চড়ছে বাজারদর, কমছে ক্রয়ক্ষমতা
১০ মার্চ ২০২৩রমজানেরকিছুদিন আগে থেকে চাল-ডাল, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ, তেল-চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি যেন এক অনিবার্য বাস্তবতা যা থেকে বাংলাদেশের মানুষের কোনো রেহাই নেই৷ গতমাসের মাঝামাঝি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যায় এমন সব পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হতে পারে৷
দাম কেন বাড়ে? এই প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই৷ চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য না থাকার বিষয়টি প্রথম কারণ হিসেবে মেনে নিলেও আরো কয়েকটি বিষয় এখানে জড়িত আছে৷ বরাবরই ক্রেতা-ভোক্তাসহ অনেকের একটা বড় অভিযোগ হলো, বাজারে বিক্রেতা-ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেট বা চক্র মিলে দাম বাড়ায় বাড়তি মুনাফার আশায়৷ আবার এমন অভিযোগও বেশ জোরাল যে বড় বড় আমদানিকারক ও পাইকারী বিক্রেতারা পারস্পরিক যোগসাজশে রমজানের বেশ আগে থেকেই দাম বাড়িয়ে দেয় যেন রমজান মাস আসার আগেই বাজারদর চড়া থাকে৷ আর সেই চড়া দরেই রমজানে বাজারে পণ্য বিক্রি হয়৷
অন্যদিকে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের দিক থেকে দাবি করা হয় এবং এবার করা হচ্ছে যে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেশি থাকায় তাদের বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হয়৷ বছরব্যাপী ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বৈশ্বিক পণ্যবাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে, এটা বাস্তবতা৷ এর সঙ্গে গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে ডলার সংকট দেখা দেয়ায় নিত্যপণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেও সময়মতো তা নিষ্পত্তি না করার ঘটনা ঘটেছে৷ যার ফলে আমদানি অধিকতর ব্যয়বহুল হয়েছে৷ এর প্রভাবে দেশের বাজারে দাম বেড়েছে ও বাড়ছে৷
এই অবস্থায় মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের বাজারদরের দিকে একটু চোখ রাখা যাক৷ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুসারে, সরু চালের গড় দাম কেজিপ্রতি ৭৫ টাকা যা বছরখানেক আগে ছিল ৭০ টাকা৷ আটা ও ময়দা কেজিপ্রতি গড়ে যথাক্রমে ৬৮ থেকে ৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা বছরখানে আগে ছিল ৪৫ ও ৬০ টাকা৷ রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক গমের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে আটা-ময়দার দরে৷ এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতল অন্তত ১৮০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে যা এক বছর আগে ছিল ১৭০ টাকা৷ রমজানের অপরিহার্য ছোলা এখন কেজিপ্রতি ৯৫ টাকা যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি৷ আবার টিসিবির হিসেবেই মার্চ মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পেয়াঁজের দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ; কেজিপ্রতি খেজুরের গড় দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পরযন্ত৷ এছাড়া সম্প্রতিকালে মুরগীর ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে৷ ফেব্রুয়ারি মাসে ডজনপ্রতি মুরগির ডিম বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়৷ এখন তা ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে৷ ব্রয়লার মুরগি এক মাসের কম ব্যবধানে কেজিপ্রতি গড়ে ১৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬০ টাকা৷ এছাড়া বাজারে বিভিন্ন সবজির দামও বেড়ে গেছে৷
দেখা যাচ্ছে, এভাবে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে দেশের নিম্ন ও সীমিত আয়ের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অনেকটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে৷ কোথাও কোথাও কেজির বদলে আড়াইশ গ্রাম করে গরুর মাংস, পিস বা টুকরো হিসেবে মুরগীর মাংস ও টুকরো হিসেবে বড় মাছ বিক্রি শুরু হয়েছে৷ এ থেকেই বোঝা যায় যে সাধারণ মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কতোটা কমে গেছে৷ সরকারের খোলা বাজার বিক্রি বা ওএমএস কার্যক্রমের ট্রাকে চালের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ঘরে ফেরা মানুষের সংখ্যাও কম নয়৷
সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে দেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ ২০১৬ সালে ছিল ৬৩.৮০ গ্রাম যা ২০১০ সালে ছিল ৬৬.২৬ গ্রাম৷ একইভাবে মাথাপিছু দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ ২০১০ সালের ২৩১৮ কিলো-ক্যালোরি থেকে ২০১৬ সালে নেমে আসে ২২১০ কিলো-ক্যালোরিতে৷ বর্তমান পরিস্থিতি কী তা জানতে আরো দু'তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে৷ তবে অবস্থার উন্নতির বদলে অবনতি হওয়ার আশংকাই প্রবল৷
সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি যে উর্ধ্বমুখী হয়ে মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিচ্ছে, তা সরকারি পরিসংখ্যানেও স্পষ্ট৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেব অনুসারে, গত বছর জুলাই মাসে যেখানে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ, তা এ বছর জানুয়ারি মাসে ৭ দশমিক ৯২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে৷ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির বার্ষিক গড় হার পাঁচ দশমিক ৬০ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার পরিকল্পনা করেছিল৷ চলমান বাজার পরিস্থিতিতে সেটা যে আর সম্ভব নয়, তা বুঝতে পেরে এখন মূল্যস্ফীতির হার বছর শেষে সাড়ে সাত শতাংশের বেশি যেন না হয়, সেই চেষ্টা চলছে৷
কিন্তু দুই মাসে তিনদফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা যে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে তা নীতি-নির্ধারকরা কতোটা বিবেচনায় নিয়েছেন বা আদৌ নিয়েছেন কি না সে প্রশ্ন এখন তোলাই যায়৷ খুচরা পর্যায়ে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম তিন দফায় বেড়েছ মোট ১৫ শতাংশ৷ সরকার এও জানিয়ে দিয়েছে যে প্রতিমাসেই দাম সমন্বয় করা হবে যার মানে হলো মূলত বাড়বে৷ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় একদিকে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যয় বাড়বে যার প্রভাব পড়বে বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি ও খুচরা বাজার দরে৷ অন্যদিকে বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিলও বেড়ে যাবে৷ দুইয়ে মিলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে৷
গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি কমানোর জন্য এভাবে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়েছে৷ প্রশ্ন হলো, জ্বালানিখাতে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার ও অদূরদর্শি পরিকল্পনার কারণে বছরের পর বছর দেয়া ভর্তুকির দায়ভার শুধু সাধারণ জনগণকে কেন টানতে হবে? বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি কমিয়ে আনা গেলে ভর্তুকির ব্যয় অনেকটাই কমানো যেতো৷ আর তাহলে এত ঘন ঘন দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলতে হতো না৷
এদিকে শীতকাল শেষ হয়ে গরমকাল আসছে৷ তাতে করে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়তে শুরু করেছে৷ আগামী কিছুদিনের মধ্যে আরো বাড়বে বাসাবাড়ি, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় গরম কমাতে পাখা ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়তে থাকায়৷ তাতে করে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার আশংকাও আছে যার প্রভাবে আবার উৎপাদন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে পারে৷
পাশাপাশি আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা দরকার৷ বাজারে দাম যতোই চড়া হোক কিছু সংখ্যাক মানুষের জন্য তা কোনো সমস্যা নয়৷ আর সমস্যা নয় বলেই চড়া দরেই পণ্য বিক্রি একেবারে বন্ধ থাকে না কখনো যা একটি বৈষম্যমূলক সমাজেরই প্রতিফলন৷ এই দেশে অল্প মানুষের হাতে বেশিরভাগ অর্থ-সম্পদ যে পুঞ্জিভূত হয়ে পড়েছে, তা বিভিন্নভাবে বোঝা যায়৷ বাজারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়াও তার একটি সূচক৷ উল্লেখ্য, খানা আয় ও ব্যয় জরিপ (২০১৬) থেকে জানা যায় যে শীর্ষ ১০ শতাংশ পরিবারে হাতে মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ পুঞ্জিভূত যা ২০২০ সালে ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ৷ বিপরীতে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশের হাতে মোট আয়ের মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশ আছে যা ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ৷ বর্তমানে এই অবস্থার অবনতি হয়েছে, তা হালনাগাদ পরিসংখ্যান ছাড়াই বোঝা যায়৷
বাজার দর নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারের দিক থেকে কিছু প্রচেষ্টা বরাবরই লক্ষ্য করা যায়৷ ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে দাম না বাড়ানোর অনুরোধ, বিভিন্ন পণ্যের মজুদ যে পরযাপ্ত আছে তা নিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করা, কথিত বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি ইত্যাদি তার মধ্যে অন্যতম৷ এসবের মধ্য দিয়ে কতোটা কাজ হয়, তা কম-বেশি সবারই জানা৷