গত বছর ডিসেম্বরে বিরোধী দলের অবরোধের সময় ঢাকায় নিহত দোকান-কর্মচারী বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের ৮ কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷ এছাড়া ১৩ জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷
বিজ্ঞাপন
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল বুধবার এই রায় ঘোষণা করেন৷
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধ চলাকালে ছাত্রলীগের কর্মীরা পুরনো ঢাকার বাহাদূর শাহ পার্ক এলাকায় বিশ্বজিৎ দাসকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে৷ একটি দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ সকালে পায়ে হেঁটে কাজে যাচ্ছিলেন৷ তখন বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে জগন্নাথ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা তাঁকে সেখানেই নির্মমভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে৷ সে প্রাণ বাঁচাতে পাশের একটি ক্লিনিক ভবনে আশ্রয় নিয়েও বাঁচতে পারেনি৷ সেখানে তাকে ঘেরাও করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ পুলিশ এবং সাংবাদিকদের সামনেই এই নির্মম ঘটনাটি ঘটে৷
এই ঘটনার পর সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়৷ চলতি বছরের ৫ মার্চ তদন্ত শেষে পুলিশ ছাত্রলীগের ২১ কর্মীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়৷ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে বুধবার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক রায় দেন৷ রায়ে ৮ জনকে ফাঁসি এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে৷ কারাদণ্ড প্রাপ্তদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে৷
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮ জনের মধ্যে ৬ জন কারাগারে আছেন৷ তারা হলেন, রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, জি এম রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, কাইয়ুম মিয়া ও ইমদাদুল হক ওরফে এমদাদ৷ আর পলাতক আছেন রাজন তালুকদার ও নুরে আলম৷ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১৩ জনের মধ্যে এস এম গোলাম কিবরিয়া এবং গোলাম মোস্তফা কারাগারে আছেন৷ বাকি ১১ জন এখনো পলাতক৷
বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় পুলিশ স্বেচ্ছায় আসামিদের আটক করেনি৷ হাইকোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি এবং এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে অপরাধীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিলে পুলিশ তৎপর হয়৷
রায় ঘোষণার পর বিশ্বজিতের ভাই উত্তম কুমার দাস ডয়চে ভেলেকে জানান, এই রায়ে তাঁরা মোটামুটি সন্তুষ্ট৷ এখন তাদের দাবি, পলাতক আসামিদের গ্রেফতার এবং দ্রুত রায় কার্যকর করা৷ তিনি জানান বিশ্বজিৎ হত্যার পর তাঁদের পরিবার আর্থিক বিপর্যের মুখে পড়েছে৷ তাদের পরিবার এখন সংকটের মুখে আছে৷
এদিকে, পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু জানান, আদালত ন্যায়বিচার করেছেন৷ এতে প্রমাণিত হলো, কেউ অপরাধ করলে সে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন পার পায় না৷ আসামি পক্ষের আইনজীবীরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়েছেন৷