্ট্র সংস্কারের যে দায়িত্ব পড়েছে তার পরিসর অনেক ব্যাপক৷ এক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত দিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এমন অনেক দিকই রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি আসছে৷ ব্যাংকিং খাতে যেভাবে লুটপাট হয়েছে, যেভাবে টাকা পাচার হয়েছে, সেখানেও তো চ্যালেঞ্জ কম নয়৷ সুশাসন ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটা বড় আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, পুরো ব্যবস্থার খোলনলচে বদলানোর অনেক কিছুই সংবিধানের সাথে যুক্ত৷ আর কাঠামোগত দিক দিয়েও মানুষের আচরণ, রেগুলেশন বা প্রবিধান, নিয়ম-কানুন পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ বিষয়৷ সে সময়টা বেশি লাগলে- তখন মানুষের মধ্যে যেমন অধৈর্যের প্রবণতা তৈরি হতে পারে, একই সাথে রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো থেকেও চাপ তৈরি হতে থাকবে৷ ফলে কম সময়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার একটা চাপ বর্তমান সরকারের থাকবে৷ রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপ মোকাবেলা করা এবং বিভিন্ন মতের মানুষকে একত্র করে সেগুলো সামাল দেওয়াটাও এই চ্যালেঞ্জের আরেকটা অংশ৷ ফলে সরকারকে চ্যালেঞ্জ উৎরাতেও চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে৷