নেত্রীরা ক্ষমা চাওয়ার পরও উপাচার্য নিষ্ক্রিয়
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে৷ ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ করার ফলে খবরটি সংবাদমাধ্যমে আসে দুইদিন পর৷ সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজন ছাত্রলীগ নেত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হলো বুধবার, অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি৷ হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির উদ্যোগে তা সম্ভব হলো৷
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৫ ফেব্রুয়ারি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে৷ ২২ ফেব্রুয়ারি তাদেরও প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা৷ কিন্তু তারা এখনো কোনো প্রতিবেদন দেননি৷
হলের গণরুমে প্রকাশ্যে ছাত্রী নির্যাতন করা হলেও প্রভোস্ট বা অন্য কোনো দায়িত্বশীল সেই রাতে এগিয়ে আসেননি বলে অভিযোগ৷ পরের দিনও তাকে হল ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷
১৯ ফেব্রুয়ারি হাইকার্ট নির্দেশ দেয়ার পর আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়৷ হাইকোর্ট নির্যাতনকারী দুই ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তাবাসসুমকে হলের বাইরে থাকার নির্দেশ দেন৷ তার আগ পর্যন্ত তারা ক্যাম্পাসে থেকে উল্টো নির্যাতনের শিকার ছাত্রীকে ক্যাম্পাসে না আসার হুমকি দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ নির্যাতিতা তখন ক্যাম্পাসেই আসতে পারেনি৷ তখন ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম বলেছিলেন, " তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না৷ আমাদের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷”
বুধবার হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত পাঁচ ছাত্রীকে সাময়িক বহিস্কার করেছে৷
ইসালামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ইমানুল সোহান বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনায় নিজেদের উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি৷ তারা অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷ আমার ধারণা, ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না হলে এবং হাইকোর্ট আদেশ না দিলে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হতো না৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের দুইটি তদন্ত কমিটি আসলে কোনো কাজ করছে বলে মনে হয় না৷”
তিনি বলেন, "ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেত্রী হওয়ায় তারা পার পেয়ে যেতো৷ এখন হয়তো বা আর পার পাবে না৷”
ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার সময়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতি ও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগও উঠেছে৷ কয়েকটি অডিও ভাইরাল হয়েছে৷ এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিতে বিবৃতিও দিয়েছেন৷
ইমানুল সোহান বলেন, "আমরাও দুর্নীতির তদন্ত চাই৷ একটা বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে চলতে পারে না৷” তিনি বলেন, "ভিসি কয়েকদিন ধরে অফিস করছেন না৷ তিনি তার বাসায় বসে ফাইলপত্র সই করছেন৷ জানতে পেরেছি বিকেলে (বৃহস্পতিবার) তিনি ঢাকা চলে গেছেন৷ আর প্রক্টর স্যারও ফোন ধরছেন না৷” এই প্রতিবেদকও ফোনে চেষ্টা করে তাদের পাননি৷
বিশ্বেবিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, "এখনকার উপাচার্য সব ক্ষেত্রেই অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছেন৷ একটার পর একটা অভিযোগ উঠছে তার বিরুদ্ধে৷ তার বিরুদ্ধে এখন নিয়োগে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেবেন৷”
তার কথা, "ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা হাইকোর্ট পর্যন্ত যাওয়ায় আমরা দুঃখিত এবং লজ্জিত৷ ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সময়মতো ব্যবস্থা নিতো তাহলে এরকম হতো না৷ তারা তা করেননি৷ হাইকোর্টের নির্দেশের পর এখন কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷” এ সময় তিনিও দাবি করেন, বর্তমান ভিসি বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছেন৷
আর আইন বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলাম মনে করেন, "বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই ছাত্রীর নিরাপত্তা দিতে এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করতে শুরুতে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি৷ তারা ব্যর্থ হয়েছে৷ এর দায় আমাদের সবার৷”
তিনি বলেন, "শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্টও তার দায়িত্ব পালন করেননি৷ তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন৷”
তিনি আরো মনে করেন উপাচার্য অভিযুক্ত ছাত্রীদের বিষয়ে শুরুতে নিষ্ক্রিয় থেকে ঠিক করেননি, কারণ, "তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না এটা কোনো কথা নয়৷ প্রাথমিকভাবে তদন্তের স্বার্থেই কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতো৷ তখনই অভিযুক্তদের ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠানো এবং ছাত্রীটির নিরপত্তা নিশ্চিত করা যেতো৷”
নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী বুধবারই আবার বাড়িতে ফিরে গেছেন৷ বুহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন,"এখনো আমি বাড়িতে অবস্থান করছি৷ ওই আপুরা ক্যাম্পাসের বাইরে গেছেন কিনা আমার জানা নেই৷ তবে এ নিয়ে আমি আর বেশি কথা বলতে চাই না৷ যেহেতু এখন তদন্ত শুরু হয়েছে, তাই বিচার পাবো বলে আশা করছি৷ এখন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে৷”
শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম মনে করেন সেই হলে এত বড় ঘটনা ঘটার পরও তার বিশেষ কিছু করার নেই, কারণ, ওই মেয়েটি হলের আবাসিক ছাত্রী নন৷ এই যুক্তিতে দায় এড়ানোর চেষ্টায় অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন , "ওই ছাত্রীটি আমার হলের আবাসিক ছাত্রী নয়, সে একজন ছাত্রীর অতিথি ছিল, তাই তার ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না৷ তার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার নয়৷” যে হলের তিনি প্রভোস্ট, সেই হলের এত বড় একটি ঘটনার তদন্তে তিনি যে কমিটি গঠন করেছেন তারা কী করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন," তদন্ত চলছে৷ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর জানা যাবে কী হয়েছে৷ আর হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি কী করছে সেটা তাদের ব্যাপার৷ আমার জানা নেই৷”