ছাত্রদের অনশন আন্দোলনেরই জিত হলো কলকাতা মেডিকেল কলেজে৷ হোস্টেলের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ১৪ দিন পর উঠে গেল অনশন৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার ছিল মেডিকেল কলেজে অনশনরত ছাত্রদের সমর্থনে গণ কনভেনশন৷ মাত্র একদিনের নোটিসে ডাকা সেই কনভেনশনে যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়াও সমাজের বহু স্তরের মানুষ৷ এবং সর্বত্র মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল পাওয়ার ন্যায্য দাবির সমর্থনে জনরব জোরদার হচ্ছিল৷ কবি শঙ্খ ঘোষ, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, গীতিকার-গায়ক কবীর সুমন, এবং আরও অনেক বিশিষ্টজন খোলাখুলি ছাত্রদের সপক্ষে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছিলেন৷ পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক নেতারাও সরব হয়েছিলেন ছাত্রদের পক্ষে৷ সিপিএম সাংসদ সুজন চক্রবর্তী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, মেদিনীপুরে প্রধানমন্ত্রীর সভায় প্যান্ডেল ভেঙে পড়ে আহতদের দেখতে আপনি হাসপাতাল যাওয়ার সময় পেয়েছেন, কিন্তু মেডিকেল কলেজের অনশনরত ছাত্রদের কাছে যাওয়ার দরকার মনে করেননি! একদা তৃণমূল এবং মমতা ব্যানার্জির অতি বিশ্বস্ত, এখন বিজেপি নেতা মুকুল রায় চিঠি দেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডা এবং জাতীয় মেডিকেল কাউন্সিলের সভানেত্রী জয়শ্রী মেহতাকে এবং কলকাতা মেডিকেল কলেজের এই অচলাবস্থায় হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান৷ তার আগে মুকুল রায় অনশনরত ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে মেডিকেল কলেজেও গিয়েছিলেন৷ কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা তখনই তাঁকে জানিয়ে দেন, তাঁদের আন্দোলনে কোনো রকম রাজনৈতিক রঙ লাগুক, তা তাঁরা চাইছেন না৷ বস্তুত শুরু থেকেই এই অবস্থানে স্থির থেকেছেন মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীরা, যে এ তাদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা এবং তার সমাধানের জন্য তাঁরা কলেজ কর্তৃপক্ষের দিকেই তাকিয়ে আছেন৷
তখনও কিন্তু রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের তরফ থেকে অনমনীয় মনোভাব দেখানো হচ্ছিল৷ কখনো বলা হচ্ছিলো যে, এই সিদ্ধান্ত নেবেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য দপ্তর৷ কাজেই নবান্ন, অর্থাৎ রাজ্য সচিবালয়ের দিকে তাকিয়েই অপেক্ষা করতে হবে৷ কখনো রাজ্যের ডিরেক্টর অফ মেডিকেল এডুকেশন ডা. দেবাশিস ভট্টাচার্য সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিচ্ছিলেন যে, ছাত্ররা যে প্রতীকি অনশন করছে, তা যেন তারা তুলে নেয়৷ এর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির গোটা ঘটনা সম্পর্কে নীরব এবং নির্বিকার থাকা অনিশ্চয়তা আরো বাড়িয়ে তুলেছিল৷ শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর নীরব হস্তক্ষেপেই সমস্যার সমাধান হলো সোমবার৷ মেডিকেল কলেজ কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, নতুন ১১তলা হোস্টেলবাড়িতে আপাতত সব বর্ষের ছাত্রদেরই জায়গা হবে৷ প্রথমে মৌখিক, তারপর লিখিতভাবে এই আশ্বাস পেয়ে অনশন তুলে নিলেন ছাত্র-ছাত্রীরা৷ মেডিকেল কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল ডা. অশোক ভদ্রের হাত থেকে জল খেয়ে নির্জলা উপবাস সাঙ্গ হলো৷ সবাইকেই তারপর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো৷ এবং প্রিন্সিপাল সংবাদ মাধ্যমকে জানালেন, নতুন হোস্টেলের দু’টো তলা বরাদ্দ থাকবে প্রথম বছরের মেডিকেল ছাত্রদের জন্য, এবং দুটো তলা সিনিয়র ছাত্র এবং দুটো তলা স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রদের জন্য৷ হোস্টেল দেওয়ার প্রক্রিয়া হবে স্বচ্ছ এবং কাউন্সেলিংয়ের ভিত্তিতে৷ তবে এটা অস্থায়ী ব্যবস্থা৷ মেডিকেল কলেজের আরো একটি নতুন ছাত্রাবাস তৈরি হচ্ছে৷ ৫০০ আসনের ওই ছাত্রাবাস তৈরি হয়ে গেলেই সিনিয়র ছাত্রদের সেখানে স্থানান্তরিত করা হবে৷
এদিন অনশন উঠে যাওয়ার পর যখন উচ্ছ্বসিত সবাই, এই অনশন আন্দোলনের অন্যতম মুখ যিনি, সেই অনিকেত চট্টোপাধ্যায় শ্রান্ত গলায় সংবাদ মাধ্যমকে বললেন, এটাই তাঁরা প্রথম থেকে চাইছিলেন৷ যদি শুরুতেই এটা মেনে নিতো কর্তৃপক্ষ, তা হলে এত অশান্তিই হতো না!
কলকাতা: বিপ্লবের আঁতুরঘর
কলকাতার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি৷ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের আঁতুড়ঘর ছিল বাংলা৷ এই শহরেই স্বাধীনতার মুহূর্তে অনশনে বসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক পেরিয়ে নজর ইতিহাসের আলো-আঁধারিতে৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়
১৯০২ সালে ব্রিটিশ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে অনুশীলন সমিতি৷ পি মিত্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এখানে শরীরচর্চা, অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ হতো৷ প্রকাশিত হত সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’৷
ছবি: DW/Payel Samanta
৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়ি
সশস্ত্র বিপ্লবীদের এই মূল আখড়াতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে বোমা তৈরির মালমশলা উদ্ধার করে৷ গ্রেপ্তার করা হয় অরবিন্দ ও বারীন ঘোষ সহ একাধিক বিপ্লবীকে৷ শুরু হয় ঐতিহাসিক আলিপুর বোমার মামলা৷ আজ সেই বাগানবাড়ি নেই, তবে বোমার মাঠ টিকে আছে৷ প্রোমোটারের হাত থেকে এই মাঠ রক্ষায় চলছে আন্দোলন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
আদালতে
আলিপুর বোমার মামলা ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়৷ এই মামলায় ৩৭ জনের বেশি সন্দেহভাজনের বিচার হয়েছিল আলিপুর জাজেস কোর্টে৷ মৃত্যুদণ্ড, দ্বীপান্তর এবং যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেওয়া হয় বিপ্লবীদের৷
এই কাঠগড়াতেই অপরাধীর ভূমিকায় ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ৷ এজলাসে সাক্ষীর কাঠগড়া, সেকেলে সিলিং ফ্যান, বিচারকের চেয়ার, টাইপরাইটার আজও রয়েছে৷ এই কক্ষেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন৷ বিচারে অরবিন্দ মুক্তি পান৷
ছবি: DW/Payel Samanta
আলিপুর জেলে ফাঁসির মঞ্চ
এই জেলে বন্দি রাখা হত বিপ্লবীদের৷ আলিপুর বোমা মামলায় বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে এখানেই হত্যা করেন কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু৷ ১৯০৮ সালে এখানেই তাঁদের ফাঁসি হয়৷ এই জেলে অরবিন্দ ঘোষের ভাগবৎ দর্শন ঘটে৷ নেতাজি থেকে বিধানচন্দ্র রায় এই কারাগারে বন্দি ছিলেন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
শক্তির আরাধনায় বিপ্লবীরা
শক্তিরূপে দেবীর আরাধনার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী যুবশক্তিকে সংগঠিত করার প্রয়াসে একসময় দুর্গাপুজোর সূত্রপাত হয়েছিল কলকাতায়৷ ১৯২৬ সালে বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর হাত ধরে শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গোৎসব৷ এখানেও ছিল বিপ্লবীদের শরীরচর্চার আখড়া৷
ছবি: DW/Payel Samanta
প্রাণ হলো বলিদান...
১৯৩০ সালের রাইটার্স বিল্ডিং বা মহাকরণে বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্তের অভিযানে মারা পড়েন কুখ্যাত পুলিশকর্তা সিম্পসন৷ তারপর এই ভবনের অলিন্দেই ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির লড়াই হয়৷ তিন বিপ্লবীর স্মরণে এই এলাকার নাম বিবাদী বাগ৷
ছবি: DW/Payel Samanta
পুলিশের জাদুঘর
সুকিয়া স্ট্রিটের কাছে এই ভবন ছিল রাজা রামমোহন রায়ের৷ সেখানেই তৈরি হয়েছে কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম৷ কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য ব্যবহৃত বোমা, আলিপুর বোমা মামলার নথি থেকে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস বা দীনেশ মজুমদারের পিস্তল রয়েছে এই সংগ্রহশালায়৷
ছবি: DW/Payel Samanta
বেলেঘাটায় গান্ধী
কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামাতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ বেলেঘাটার হায়দারি মঞ্জিলে ছিলেন ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর৷ এখানেই গড়ে উঠেছে গান্ধী ভবন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতার মুহূর্তে
দাঙ্গা থামাতে হায়দারি মঞ্জিলে গান্ধীজি অনশন করেন৷ তাতে থেমেছিল রক্তপাত৷ ৪ সেপ্টেম্বর দাঙ্গাবাজেরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয় বাপুর কাছে৷ দুই সম্প্রদায়ের তরফে দেওয়া হয়েছিল শান্তির লিখিত প্রতিশ্রুতিও৷
ছবি: DW/Payel Samanta
স্বাধীনতা এলো
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বদেশিয়ানার প্রতীক ছিল গান্ধীর চরকা৷ সাত দশক আগে বাপুর ব্যবহৃত চরকা গান্ধী ভবন সংগ্রহশালার আকর্ষণ৷
ছবি: DW/Payel Samanta
জীবন যখন বাণী
১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট এই ঘরে বাপু অনশনে বসেছিলেন৷ এখানেই করতেন প্রার্থনা৷ বিশিষ্ট এই ভবনে এসেছেন দিকপাল ব্যক্তিত্বরা৷ তবুও কলকাতার পর্যটন মানচিত্রে ব্রাত্য গান্ধী ভবন৷
ছবি: DW/Payel Samanta
হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস
উত্তর কলকাতার এই বাড়িটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ অথচ সংরক্ষণের অভাবে স্বাধীনতার এমন বহু স্মারক হারিয়ে যেতে বসেছে৷