1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চ্যালেঞ্জ প্রচুর, তাও ভারতে গণতন্ত্র যথেষ্ট শক্তিশালী

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও ভারতীয় গণতন্ত্র যাকে বলে স্টিল গোয়িং স্ট্রং৷ তাতে দুর্বলতা আছে ঠিকই, ভালোরও অভাব নেই৷

ভারতের নতুন সংসদ ভবন
স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও ভারতীয় গণতন্ত্র যাকে বলে স্টিল গোয়িং স্ট্রংছবি: India's Press Information Bureau/REUTERS

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, বিশেষ করে ১৯৫০ সালে সংবিধান চালু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলির মিডিয়া, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীদের খুব প্রিয় বিষয় ছিল, ভারতের গণতন্ত্র। তাদের সিংহভাগের রায় ছিল, ভারত নামক এই বিশাল দেশে স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছে বটে, তবে তা বেশিদিন টিকবে না। হয় সেখানে সামরিক শাসন হবে, নাহয় স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কেন? কারণ, ভারতের প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষ অশিক্ষিত, আর ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ গরিব। তারা না বুঝতে পারবে ভোটের মূল্য, না ঠিক করতে পারবে কাকে ভোট দেয়া উচিত।

তা সেই সব বিশেষজ্ঞ পশ্চিমা মিডিয়া, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীদের আশা বা নিরাশায় ছাই ঢেলে দিয়ে, তাদের তথাকথিত যৌক্তিক বিশ্লেষণে জল ঢেলে দিয়ে ভারতীয় ভোটদাতারা প্রমাণ করে দিয়েছেন, তারা গণতন্ত্র বিষয়টা বোঝেন, তারা ভোট দিতে জানেন, তারা এটাও জানেন, কাকে কখন ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে দিতে হবে। হয়ত তাদের পুঁথিপড়া বিদ্যা ছিল না, কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল।

আর স্বৈরাচারী শাসন? ১৯৭৫ থেকে ৭৭ পর্যন্ত তাও দেখেছে ভারতবর্ষ। কিন্তু তারপর প্রথম সুযোগে সেই ভোটদাতারাই স্বৈরাচারী শাসককে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলে শিক্ষা দিয়েছে। সুয়োগ দিয়েছে অন্যদের। তারা যখন সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, তখন তারা ভোট দিয়েই আবার সেই স্বৈরাচারী শাসককে ফিরিয়ে এনেছে, তখন তার মধ্যে আগের সেই প্রবণতা আর দেখা দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গে তারা বামেদের ৩৪ বছর ধরে শাসন করার সুয়োগ দেয়, আর যখন বোঝে, তাদের ক্ষমতা থেকে সরানো দরকার, তখন ঠিক সরিয়ে দেয়। এমন অনেক উদাহরণ ভারতে ছড়িয়ে আছে।

স্বাধীনতার পর ৭৭ বছর কেটে গেছে। ভারতের উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে, অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। সাফল্য ও ব্যর্থতার অনেক কাহিনি রয়েছে। তবে ভারতে এখনো গণতন্ত্র আছে, বহাল তবিয়তেই আছে। আর ভারতকে এখনো পর্যন্ত কোনোদিন সেনাশাসকদের মুখ দেখতে হয়নি।

তবে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা বলছে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের মান কমছে। তার মধ্যে বেনোজল ঢুকছে। বিভিন্ন দেশে অতি-দক্ষিণপন্থিরা জনপ্রিয় হচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ছে ধর্ম, ঢুকে পড়ছে আঞ্চলিকতাবাদ, ক্রমশ অসহিষ্ণুতার ননা রূপ দেখছে গোটা বিশ্ব। বলা ভালো, এই সব বিষয়গুলি এখন কমবেশি সব দেশেই ঢুকে পড়েছে। ভারতও তার বাইরে নয়। বিশেষ করে ভারতে গত বেশ কিছু বছর ধরে রাজনীতির মধ্যে ধর্ম ও আঞ্চলিকতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলির অধঃপতন, রাজনীতির মধ্যে নীতিহীনতা, বিরোধীদের ক্ষমতায় আসতে না দেয়া, জনপ্রতিনিদিদের কেনাবেচা করার অভিযোগ প্রবল হয়েছে।

এমনকী বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন কভার করতে গিয়ে অদ্ভূত কথা শুনেছি, ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, সরকার তো অমুক দল গঠন করবে। খুব সম্প্রতি নীতীশ কুমার আরজেডি ও কংগ্রেসকে ছেড়ে দিয়ে আবার জোট বদল করে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিহারে সরকার গঠন করেছেন। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ও এনসিপি-কে ভেঙে বিজেপি তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেছে। মিডিয়ায় প্রতিদিন হেডিং দেখতে পাচ্ছি, ভোটের আগে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট একের পর এক ধাক্কায় ধরাশায়ী হচ্ছে। এটা কেউ বলছে না, এভাবে দল ভেঙে সরকার গঠন করে, এভাবে রাতারাতি দলবদল করে, জোট বদল করে নীতিহীন রাজনীতি করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের মধ্যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে টাকার ঝনঝনানি বড় বেশি করে কানে লাগছে। তা রাজনীতিও তো সময়ের বাইরে নয়। কোন ক্ষেত্রটায় অর্থের ঝনাৎকার নেই? ব্যবস্থা যাই হোক না কেন, গোটা বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অর্থ, জড়িয়ে গেছে বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা। আগে হয়ত যোগাযোগটা কিছুটা আড়ালে ছিল। এখন তা একেবারে প্রকাশ্যে।

আসলে প্রশ্নটা হলো, রাজনীতির মধ্য়ে নীতিটা ছিল কবে? এ সবই আমরা গত ৭৭ বছর ধরে এত দেখেছি, এত দেখেছি যে এখন একেবারে চোখ, মন, বুদ্ধি, এককথায় সর্বংসহা হয়ে গেছে। হরিয়ানায় গয়া লাল বলে একজন নির্দল বিধায়ক ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথমে কংগ্রেসে যোগ দেন। তার এক পক্ষকালের মধ্যে তিনি তিনবার দলবদল করেন। তারপর আবার দল বদলে কংগ্রেসে ফেরেন। তখন কংগ্রেস নেতা রাও বীরন্দ্র সিং বলেছিলেন, গয়া রাম এখন আয়া রাম হয়েছেন। তারপর থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন বাক্যবন্ধ তৈরি হয়ে গেল, আয়ারাম গয়ারাম। ফলে এই আয়ারাম গয়ারামরাও নতুন নয়। ভারতে রাজনীতি যতদিন থাকবে, ততদিন তারাও থাকবেন।

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

এই যে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশেল নিয়ে এত কথা হচ্ছে, তা কি ভারতে আগে ছিল না? ছিল। ভারতে কি রাজনৈতিক দলের নামের সঙ্গে মুসলিম বা হিন্দু জুড়ে দেয়া হয়নি? হয়েছে। সেই নামের দলগুলি এখনো আছে। জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় প্রশ্ন করেছিলেন, সোমনাথ মন্দির কেন সরকারের টাকায় পুনর্নিমাণ হবে? কিন্তু রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের নেতৃত্বে কংগ্রেসের একটা বড় অংশ বললেন, সরকারি অর্থেই তা করতে হবে। তাই হয়েছে।

এখন রামমন্দিরের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করেছেন। তিনি সৌদি আরবে গিয়েও মন্দির উদ্বোধন করেছেন। গত কয়েক মাসে তিনি একের পর এক মন্দিরে গেছেন। বিজেপি নেতাদের মুখে ভোট এলেই মন্দির-মসজিদ প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু শুধু তো বিজেপি নয়, প্রায় সব রাজনৈতিক দল একই পথে চলেছে। ভোটে প্রচার করতে গেলেই রাহুল বা প্রিয়ঙ্কা গান্ধী প্রথমেই কোনো মন্দির, মসজিদ বা গির্জায় যান। পুজো বা প্রার্থনা করেন। তারপর প্রচার করেন। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকান। মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় দীঘায় জগন্নাথ মন্দির করছেন। তার অনুরোধে কালীঘাট মন্দিরের হাল ফেরাচ্ছেন আম্বানিরা। কলকাতার গঙ্গায় আরতি শুরু হয়েছে।

দক্ষিণ ভারতে দুইজন খুবই জনপ্রিয় অভিনেতা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এম জি রামচন্দ্রন ও এনটি রাম রাও।  তার মধ্য়ে রামরাও সিনেমায় দেবতার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। একবার তিনি গেরুয়া পরে প্রচার করতে শুরু করলেন। তার প্রচাররথের নাম ছিল চৈতন্যরথম। তাকে দেখতে মানুষের ঢল নামত। রথ চলে গেলে আভূমি প্রণাম করতেন তারা। রথের ধুলো মাথায় ঠেকাতেও দেখেছি তাদের। কী বলবেন এটাকে? আবার সেই রাম রাওকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তার জামাই চন্দ্রবাবু নাইডু। আবার রথযাত্রা করেছিলেন রামরাও। কিন্তু সেবার আর মানুষ তার ডাকে সাড়া দেয়নি। এজন্য়ই বলছিলাম, ভারত এ সবই অনেকদিন ধরে দেখেছে। তার মাত্রার তারতম্য হচ্ছে এই আর কী।

প্রশ্ন হলো, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশেল কি গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল করে না? কেউ বলবেন করে, কেউ বলবেন করে না। ধর্মের বাস্তবতাকে এড়িয়ে নাকি এখন কিছুই করা যায় না। এর পাশাপাশি যে প্রশ্ন জুড়ে আছে, তা হলো, বিশ্বজুড়ে কেন অতি-দক্ষিণপন্থিরা জনপ্রিয় হচ্ছে? যে কারণে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশেল বেশি হচ্ছে, সে কারণেই অতি দক্ষিণপন্থিরা জনপ্রিয় হচ্ছে। কিছু মানুষের তাদের কথা ভালো লাগছে।  তারা মনে করছেন, এই পথটাই ঠিক। এই মানুষদের মন ও মতবদল হবে কী করে হবে, তা বিসেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। শুধু রাজনীতিতে ধর্ম ঢুকে যাচ্ছে এবং গণতন্ত্রের সর্বনাশ হচ্ছে বললে তো হবে না। মানুষের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন না হলে তো অনেক কিছুর ভিতই ধসে পড়বে।

ভারতে গণতন্ত্রের আরেকটি বিপদ বলা হচ্ছে আঞ্চলিকতাবাদকে। পশ্চিমা দেশগুলির গণতন্ত্রের সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্রের একটা ফারাক হলো, পশ্চিমা গণতন্ত্রে আঞ্চলিক সরকারের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা আছে। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা অনেক বেশি। রাজ্যগুলি অর্থ থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। এমনকী গ্রামে কী প্রকল্প হবে, তা ঠিক করে কেন্দ্র তার অর্ধেক টাকা দিয়ে বলে বাকিটা রাজ্য দেবে। কোন রাজ্য়ে কোন গ্রামে কোন প্রকল্প দরকার তা কি দিল্লিতে বসে বোঝা সম্ভব? ফলে দীর্ঘদিন ধরে অনেক রাজ্য বঞ্চিত হয়েছে। যে সব রাজ্যের দাপট বেশি, সাংসদ বেশি, একই দলের সাংসদ বেশি, তারা প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে আঞ্চলিকতাবাদও প্রাধান্য পেয়েছে। বিহার, উত্তরপ্রদেশে একসময় অনগ্রসরদের রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে। এখন তো আবার দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পার্থক্য সামনে আসছে। উত্তর ভারত হলো বিজেপি-র শক্ত জমি। আর দক্ষিণ ভারত কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের।

এ সব কি গণতন্ত্রকে দুর্বল করে? আমার তো মনে হয়, এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। ভারতের মতো বিশাল বহুভাষিক, বহুসাংস্কৃতির দেশের এটাই দরকার। সেজন্যই ভারতীয় গণতন্ত্র ছাঁচে ঢালা নয়।

ভারতে নরেন্দ্র মোদী, নীতীশ কুমার, মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়, যোগী আদিত্যনাথরা সকলেই কিন্তু ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন। বছরের পর বছর শাসন করছেন। যে পরিণত ভোটদাতারা অতীতে ভারতীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য বহন করে এসেছেন, তারাই ভোট দিচ্ছেন। আর যখনই দরকার হচ্ছে, তারা শাসক বদলে দিচ্ছেন। কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, ছত্তিশগড় তার শেষতম উদাহরণ। আরেকটা জায়গা ভারতীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে রেখেছে। তা হলো আদালত। তাদের উপর মানুষের এখনো ভরসা আছে। ফলে এখনো গেল গেল রব তোলার মতো সময় আসেনি।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

বাংলাদেশ