কেবল সকাল আটটা বাজে৷ উঠতি বয়সিদের স্বাভাবিক চপলতা, মোবাইল ফোনে ডুবে থাকা বাদ দিয়ে কিছু টিনএজারকে দেখা গেল ওরিও, আগ্রো এবং ভিলমার কাণ্ডকারখানা মনোযোগ দিয়ে দেখতে৷ এই তিন ছাগলের মধ্যে কিছু একটা তাঁরা খুঁজে পেয়েছে, যা তাঁদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে৷
শুধু ছাগল নয়, বার্লিনের এই স্কুলে হাঁস, মুরগি, শূকর এবং আরো নানা ধরনের পশুপাখি আছে৷ প্রতিদিনই জার্মানির অন্য সব স্কুলের মতো হাগেনবেক স্কুলেও সকালে দল বেঁধে প্রবেশ করে প্রায় ৪০০ ছাত্র-ছাত্রী৷ কিন্তু তবুও অন্যদের চেয়ে বেশ খানিকটা আলাদা এই স্কুল৷
১২ বছরের ইয়ারা বলছে, ‘‘আমি এই স্কুলেই পড়তে চাই, কারণ, আমি পশু-পাখি এবং বাগান পছন্দ করি৷'' ইয়ারা তখন তাঁর বন্ধুদের সাথে মিলে স্কুলের বাগান থেকে তুলে আনা আপেল কাটছিল৷ এই আপেল একটু পরে তারা ছাগলকে খাওয়াবে৷
স্মৃতির ভেলায় চেপে মাঝেমধ্যে স্কুলবেঞ্চে ফিরে যেতে কে না ভালোবাসে! জার্মানির হিল্ডেসহাইম শহরের প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকরা তাঁদের বিদেশি সহকর্মীদের স্কুলজীবনের স্মৃতি খুঁড়ে তুলে এনেছেন অমূল্য সব মনিমুক্তা৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheimসেকালে অনেক স্কুল বালিকারই একটি করে ডায়েরি থাকত৷ পেন্সিলে আঁকা ছবি আর আত্মীয়-বন্ধুদের শুভেচ্ছা বার্তা সেই ডায়েরির পাতায় পেত অমরত্ব৷ ইউক্রেনের ছোট্ট মেয়ে লাদুষ্কার স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিনে তাঁর ডায়েরিতে বাবা-মা লিখে দিয়েছিলেন এই শুভেচ্ছা বার্তা৷ এ রকম সব স্মৃতিচিহ্ন নিয়েই হিল্ডেসহাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল মিউজিয়ামে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী – ‘১০০১ স্কুলের গল্প’৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheimশিক্ষার্থীদের মাঝে দাঁড়ানো শিক্ষিকাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্লাসে তিনি কতটা কঠোর৷ ১৯৭০ এর দশকে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের স্কুলগুলোতে কড়া শাসনই চলত৷ অন্য দেশের পরিস্থিতিও খুব একটা আলাদা ছিল না৷ এখনো বহু দেশে স্কুল শিক্ষার্থীদের কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে বড় হতে হয়৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheimউজবেকিস্তানে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা প্রতি বছর ২২শে এপ্রিল সাবেক কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জন্মদিনে স্কুলে হাজির হতো উৎসবের পোশাকে৷ বালিকারা কেউ কেউ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যেত কনের সাজে৷ আর বালকদের কারো গলায় ঝুলত টাই, কারো গায়ে স্যুট৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheimস্কুলবেঞ্চিতে বসে বন্ধুর কানে কানে কথা বলতে গিয়ে কানমলা খাওয়ার স্মৃতি কতোই না মধুর! ৭০ বছর আগে যাঁরা নেদারল্যান্ডসের কোনো স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন, তাঁদেরও হয়েছে এমন অভিজ্ঞতা৷ এইসব স্মৃতির ভিড়ে এখনো তাঁদের চোখে ভাসে বর্ণমালা শেখার সেই বই – ‘ওপা হাস’৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheim১৮৮৪ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা ছিল জার্মানির উপনিবেশ৷ সে সময় কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের স্কুলে শিক্ষকরা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ৷ ১৯১২ সালের এই পোস্টকার্ড সেই গল্পই বলছে৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheim১৯৫০-এর দশকের এই ছবি জার্মানির এক গাঁয়ের৷ সে সময় ফসল কাটার মৌসুমে কৃষক পরিবারের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ফেলে বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগ দিত মাঠের কাজে৷ কাজের ফাঁকে মাঠে বসেই পুরো পরিবারের মধ্যাহ্নভোজ৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheim১৯৮৪ সালে কাজাখস্তান থেকে পরিবারের সঙ্গে জার্মানিতে আসা এক স্কুলছাত্রীর রিপোর্ট কার্ড এটি৷ সে কোন বিষয়ে কতটা ভালো, স্বভাব-চরিত্রে কতটা লক্ষ্মী, তার বিস্তারিত বিবরণ এতে রয়েছে৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheim১৯৬৯ সাল৷ কাজাখস্তানের এই ছাত্র-ছাত্রীরা সাফল্যের সঙ্গে মাধ্যমিক স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেছে৷ সেখানে স্কুলের নিয়ম হলো- প্রতিটি শিশু প্রথম দিন ক্লাসে আসবে শিক্ষকের জন্য একগোছা ফুল হাতে৷ আর মাধ্যমিক শেষ হলে স্কুল থেকে তাঁরা ফুল হাতেই বিদায় নেবে৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheimউজবেকিস্তানের এই ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেছে ১৯৭৫ সালে৷ স্ট্যালিন স্কুলের শিক্ষার্থীদের পত্রিকায় তাঁদের ছবি পেয়েছে অমরত্ব৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheimমাক্স এঙ্গেলকিং অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিজেই শিক্ষকতা শুরু করবেন৷ তাঁর হাতের এই গ্লোব দিয়ে এক সময় ছাত্র-ছাত্রীদের দুনিয়া চেনাতেন শিক্ষকরা৷ ১০০১ স্কুলের গল্প নিয়ে এই প্রদর্শনী চলবে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত৷
ছবি: Schulmuseum Uni Hildesheim এলোডি নামের আরেক শিক্ষার্থী বলছে, ‘‘এদের একজন একজন করে যত্ন করে খাওয়াতে হয়৷ নাহলে একজন কম খাবার পেলেই মারামারি শুরু করে দেয়৷''
ক্লাসরুমে বসে পড়াশোনা করার চেয়ে এটা কি বেশি মজার? এক মুহূর্ত দেরি না করে উত্তর এলো, ‘‘হ্যাঁ, অবশ্যই৷''
পশুর চেয়েও বেশি কিছু
তাই বলে এই স্কুলে যে কোনো ক্লাসরুম নেই, তা কিন্তু না৷ হাগেনবেকেও অন্য সব স্কুলের মতো গণিত, জার্মান ভাষা, খেলাধুলা, পদার্থবিজ্ঞান এবং ভাষাবিজ্ঞান শেখানো হয়৷ কিন্তু সবকিছুতেই থাকে জীববৈচিত্র্যের ছোঁয়া৷
স্কুলের উপপ্রধান ক্লাউডিয়া ক্র্যোটেনহ্যার্ড্ট ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিক্ষকরা সবাই একসাথে আলোচনা করেই ঠিক করেন, কিভাবে পড়ালে শিক্ষার্থীদের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা দেয়া যাবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমি যতদূর জানি, জার্মানিতে আমরাই একমাত্র স্কুল, যারা এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়৷''
২০০৭ সালে জার্মান সরকার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই চালু হয় এই প্রকল্প৷ তবে এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি ক্র্যোটেনহ্যার্ড্ট ও তাঁর সহযোদ্ধাদের৷
পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কিভাবে শস্য বুনতে হয়, কিভাবে তাদের যত্ন নিতে হয় এবং সবশেষে কিভাবে ফসল তুলতে হয়, সে বিষয়েও হাতেকলমে শিক্ষা পেয়ে থাকে স্কুলের শিক্ষার্থীরা৷
আরো নানা ধরনের পরিকল্পনা থাকলেও সীমিত বাজেটের কারণে সবসময় সবকিছু করা হয়ে ওঠে না৷ কিন্তু অর্থের অভাব যাতে ব্যতিক্রমী এ চলার পথ রুদ্ধ না করতে পারে, সে ব্যাপারে শিক্ষকদের পাশাপাশি সচেতন অভিভাবকরাও৷
কেমন লাগলো প্রতিবেদনটি লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷
মাবেল গুন্ডলাখ/এডিকে